মাহমুদ কামাল ।।
জোছনায় সাঁতার কেটে কেটে আবদুল মতিনের মন ভালো হয়ে যায়। কিন্তু এই গল্পে বাক্যটি বসবে শেষে। তাহলে আগে বসলো কেন? আমরা জানি গল্পের গরুও আকাশে ওঠে। এই গল্পটা বোধহয় সেরকমই। ওইযে আবদুল মতিন জোছনায় সাঁতার কাটলো। সেতো কয়েক মুহূর্ত। গল্পের শুরুটা এই রকম:
গতকাল থেকে আব্দুল মতিনের মন খারাপ। এখন সে বারান্দায় পেতে থাকা ইজিচেয়ারে শুয়ে আছে। মাথার মধ্যে নানা রকম চিন্তা। চোখ দুটো রাস্তার মানুষ দেখছে। যে কারণটির জন্য কাল থেকে আব্দুল মতিন বিমর্ষ তা মন থেকে সরানোর অনেক চেষ্টা করেও ব্যর্থ হয়েছে। সব কিছুর মধ্যেই এখন সে নিরাসক্ত। সংসারপ্রেমী মানুষ হিসেবে যে সুনামটি আত্মীয় মহলে প্রচারিত তা এখন বিষের মতোই।
ঘরের ভেতরে কাঁচের প্লেট ভাঙ্গার শব্দ হলো। আব্দুল মতিন চমকাল না। একটা দামি জিনিষ নষ্ট হলো’ এই বাক্যটি শুধু মনে হলো। তার সংসারে কাঁচের প্লেট খুব জরুরি। এই একটাই খারাপ অভ্যাস কাঁচের প্লেটে খাওয়া। ১৯৭৮ সালের ৮ই মে আব্দুল মতিন তার বাড়ির বারান্দায় ইজিচেয়ারে শুয়ে প্লেট ভাঙ্গার শব্দে আরও পেছন ফিরে যায়। মা-বাবার সংসাারে ছিল কাঁসার থালা। কাঁসার গন্ধটা তার সহ্য হয় না। আব্দুল মতিন খেয়েছে কড়ির প্লেটে। এখন নিজের সংসারে কাঁচের জিনিষের অবাধ বিচরণ। প্রতি মাসে দু’ একটা করে ভাঙলেও কড়ির প্লেট এই সংসারে জায়গা পায়নি। রুচিতে বড়ো বাধে। চাকুরি যাই হোক প্রেস্টিজ নিয়ে বড়ো বেশি মাথা ঘামায় এজি অফিসের কেরানি আব্দুল মতিন।
‘তিরিশটি টাকা বেরিয়ে গেল’এই দুশ্চিন্তাটা এখন তার মাথায় যোগ হলো। আগে হয়নি। গতকাল থেকে অনেক তুচ্ছ ব্যাপারকে সে বড়ো করে দেখছে। একদিন আগেও তার অস্তিত্ব জুড়ে ছিল সালেহা বেগম। প্লেট ভাঙ্গার পর এখন মনে হচ্ছে ওকে ভুলে যাওয়া উচিত। স্ত্রীর মূল্য তিরিশ টাকা ! আব্দুল মতিন হেসে ওঠে। এ হাসির অর্থ সে নিজেও বোঝে না।
‘আমরা ছিলাম ভাই-বোন মিলে এগারজন। সবার বড়ো হওয়ার কারণে দায়িত্বটা স্বভাবতই আমার বেশি হওয়ার কথা ছিল। কিন্তু আমি কি উদাহারণযোগ্য তেমন কোনও দায়িত্ব পালন করতে পেরেছি? মা-বাবাকে রেখে সালেহার সুখের জন্যেই তো আলাদা হলাম। আমার পছন্দকে তুচ্ছ করে বাবার কথামতো সালেহা বেগমকে বিয়ে করতে হয়েছে। অথচ ঐ সংসরে সালেহা নিজেকে মেলাতে পারেনি। আমি কি পেরেছি? ভীড়ের সংসারে সালেহাকে একান্তে পাওয়াই ছিলো দুর্লভ। আর পেলেও ঘানি টানার কারণে শুতে শুতে রাত এগারটা। দিনের পরিশ্রম ঘুমিয়েই সাবাড়। আমাদের দাম্পত্য ব্যাপারটা তাই সুখের ছিল না। আলাদা হওয়ার জন্য সালেহার আগ্রহ ছিলো প্রকাশ্য। আমারও কি ইচ্ছে ছিল না? উচিত-অনুচিত বিবেচনা না করে দু’বছরের মাথায় আমরা আলাদা হয়ে গেলাম। বাবা-মাকে নিয়মিত টাকা পাঠাই। পরামর্শটা সালেহারই। এখানেই সালেহার মহত্ত্ব। তা থাকুক। ঐ মহিলাকে আমি ভুলে থাকতে চাই।’ কোলের ছেলেটি কেঁদে উঠতেই আব্দুল মতিনের চিন্তায় ছেদ পড়ে। সালেহা নিশ্চয়ই ছেলেটাকে অকারণে শাসন করছে।
মন খারাপের কারণে গত রাতে সালেহার আহবানে সে সাড়া দেয়নি। পাশ ফিরে শুয়ে ছিলো। সালেহা কি কোনও কিছু আঁচ করতে পেরেছে? না হলে এই আমি কাঙালপনা যার অস্থি ও মজ্জায় সে কেন উল্টো দিকে থাকবে। মেয়েটি কত দিন থেকে তার সংসারে? সালেহাকে এখন আর সে স্ত্রী হিসেবে না দেখে বারবার মেয়েটি মেয়েটি হিসেবেই ভাবছে। হ্যা, বছর সাতেক হলো ওকে কলমা পড়িয়ে আমি নিয়ে এসেছি। যদিও পছন্দটি ছিল বাবার কিন্তু মেয়েটি কি বিয়ে পরবর্তী তার গুণপনায় আমার কাছে আকর্ষণীয় হয়ে ওঠেনি? গতানুগতিকের সংসারে মেয়েটির নিপুণ হাতের কাজ আমাকে কি আনন্দ দেয়নি? তাহলে গতকাল থেকে সে আমার কাছে বিস্বাদ হয়ে উঠলো কেন?
কাছের মসজিদে এশার অজান হচ্ছে। সালেহা এখন নামাজ পড়বে। আব্দুল মতিন আগেই জানিয়ে দিয়েছে রাতে কিছু খাবে না। কেন?Ñ এই প্রশ্ন সালেহা তোলেনি। শুধু একবার নিস্পৃহ চোখে তার দিকে তাকিয়েছিল। সকালে বাজার করা হয়নি, নিত্যদিনের শেভ করা হয়নি এবং সালেহার টুকটাক কোনও কথার জবাব দেয়া হয়নি।
আজ যে আমার একটা কিছু হয়েছে মেয়েটি নিশ্চয়ই তা আঁচ করতে পেরেছে। কিন্তু আশ্চর্য সামান্য কিছু হলেই আগের মতো তোমার কি হয়েছেÑ এরকম উৎকন্ঠা সূচক কোনও প্রশ্ন করেনি। হয়ত একান্ত ব্যক্তিগত কিছু হয়েছে যা স্ত্রীর কাছেও বলবার নয়। ব্যক্তিগত তো বটেই। গতকাল বিকেলে সাবিহার সাথে দেখা হলো নিউমার্কেটের গেটে। গাড়ি থেকে নামলো মোটামতো একটা লোকের হাত ধরে। লোকটি নিশ্চয় সাবিহার স্বামী। শুনেছি এই ভদ্রলোকটি বড়ো একজন ঠিকাদার। বিয়ের আগে ছিল সাব-কন্ট্রাকটার। সাবিহাকে পেয়ে পাঁচ বছরের মাথায় নাকি তার অসম্ভব উন্নতি। এখন প্রথম শ্রেণির ঠিকাদার। গাড়ি থেকে নামতেই ওর সঙ্গে আব্দুল মতিনের চোখাচোখি হয়ে যায়। ব্যর্থ প্রেমিকটি তখন ওর কাছকাছি হতেই সাবিহা তাকে ভ্রƒকুটি করে নিউমার্কেটের ভেতরে প্রবেশ করে। তখন থেকেই আব্দুল মতিনের মনে মেঘ জমতে শুরু করে। সাবিহা আমার সঙ্গে কথা বলল না কেন? স্বামীর কারণে? ওর স্বামী নিশ্চয়ই জানে না বিয়ের আগে কোথাকার কোন মতিনের সাথে সাবিহার প্রেম ছিলো। মেয়েরা বিয়ের পর কখনোই প্রেমের কথা স্বামীকে বলে না। এতদিন পরে দেখা। তাই বলে কথা বলবে না? ও সব সময়ই আমার চেয়ে সাহসী ছিল। এই মুহূর্তে বাঁকা চোখে ওভাবে তাকালো কেন? বিয়ের আগে চিঠিতে লিখেছিল, তুমি একটা কাপুরুষ। বাঁকা চাউনিটি কি ওই বাক্যটির প্রতিফলন?
আব্দুল মতিনের চিন্তার গভীরতার সাথে কি সুন্দর মিল রেখে জোৎস্না মিলিয়ে গিয়ে অন্ধকারে রূপ নিচ্ছে। একটু আগেও আকাশে চাঁদ ছিলো। এখন পুরোপুরি অন্ধকার। বৃষ্টি হবে নাকি? আসুক। বৃষ্টি অনেক কিছুই মুছে ফেলে। তার ব্যর্থ প্রেমের এপিসোড যা সে সাত বছর ভুলে ছিলো সাবিহাকে দেখে মনে হতে থাকে নানা কথা, অভিমান, খুনসুটিÑ কতো কি। বৃষ্টি হলেই ভাল। বৃষ্টিতে ভেসে যাক তার বিগত দিনের স্মৃতি। আকাশে মেঘ কিন্তু বৃষ্টির কোনও লক্ষণ নেই।
সাবিহা কেন আমার হলো না? দোষ তো আমারই। আমি কেন অবাধ্য হলাম না। বাবা দুঃখ পেতেন ঠিকই কিন্তু তা কদিনের জন্য। আব্দুল মতিন প্রেম-বিদ্রোহের অনেক ঘটনাই জানে। ওর এক সৈয়দ বংশের বন্ধুু শুধু পরিবারে নয় সমস্ত আত্মীয় স্বজনকে ক্ষেপিয়ে এক কুলীর মেয়েকে বিয়ে করেছিল। এক বছরের মাথায় যা ছিল আগে তাই। মেয়েটি যেমন রূপসী কাজে-কর্মে,কথা-বার্তায় সব কিছুতেই সবার মন জয় করে নেয় দ্রুতই। এ উদাহরণ থাকার পরও সে সাবিহার ভাষায় পুরুষ হতে পারেনি। আগ্রহটা সাবিহারই ছিলো বেশি। তখন আমি একেবারেই বেকার। সামান্য বি.এ পাশ। নানা কারণেই দীর্ঘ দিনের ভালেবাসা ব্যর্থ হয়ে যায়। এ ক্ষেত্রে মেয়েদের ভূমিকাই থাকে বেশি। কিন্তু আব্দুল মতিনের ব্যর্থতা ওর জন্যেই। সাবিহার বিয়ের পরপরই বাবার পছন্দ মতো সালেহাকে তিনি বাড়ির বড়ো বউ করে আনেন। যৌতুক হিসেবে আমার শ্বশুর একটি চাকুরি পাইয়ে দেন। তিনি ছিলেন এজি অফিসের পাওয়ারফুল বড়ো কেরাণি। তার মেয়ের জামাই থিতু হলো একই অফিসে।
আমি কি আসলেই কাপুরুষ? চারদিকে কি অন্ধকার। আমি বিদ্রোহী হলাম না কেন? কোথাও একটা তক্ষক ডেকে উঠলো। চাকুরিটা কি আমার ভীষণ জরুরি ছিলো? আকশের মেঘগুলো আরও ঘন হয়েছে। আব্দুল মতিন কবি নয়। পাঠ্য ছাড়া জীবনে এক লাইনও কবিতা পড়েনি। কবিদের কাছে আলো ও অন্ধকারের অর্থ নানারকম। এই মূহুর্তে অন্ধকার রাতটাকে আব্দুল মতিনের ভালো লাগতে শুরু করে। যদিও মনের মধ্যে সাবিহাই ঘুরপাক খাচ্ছে। হঠাৎ কাঁধে শীতল স্পর্শ অনুভব করে সে। আব্দুল মতিন ঘুরে দাঁড়ায়। অন্ধকারে কিছুই দেখা যাচ্ছে না। এক হলকা গরম নিঃশ্বাস বাড়ি খেলো তার পুরো মুখে। এ কার নিঃশ্বাস। সাবিহার কি? গরমটা ঐ রকমই। তবুও ব্যর্থ প্রেমিক কথা বলে না। ‘ঘরে চলো’Ñ সাবিহা নয়, সালেহার কণ্ঠ। এবার স্বামীটি চমকে ওঠে। অন্ধকারে পরোক্ষ সাবিহা খুবই স্পষ্ট কিন্তু প্রত্যক্ষ সালেহাকে দেখাই যাচ্ছে না। মেয়েটি কি ভেতরে প্রবেশ করলো? ‘এসো’Ñ সালেহা হাত ধরে তাকে আহবান করে। মন্ত্রমুগ্ধের মতো আব্দুল মতিন অন্ধকারে সালেহাকে অনুসরণ করে। ঘরেও আলো নেই। একটু ঝাপ্টা হলেই বিদ্যুৎ চলে যায়। হঠাৎ অন্ধকারেই ব্যর্থ প্রেমিক সালেহাকে জাপটে ধরে শব্দ করে বলে ওঠে, এতো দিন কোথায় ছিলে সাবিহা। ‘এই, আস্তে, খোকা জেগে ওঠবে‘Ñ আদুরে গলায় আব্দুল মতিনকে সাবধান করে দেয়। সাবিহা, আমার সাবিহা বলে আব্দুল মতিন সালেহার বুকে মুখ ঘষে। যথা সময়েই ওরা ক্লান্ত হয়। পরিতৃপ্তিতে সালেহা দ্রুতই ঘুমিয়ে পড়ে।
সালেহা ঘুমিয়ে পড়ল্ইে আকাশে আবার চাঁদ ওঠে। এত আলো! এত আলো! এ যে পরিপূর্ণ জোছনা। খোলা জানালা। জোছনার আলো এখন আব্দুল মতিনের বিছানায়। সালেহার দিকে সে একবার তাকায়। ঘুমুচ্ছে মেয়েটি। আর, তখনই কল্পনাপ্রবণ আব্দুল মতিনের মনে হলো সালেহাকে কি আমি সাবিহা বলে সম্বোধন করেছি? সাবিহা এপিসোড সালেহার জানার কথা নয়। তাহলে আমি কি ওর নামটিই উচ্চারণ করেছি? এ কারণেই নিত্যরাতের আনন্দে ওর র্নিদ্বিধা? সালেহার দিকে আব্দুল মতিন আবার তাকায়। ওর নিহঙ্গ শরীরটি ভারি সুন্দর। চাদর দিয়ে সালেহার শরীরটি ঢেকে দেয় সে। কিন্তু জোছনার চাদর সালেহার নিহঙ্গ শরীরকে দীপ্র করে তোলে। জীবনের এই প্রথম এজি অফিসের কেরাণি আব্দুল মতিন অন্ধকার এবং আলোর মধ্যে কোনও পার্থক্য খুঁজে পায় না।
অন্ধকারকে পাশে রেখে জোছনায় সাঁতার কেটে আবদুল মতিনের মন ভালো হয়ে যায়।
Leave a Reply