এস এম শাহনূর।।
“সুবেহসাদেক বলছে কিরে?
সেই দিন আর নেইতো দূরে।
ঈদে মিলাদুন্নবী(সাঃ) উদযাপিত হবে ঘরে ঘরে।।
মুল্ল্যা মৌলানাদের মাঝে রইবেনা গো আড়াআড়ি
ধরবে সবাই আহলে সুন্নাত ওয়াল জামায়াতের গাড়ি।।”
হাবীবে খোদা রাহমাতুলল্লিল অালামীন হুজুর অাকরাম (সাল্লাল্লাহু অালাইহে ওয়াসাল্লাম) হচ্ছেন সর্বযুগের সর্বকালের শ্রেষ্ঠতম অাদর্শ। অাল্লাহ পাক তাঁকে “সিরাজাম-মুনিরা”বা উজ্জ্বল প্রদীপরূপে প্রেরণ করতঃ’ওয়া রাফানা লাকা যিকরাকা'(আমি আপনার স্তুতিকে উচ্চ মর্যাদা দান করেছি) এর সুমহান তাজ পরিধান করিয়েছেন।তাই কারো পক্ষেই নবীজির সামান্যতম শানও বর্ননা করা সম্ভব নয়।বস্ততঃস্বয়ং অাল্লাহ তাঅালা প্রতিনিয়তই তাঁর মাহবুব সাল্লাল্লাহু অালাইহে ওয়াসাল্লাম এর উপর সালাত পাঠ করছেন।
إِنَّ اللَّهَ وَمَلَائِكَتَهُ يُصَلُّونَ عَلَى النَّبِيِّ يَا أَيُّهَا الَّذِينَ آمَنُوا صَلُّوا عَلَيْهِ وَسَلِّمُوا تَسْلِيمًا
আল্লাহ ও তাঁর ফেরেশতাগণ নবীর প্রতি রহমত প্রেরণ করেন। হে মুমিনগণ! তোমরা নবীর জন্যে রহমতের তরে দোয়া কর এবং তাঁর প্রতি সালাম প্রেরণ কর। [ সুরা আহযাব ৩৩:৫৬ ]
জ্বিন ইনসান ফেরেশতা তথা গোটা সৃষ্টিই তাঁর উপর দরূদ পেশ করছে অহরহ, সর্বত্রই তাঁর স্তুতি-তাঁর গীত।কুরঅানুল কারীমের শুরু হতে শেষ পর্যন্ত প্রতিটি হরফ অাল্লাহর পিয়ারা হাবীব সাল্লাল্লাহু অালাইহে ওয়াসাল্লাম এর মহান শানের জীবন্ত দলিল।অার তাই তো মা অায়েশা সিদ্দীকা রাদি অাল্লাহু অানহা ইরশাদ করেছেন,”কুরঅানই অাল্লাহর নবীর চরিত্র”।মাহবুবে খোদা সাল্লাল্লাহু অালাইহে ওয়াসাল্লাম এবং এ সুবিশাল মর্যাদার বিস্তৃতি ও ব্যাপকতার অনুভূতি যারা স্বীয় অাকিদা এর বিশ্বাসে গেঁথে নিতে পারেনি,তারা ঈমান এবং ইসলামের মজা পায়নি।পেতে পারেনা।এরা ঈমানের ক্ষেত্রে এতই বিপর্যস্ত যে,অনেক সময় তারা নূরনবী সাল্লাল্লাহু অালাইহে ওয়াসাল্লাম কে সাধারন মানুষের কাতারে এনে অবমূল্যায়ন করতেও দ্বিধাবোধ করেনা।অথচ হুজুর অাকরাম সাল্লাল্লাহু অালাইহে ওয়াসাল্লাম এর খাটি মুহাব্বত ও তাঁর মহান শানের উপলব্দিই হচ্ছে ঈমানের মূল কথা।
পবিত্র কুরঅানে অাল্লাহ পাক এরশাদ করেন,”অামি অাপনাকে সমগ্র বিশ্ব জগতের প্রতি রহমত রূপে প্রেরন করেছি।”(পারা-১৭,সুরা অাম্বিয়া,রুকু-৭)নবীগণ,রাসূলগণ ফেরেশতা এবং মুকাররাবিন প্রত্যেকেই প্রিয় নবী সাল্লাল্লাহু অালাইহে ওয়াসাল্লাম হতে রহমত প্রাপ্ত হয়েছেন। কাফিররাও সর্বোতভাবে তাঁর থেকে রহমত পেয়েছে।কিয়ামতে হাশরের ময়দানে হিসাব নিকাশ শুরু করা এবং নাজাত দেয়াও নবীজির ওসীলাতেই হবে।হুজুর পাক সাল্লাল্লাহু অালাইহে ওয়াসাল্লাম এর অাগমনে অানন্দ প্রকাশের কারনেই অাবু লাহাবের জন্য সোমবার দিন অাযাব সহজ করে দেয়া হয়েছে।নবীজির বরকতেই অাবু তালিবের উপর অাযাব কমিয়ে দেয়া হয়েছে।(হাদীস) এই নশ্বর জগতে তিনি রহমত।কিয়ামতে,মিযানে,হাউজে কাউছার,জান্নাতে,গুনাহগার উম্মতের জন্য জাহান্নামে বস্ততঃ সর্বত্রই তাঁর রহমত ব্যাপৃত।
হুজুর পাক সাল্লাল্লাহু অালাইহে ওয়াসাল্লাম কে প্রেরণের জন্য যুগে যুগে সমস্ত নবী ও রাসূলগণ প্রার্থনা করেছেন।তাঁর ওসীলায় অাদম অালাইহিস সালাম এর তওবা গৃহীত হয়।যাঁর অানুগত্য অাল্লাহর অানুগত্য এবং খোদা প্রাপ্তির পূর্বশর্ত বলে বিবেচিত হয়।যাঁকে অাল্লাহ পাক সতর্ককারী ও সুসংবাদ দাতা রূপে প্রেরন করেছেন।যাঁর অাগমনে তামাম মাখলুক অানন্দে মাতোয়ারা সেই নবীজির উম্মত হয়ে অামরা কেন অানন্দিত হবোনা।আমরা কেন খুশি প্রকাশ করবোনা।তবে অামাদের ভুলে গেলে চলবেনা যে অামরা শ্রেষ্ঠ নবীর শ্রেষ্ঠ উম্মত।তাই অবশ্যই ইসলামী নিয়ম নীতির মধ্যে থেকে অামাদের কে তা উদযাপন করতে হবে।
আজ বুধবার পবিত্র ঈদে মিলাদুন্নবী (সা.)। মহানবী হজরত মুহাম্মদ (সা.)-এর জন্ম ও ওফাত দিবস।দিনটি সমগ্র বিশ্বে মুসলমানদের কাছে অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ ও তাৎপর্যপূর্ণ। ৫৭০ খ্রিস্টাব্দে ২৯ আগস্ট, রবিউল আউয়াল মাসের ১২ তারিখ সোমবার, সূর্যোদয়ের ঠিক পূর্বমুহূর্তে, সুবহে সাদিকের সময় মহাকালের এক মহাক্রান্তিলগ্নে তিনি জন্মগ্রহণ করেন। আবার তেষট্টি বছরের এক মহান আদর্শিক জীবন অতিবাহিত করে ৬৩২ খ্রিস্টাব্দে ৮ জুন, ১১ হিজরি রবিউল আউওয়াল মাসের ১২ তারিখ একই দিনে তিনি পরলোক গমন করেন। দিনটি মুসলিম সমাজে ‘ঈদে মিলাদুন্নবী (সা.) নামে সমধিক পরিচিত। ঈদ, মিলাদ আর নবী তিনটি শব্দ যোগে দিবসটির নামকরণ হয়েছে।
ঈদ অর্থ- আনন্দোৎসব,
মিলাদ অর্থ- জন্মদিন
(সাইয়্যিদুল মুরসালীন,ইমামুল মুরসালীন,খাতামুন্নব্যিয়িন,নূরে মোজাসসাম হুযূর পাক ছল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম-এর ছানা-ছিফত করা ও তাঁর প্রতি ছলাত-সালাম পাঠ করা। অতএব, তা আল্লাহ পাক ও তাঁর রসূল হুযূর পাক ছল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম সহ সবারই সুন্নতের অন্তর্ভুক্ত।)
আর নবী অর্থ নবী বা ঐশী বার্তাবাহক।
তাহলে ঈদে মিলাদুন্নবীর অর্থ দাঁড়ায় নবীর জন্মদিনের আনন্দোৎসব।
১২ রবিউল আউওয়াল একই সাথে মহানবীর জন্ম ও মৃত্যু দিবস হলেও তা শুধু জন্মোৎসব হিসেবেই পালিত হয়। পৃথিবীর যেকোনো মানুষের মুত্যুই তাঁর পরিবার, সমাজ ও দেশের জন্য বিরাট শূন্যতা সৃষ্টি করে। কিন্তু
মহানবীর মৃত্যু মানবসমাজ ও সভ্যতার কোনো পর্যায়ে কোনো শূন্যতার সৃষ্টি করেনি। যদিও তাঁর মুত্যুর চেয়ে অধিক বেদনাদায়ক কোনো বিষয় উম্মতের জন্য হতে পারে না। তিনি প্রেরিত হয়েছিলেন সমগ্র পৃথিবীর জন্য আল্লাহর রহমত হিসেবে। এরশাদ হয়েছে, আমি আপনাকে সমগ্র বিশ্বের জন্য রহমত হিসেবে প্রেরণ করেছি । (সূরা আল-আম্বিয়া : ১০৭) এরশাদ হয়েছে, আজ আমি তোমাদের জন্য তোমাদের জীবন বিধানকে পরিপূর্ণ করে দিলাম, তোমাদের ওপর আমার নেয়ামতরাজিকে পূর্ণতা দিলাম আর ইসলামকে তোমাদের একমাত্র জীবন বিধান হিসেবে মনোনীত করলাম। (সুরা আল-মায়িদা ; ৩)
রবিউল আউওয়াল মাস এলে মুসলিম সমাজে মিলাদ মাহফিল ও সিরাত মাহফিল আয়োজনের ধুম পড়ে যায়। কিন্তু রাসুলুল্লাহ (সা.) যে আদর্শের সুষমা দিয়ে একটি বর্বর জাতিকে আদর্শ জাতি হিসেবে প্রতিষ্ঠিত করেছিলেন, জ্বলন্ত আগ্নেয়গিরির মতো ফুটতে থাকা একটি সমাজকে শান্তির সুশীতল ছায়াতলে এনে দিয়েছিলেন; সেই মহান আদর্শে উত্তরণের কোনো চিহ্ন খুঁজে পাওয়া যায় না। মহানবীর আদর্শ অনুসরন না করে শুধু মিলাদ মাহফিল আর সিরাত মাহফিল আয়োজনে কোনো লাভ নেই। কারণ মহান আল্লাহ রাসুলুল্লাহ (সা.)-এর আদর্শকে জীবনে ধারণ করার নির্দেশ দিয়েছেন। এরশাদ হয়েছে, ‘হে রাসুল! আপনি বলে দিন, যদি তোমরা আল্লাহকে ভালোবেসে থাক তাহলে আমাকে অনুসরণ করো, আল্লাহ তায়ালা তোমাদের ভালোবাসবেন এবং তোমাদের গুনাহগুলো ক্ষমা করে দেবেন। আর আল্লাহ পরম ক্ষমাশীল, অসীম দয়ালু। (সুরা আল-মায়িদা : ৩১) রাসুলুল্লাহ (সা.) চারিত্রিক শ্রেষ্ঠত্বের মাধ্যমেই একটি শ্রেষ্ঠ জাতি গঠন করেছিলেন। হজরত আব্দুল্লাহ ইবনে আমর (রা.) বর্ণনা করেছেন, রাসুলুল্লাহ (সা.) বলেছেন নিশ্চয়ই আমি সর্বোত্তম চরিত্রের পূর্ণাঙ্গতা সাধনের জন্য প্রেরিত হয়েছি। (ইবনে মাজা) রাসুলুল্লাহ (সা.)-এর আদর্শ ধারণ করেই সাহাবায়ে কেরাম (রা.) যুগের সর্বোত্তম মানুষ হতে পেরেছিলেন। হযরত আব্দুল্লাহ ইবনে মাসউদ (রা.) বর্ণনা করেছেন, রাসুলুল্লাহ (সা.) বলেছেন : সর্বোত্তম মানুষ হলো আমার যুগের মানুষ, অতঃপর তাদের পরবর্তী যুগের মানুষ, তারপর তাদের পরবর্তী যুগের মানুষ। (সহীহ বোখারি)
আল্লাহপাক বলেন ” নিশ্চয় আমি এবং
আমার ফেরেশতাগন আমার হাবিবের প্রতি দরুদ পেশ করে থাকি, সুতরাং মু’মিনগন তোমরাও বেশি করে তাঁর ওপরে দরুদ শরীফ পেশ করো ও আদবের সাথে( বার বার ) তাঁকে সালাম দাও।”( সূরা আহযাব-৫৬,) মহান আল্লাহপাকের হুকুম মানা ফরজ বলেই পবিত্র কুরআন শরীফে ” তোমরা ঈমান আনয়ন করো,নামাজ আদায় করো, যাকাত দাও, রোযা রাখ, সামর্থ থাকলে হজ্জ আদায় করো ” ইত্যাদি হুকুমের কারণে উল্লেখিত বিষয়গুলো মুসলিমদের জন্য পালন করা যদি ফরজ হয়ে থাকে তাহলে সেই আল্লাহপাকেরই হুকুম ” হে ঈমানদারগন তোমরা আমার নবীর ওপরে ( বেশি করে )দরুদ শরীফ পেশ করো এবং আদবের সাথে
তাঁকে (বার বার) সালাম দাও।” (সূরা আহযাব ৫৬)। এই হুকুম পালন করাও মুমিনদের জন্য কি হবে? বিবেক সম্পন্ন পাঠক গণ চিন্তা করুন।অাসুন এই দিনে এবং সদা সর্বদা বেশী বেশী অাল্লাহর জিকির ও দয়াল নবীজির প্রতি দরূদ পাঠ করি।
আমিন। আমিন।ছুম্মামিন।
লেখক: এস এম শাহনূর
কবি ও গবেষক।
Leave a Reply