– দীপক সাহা ( পশ্চিমবঙ্গ)
একটি অসাধারণ ইংরিজি বাক্য আন্তর্জাল-পরিসরে প্রায়শই ঘুরে বেড়াতে দেখা যায়, যার বাংলা তর্জমা মোটামুটি এইরকম হতে পারে— ‘ধর্ম হল অজ্ঞ জনসাধারণের কাছে পরমসত্য, জ্ঞানী পণ্ডিতের কাছে মিথ্যা কুসংস্কার, আর শাসকের কাছে শাসনের জবরদস্ত হাতিয়ার।’ শোনা যায় কথাটা নাকি বলেছিলেন প্রাচীন রোমান আইনজ্ঞ সেনেকা।ধর্ম বিষয়ে ওর চেয়ে সত্যি কথা বোধহয় খুব কমই আছে। মানুষকে নিয়ন্ত্রণ করে নির্দিষ্ট উদ্দেশ্যসিদ্ধির ব্যাপারে ধর্মের কার্যকারিতার কথা প্রাক-খ্রিস্টীয় ভারতের ‘কৌটিল্যের অর্থশাস্ত্র’ থেকে শুরু করে পঞ্চদশ শতকীয় ইউরোপের রাজনীতিতত্ত্ববিদ মাখিয়াভেল্লির ‘দ্য প্রিন্স’ পর্যন্ত অনেক গ্রন্থেই উচ্চারিত হয়েছে। প্রতারণা, হিংস্রতা, ঘৃণা আর গুরুগম্ভীর মিথ্যাকে সম্বল করে মানুষকে বশ্যতা স্বীকার করানোর জন্য ধর্মের চেয়ে ভাল হাতিয়ার পাওয়া মুশকিল। উপমহাদেশে ধর্ম আজও জড়িয়ে রয়েছে সমাজ-রাজনীতি-প্রশাসন-সংস্কৃতির অলিতে গলিতে।
ভারতে জাতীয় স্তরে যখন চলছে আশারাম-রামদেব-রামরহিমের মত ধর্মীয় রাঘব-বোয়ালদের খেলা, তখন শহরে ও গ্রামে বাবাজি-মাতাজি-তান্ত্রিক-ওঝা-গুণিন-জ্যোতিষীদের হাতে প্রতিদিনই লুণ্ঠিত হচ্ছে অসহায় বিশ্বাসী মানুষের সম্পদ, সম্মান ও নিরাপত্তা। ভারতবর্ষের আনাচে কানাচে এখনও ধর্মীয় কুসংস্কারের বেড়াজাল ছড়িয়ে আছে। ধর্মের মোড়কে চলে অমানবিক নৃশংস প্রথা। সেই রকম একটি অমানবিক প্রথার ভয়ালরূপ চুরাল মুরিয়াল।
মার্চ মাসের পুণ্য তিথিতে কেরালার মন্দিরে অনুষ্ঠিত হয় উৎসব। ভিড় জমায় বহু মানুষ। সেখানেই একটি শিশুকে ঘিরে থাকেন পূজারীরা। শিশুটির গায়ে মালা, রং-বেরঙের বেশভুষা, কপালে তিলক। তাকেও বোধহয় পুজো করা হবে। ঠিক এখানেই ভুল হয়ে গেল। না, বাচ্চাটিকে পুজোর জন্য তৈরি করা হয়নি। বরং তাকে তৈরি করা হচ্ছে উৎসর্গের জন্য। যে উৎসর্গে ‘তুষ্ট’ হবেন ভগবান! সূচ দিয়ে এফোঁড়-ওফোঁড় শিশুর বুক, ২৫০ বছরের পুরনো প্রথা আজও চালু। একবিংশ শতকের ভারতে দাঁড়িয়ে আজও ভয়ংকর বাস্তব এটি। আর এই প্রথাটি পালিত হচ্ছে কোন রাজ্যে জানেন? কেরালা, ভারতের মধ্যে যে রাজ্যে শিক্ষিতের হার সবচেয়ে বেশি!
মার্চ মাস নাগাদ কেরালার চেট্টিকুলাঙ্গারা মন্দিরে আয়োজিত হয় ‘কুম্ভ ভারানি’ উৎসব। দক্ষিণের কুম্ভ মেলা বলা হয় যাকে। সেই উৎসবেরই একটি অংশ হল চুরাল মুরিয়াল। প্রায় ২৫০ বছর ধরে চলে আসছে এই প্রথা। বেশ ধার্মিক আবরণ থাকলেও, এই প্রথাটির ভেতরেই লুকিয়ে আছে বীভৎসতা।
দেবী ভদ্রকালীকে ‘সন্তুষ্ট’ করার জন্য ৮ থেকে ১৪ বছরের শিশুর রক্ত ‘বলি’ হিসেবে ব্যবহার করা হয়। সেই রক্তে নাকি দেবীও ‘প্রসন্ন’ হন, আর যে পরিবার তাদের সন্তানকে বলির জন্য পাঠাচ্ছে, তাদেরও মঙ্গল হয়!
ঘটনা এখানেই শেষ নয়। দেখা গেছে, এই পুজো যাঁরা করে থাকেন তাঁদের মধ্যে অনেকেই ধনী পরিবারের। আরও আশ্চর্যের বিষয়, তাঁরা নিজের পরিবারের কাউকে এই বলির জন্য পাঠায় না। এর জন্যও তৈরি হয়েছে আলাদা একটি ‘প্রথা’। গরিব পরিবারগুলো থেকে তাঁদের ঘরের ছেলেকে দত্তক নেন তাঁরা। বিনিময় ওই পরিবার পায় কয়েক লাখ টাকা। তাঁরাও চুপ থাকেন। কুম্ভ ভারানি’র আগে থেকেই ওই বাচ্চাকে নাচের প্রশিক্ষণ দেওয়া হয়। কয়েক সপ্তাহ তাকে নিরামিষ খাবার খেতে দেওয়া। উৎসবের চরম মুহূর্তে, তাকে রীতিমতো রাজার পোশাকে বাজনা সহযোগে বর্ণাঢ্য শোভাযাত্রায় নিয়ে যাওয়া হয় মন্দিরে।
এক ঝলক দেখে মনে হবে, বোধহয় পুজো করা হবে শিশুটির। কিন্তু তখনই শুরু হয় আসল খেলা। বাচ্চাটির পাঁজরে গেঁথে দেওয়া হয় সূচ। তাতে পড়ানো থাকে সোনার সুতো। সেই অবস্থাতেই হাঁটিয়ে চেট্টিকুলাঙ্গারা মন্দিরের দিকে নিয়ে যাওয়া হয় তাদের। বাচ্চাদের আর্তনাদ, চিৎকার, বাঁচার আকুতি ঢেকে যায় ‘ভক্ত’দের শ্লোগান আর বাঁশির আওয়াজে। মন্দিরে পৌঁছনোর পর, দেহ থেকে ওই সূচ-সুতো বের করে নেওয়া হয়। ওই বাচ্চাদের রক্তে তুষ্ট করা হয় দেবতাকে। তাতেই ‘সন্তুষ্ট’ তিনি…
হ্যাঁ, এখনও এই বর্বর প্রথাটি চলে আসছে। বন্ধ করার চেষ্টা চলেছে প্রচুর। ২০১৬ সালে চুরাল মুরিয়ালকে নিষিদ্ধ ঘোষণা করে কেরালা স্টেট কমিশন ফর প্রোটেকশন অফ চাইল্ডস। কেরালা হাইকোর্টও এই প্রথাকে সম্পূর্ণ নিষিদ্ধ ঘোষণা করে। কিন্তু কোথায় কি! সে সব নিষেধাজ্ঞায় কোনো পাত্তাই দিচ্ছেন না মন্দির কর্তৃপক্ষ। পাত্তা দিচ্ছে না ধর্মপ্রাণ মানুষগুলোও। ২৫০ বছরের এই প্রথা বন্ধ হয়ে গেলে যদি দেবী রুষ্ট হন! স্থানীয় সংবাদমাধ্যমও এই নিয়ে প্রায় চুপ। মন্দির কর্তৃপক্ষের ক্ষমতা নাকি অনেক। অভিযোগ সেই সঙ্গে জড়িয়ে আছে রাজনৈতিক দলের নেতারাও। কাজেই, ওসব আদালত, নিয়মকে বুড়ো আঙুল। নিয়ম চলছে নিয়মের মতো। আর ভুগছে গরীব বাচ্চারা।
চুরাল মুরিয়ালে যে বাচ্চারা একবার ভগবানের উদ্দেশ্যে নিবেদিত হয়ে যায়, তাদেরই পরে সমাজ থেকে একপ্রকার ব্রাত্য করে রাখা হয়। তখন নাকি তারা ‘অশুভ’। সারাটা জীবন এই তকমা নিয়ে কাটাতে হয় তাদের। এইভাবেই শেষ করে ফেলা হয় একাধিক শৈশব।
Leave a Reply