ড. মোহাম্মদ শামসুল আলম।।
নওগাঁ জেলার ধামইরহাট উপজেলার অধীন সীমান্তবর্তী অঞ্চল আগ্রাদ্বিগুণ বাজারে একটি ইউনিয়ন পরিষদের কার্যালয় আছে। এই কার্যালয়ের গাঁ ঘেষে আগ্রাদ্বিগুণ বাজারের অভ্যন্তরে অবস্থিত নিজ দল বাড়ির দ্বিতল ভবনে প্রায় ১ হাজার ২০০ বর্গফুট স্থান নিয়ে চিত্তাকর্ষক ও নান্দনিক সৌন্দর্যের সমারোহে ব্যক্তিগত উদ্যোগে একটি গ্রন্থাগার প্রতিষ্ঠা করা হয়েছে। এটি প্রতিষ্ঠা করেন মো. আলমগীর কবির নামের একজন শিক্ষানুরাগী ব্যক্তি। এলাকার যুবক ও তরুণসহ সর্বস্তরের মানুষকে বই পড়ার প্রতি আগ্রহ সৃষ্টি করার প্রেষণা এবং মানবিক মানুষ গড়ে তোলার নিমিত্তে এমন উদ্যোগ গ্রহণ করা হয়েছে। এটির প্রতিষ্ঠাতা আলমগীর কবির ঢাকায় একটি আন্তর্জাতিক পর্যায়ের গবেষণা প্রতিষ্ঠানে কর্মরত। বাংলাদেশ পরিবেশ আন্দোলনের কেন্দ্রীয় যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক ও ‘গ্রিন ভয়েস বাংলাদেশে’র প্রতিষ্ঠাতা আলমগীর কবির পরিবেশবিদ হিসেবেও সুপরিচিত। তাঁর পিতা বীর মুক্তিযোদ্ধা মো. মজিবুর রহমান ছিলেন আগ্রাদ্বিগুণ ইউনিয়ন পরিষদের তিনবারের নির্বাচিত চেয়ারম্যান। প্রায় ১৭ বছর ধরে তিনি ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান হিসেবে দায়িত্ব পালন করেছেন। এই ইউনিয়নটি ৪৬টি গ্রামের সমন্বয়ে গঠিত।
ইউনিয়নের প্রতিটি গ্রাম থেকে ২/৩ জন করে মোট ২৪০ জনের একটি টিম গঠন করা হয়েছে। এই টিমটি স্থানীয়ভাবে ‘পরিবেশ বন্ধু’ নামে পরিচিত লাভ করেছে। এই টিমের সদস্যবৃন্দ পাঠাগার থেকে বই নিয়ে বিভিন্ন গ্রামে গিয়ে বই পৌঁছে দেন, এর পর সেসব বই পড়া শেষ হলে পুনরায় গ্রন্থাগারে জমা দিয়ে আবার নতুন বই নিয়ে যান। এভাবেই চলে স্থানীয় গ্রামগুলোতে পাঠচক্রের কার্যক্রম। আলমগীর কবির তাঁর পিতার নামানুসারে গ্রন্থাগারটির নামকরণ করেন ‘মজিবুর রহমান স্মৃতি গ্রন্থাগার’। ২০১০ খ্রিষ্টাব্দে তাঁর পিতার মৃত্যুর পর চারপুত্রের মিলিত উদ্যোগে তৈরি করা হয় ‘মজিবুর রহমান ফাউন্ডেশন’। এই ফাউন্ডেশনের চেয়ারম্যান হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন তাঁর তৃতীয় পুত্র ও গ্রন্থাগারের প্রতিষ্ঠাতা আলমগীর কবির। এই ফাউন্ডেশনের উদ্যোগে ২০১৫ খ্রিষ্টাব্দ থেকে গরিব ও অসহায় শিক্ষার্থীদের মাঝে বৃত্তি প্রদানসহ বিভিন্ন সামাজিক কর্মকাণ্ডের মধ্য দিয়ে শুরু হয় পথচলা। এরই সূত্রে গড়ে তোলা হয়েছে প্রায় ১০ হাজার বই নিয়ে ‘মজিবুর রহমান স্মৃতি পাঠাগার’। দেশবিদেশের কালজয়ী বই এই গ্রন্থাগারে স্থান পেয়েছে। পাঠাগারে দেশবরেণ্য অনেক ব্যক্তিবর্গ গ্রন্থ দান করে সহযোগিতা করেছেন। এমন মহৎ মানুষের তালিকায় আছেন বাংলাদেশের বিশিষ্ট প্রাবন্ধিক, গবেষক, কলামিস্ট, সাংবাদিক ও প্রয়াত লেখক সৈয়দ আবুল মকসুদ, বাংলাদেশের সামজিক সংগঠন বিশ্বসাহিত্য কেন্দ্রের প্রতিষ্ঠাতা আবদুল্লাহ আবু সায়ীদ, বাংলাদেশের প্রথম প্রধানমন্ত্রী শহীদ তাজউদ্দীন আহমদের মেয়ে সিমিন হোসেন রিমি, দেশবরেণ্য স্থপিত মোবাশ্বের হোসেন, স্থপতি ইকবাল হাবীব, সমাজকর্মী রিনা খানম, বিশিষ্ট সাংবাদিক শুভ কিবরিয়াসহ প্রমুখ মান্যবর ব্যক্তি। পাঠাগারটি ২০২০ খ্রিষ্টাব্দের আগস্ট মাসে তৈরির কার্যক্রম শুরু হয়। আর একই বছরের ডিসেম্বর মাস থেকে সর্বসাধারণের জন্য বই পড়ার ব্যবস্থা সম্পূর্ণরূপে উন্মুক্ত করা হয়। সকাল ৮টা থেকে রাত ৮টা পর্যন্ত সার্বক্ষণিক উন্মুক্ত থাকে বই পড়ার কার্যক্রম।
প্রত্যন্ত অঞ্চলের এই ইউনিয়নটিতে রয়েছে প্রাথমিক, মাধ্যমিক, উচ্চমাধ্যমিক এবং মাদ্রাসা পর্যায়ের বিভিন্ন স্তরের বেশকিছু শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান। করোনার প্রকোপে যখন বিশ্বের যাবতীয় কর্মকাণ্ডে ছন্দপতন দেখা দেয়, ঠিক সে সময়ে শুরু হয় গ্রন্থাগারটির পদযাত্রা। মূলত জ্ঞানের দ্যুতি ছড়ানোর নিমিত্তে এটি প্রতিষ্ঠা করা হয়। আগামী প্রজন্মকে মাদকের ভয়াবহতা থেকে বিরতে রাখতে ও সর্বস্তরের মানুষের মধ্যে জ্ঞানের আলো ছড়িয়ে দিতে স্থাপন করা হয় এই পাঠাগারটি। এটি স্থাপিত হওয়ার পর থেকে এলাকায় বেশ সাড়া ফেলেছে। স্থানীয় ছাত্র-শিক্ষক ও নানা শ্রেণি-পেশায় যুক্ত বইপ্রেমী মানুষের আনাগোনা ও ভিড় পরিলক্ষিত হয় পাঠাগারটিতে। সেখানে বঙ্গবন্ধু ও মুক্তিযুদ্ধবিষয়ক কর্নারসহ ক্রীড়া ও শিশুবিষয়ক কর্নার রয়েছে। পাঠাগারের উদ্যোক্তা জানান- ‘ক্রীড়াবিষয়ক কর্নারের যাবতীয় ব্যয়ভার বহন করবেন ঢাকার একটি বেসরকারি গবেষণা প্রতিষ্ঠানে কর্মরত শফিকুর রহমান শুভ।’ গ্রন্থাগারটির নকশা ও ডিজাইন প্রণয়ন করেছেন বাংলাদেশের বিশিষ্ট স্থপতি ইকবাল হাবিব। যিনি রাজধানী ঢাকার হাতিরঝিল প্রকল্পের ডিজাইন ও নকশা প্রণেতা। ভবনসহ গ্রন্থাগারটি যে আঙ্গিকে নির্মাণ করা হয়েছে তা দেখলে আনন্দ ও বিস্ময়ে অভিভূত হতে হয়। গ্রন্থারগার প্রতিষ্ঠার বিষয়টি জেলার সর্বস্তরের মানুষের মধ্যে কৌতূহলের সৃষ্টি করেছে কেবল তাই নয়; বরং সচেতন মহলেরও নজর কেড়েছে।
জেলাশহর নওগাঁ থেকে প্রায় ৬৫ কিলোমিটির পশ্চিম-উত্তরে, ধামইরহাট উপজেলা থেকে প্রায় ১৮ কিলোমিটার পশ্চিমে, নজিপুর-সাপাহার সড়কের মধ্যবর্তী স্থান মধইল বাজার থেকে প্রায় ১১ কিলোমিটার উত্তরে এবং সাপাহার উপজেলা সদর থেকে প্রায় ১৩ কিলোমিটার উত্তরপূর্ব দিকে গ্রন্থাগারটির অবস্থান। যে- কোনো পরিবহণযোগে বর্ণিত এসব সড়কপথে গ্রন্থাগারটিতে অনায়াসে গমনাগমন করা যায়। গ্রন্থাগারটি প্রত্যন্ত অঞ্চলে হলেও সেখানে আধুনিক সুযোগ সুবিধার প্রায় সব উপকরণ রয়েছে। মানুষ গড়ার প্রত্যয় নিয়ে গ্রন্থাগারটি স্থাপিত হয়েছে। পাঠাগারটির বয়বে দেখা যায় দেওয়ালে নানা আঙ্গিকের মনোরম চিত্র অঙ্কন করা আছে। তবে যেসব চিত্র প্রতীকী অর্থে ব্যবহার করা হয়েছে সেগুলোর মধ্যেও আছে শিক্ষণীয় বিষয়। আধুনিক নানা রংবেরঙের বাতি ও নান্দনিক সজ্জায় সজ্জিত করা হয়েছে উত্তর-দক্ষিণে লম্বা আকৃতির বিশাল অবয়বের প্রশস্ত কক্ষটিতে। বুকসেলফে তাকে তাকে শৈল্পিক উপায়ে সাজানো আছে বইয়ের সম্ভার। গ্রন্থাগারের অভ্যন্তরে অবস্থিত সেমিনার কক্ষে আছে ইন্টারনেট সংযোগসংবলিত বিশেষ সুযোগ সুবিধা ও মালিন্টমিডিয়া প্রজেক্টরসহ কম্পিউটার সামগ্রী।
গ্রন্থাগারটি একনজর দেখার জন্য জেলার পাশাপাশি বিভিন্ন জেলা থেকে বইপ্রেমী মানুষ এসে তা দেখে মুগ্ধ হয়ে পড়েন। পরিকল্পিত উপায়ে গড়ে তোলা পাঠাগারটির ভিতরে একবার প্রবেশ করলে মন জুড়িয়ে আসে। শীতাতপ নিয়ন্ত্রিত পাঠাগারটির বুকসেলফ, টেবিল ও অন্যান্য উপকরণ বেশ উন্নতমানের। কোনোভাবে যদি একবার এটির ভিতরে প্রবেশ করেন তাহলে সহজে আর ফেরা সম্ভব নয়। কারণ এটির পরিবেশ আপনাকে সহজে আপ্লুত করে দিবে। একটি সমৃদ্ধ পাঠাগারে যেভাবে বই, পেপার-পত্রিকা, ম্যাগাজিন, জার্নাল স্তরে স্তরে সাজানো থাকে, এখানেও তার ব্যতিক্রম নেই। বিশেষত মাল্টিমিডিয়া প্রজেক্টরের মাধ্যমে শিক্ষামূলক নানা অনুষ্ঠানের আয়োজন গ্রন্থাগারের অনন্য সংযোজনা। গ্রন্থাগারে বসে প্রায় পঞ্চাশজন মানুষ একই সাথে অনুশীলন করতে পারে। পাঠাগারের প্রতিষ্ঠাতা আলমগীর কবির জানান- ‘জ্ঞানভিত্তিক সমাজব্যবস্থা ও একজন মানবিক মানুষ গড়ে তোলার ক্ষেত্রে পাঠাগারের বিকল্প নেই। জ্ঞানচর্চার অভাবে সমাজে প্রগতিশীল চিন্তাধারার মানুষের বড়োই অভাব। আগামী সমাজব্যবস্থা হবে জ্ঞান নির্ভর। তাই এসব চিন্তাধারা থেকে মানুষের মাঝে জ্ঞানের আলো ছড়িয়ে দিতে এমন উদ্যোগ নিয়েছি।’ যুগে যুগে এবং কালে কালে কিছু মানুষ জন্মগ্রহণ করেন যাঁদের জন্মের কারণে সমাজব্যবস্থায় নতুনত্ব সৃষ্টি হয়। তাঁরা সমাজে পরিবর্তন আনয়নের নিমিত্তে শত বাধাবিপত্তিকে উপেক্ষা করে উপহাসকে পুরস্কারস্বরূপ উপহার দেন, তেমনই কাজ করেছেন সমাজকর্মী আলমগীর কবির।
গ্রন্থাগারটির উদ্যোক্তা আলমগীর কবির কেবল পাঠাগারটি স্থাপন করেই থেমে থাকেননি। বই পড়ার জন্য উৎসাহ প্রদানের নিমিত্তে বিভিন্ন পরিকল্পনাও গ্রহণ করেছেন। পরিকল্পনার অংশ হিসেবে বই পড়ে রচনা লেখা, কুইজ প্রতিযোগিতা, গ্রন্থ সমালোচনা, পাঠ পর্যালোচনা, বইমেলার আয়োজন, ইংলিশ অলিম্পিয়াড, গণিত অলিম্পিয়াড-সহ পাঠচক্রের আয়োজন চলে প্রায় নিয়মিতভাবে। এসব আলোচনাচক্র ও অনুশীলন পর্বে উপস্থিত থাকেন দেশবিদেশের খ্যাতনামা কবি-সাহিত্যিকগণ। এছাড়াও এলাকার স্কুলকলেজ ও মাদ্রাসার ছাত্রছাত্রীরা গ্রন্থাগার থেকে বই এনে যথাসাধ্য পড়তে পারে। গ্রন্থাগারের বই অনুশীলনের জন্য কোনোরকম ফি দিতে হয় না। বলা চলে আমাদের দেশের ছেলেমেয়েরা পাঠ্য বইয়ের বাইরে অন্য কোনো বই পড়তে চায় না। অথচ একজন মানবিক মানুষ বা সুশীল সমাজের প্রতিনিধি হতে চাইলে শিল্প-সাহিত্য চর্চা ও সংস্কৃতির অনুশীলন ব্যতীত ভালোমানুষ হওয়ার বিকল্প কোনো পথ নেই। কোনো মানুষ যদি নিয়মিত বই পড়েন তাহলে সে মানুষের মধ্যে বোধ ও চেতনায় নিঃসন্দেহে পরিবর্তন আসে। আর এই পরিবর্তনের ফলে একজন মানুষ সত্যিকার অর্থে মানবিক হতে পারেন।
ইন্টারনেটের যুগে মানুষ যখন ফেসবুক ও ইউটিউব নিয়ে ব্যস্ত, সে সময় উদ্যোক্তা আলমগীর কবির গড়ে তুলেছেন জ্ঞান আহরণের এই দীপশিখা। পাঠাগারটি তদারকির জন্য ফুল টাইম একজন গ্রন্থাগারিক ও একজন পরিচ্ছন্নতা কর্মীও নিযুক্ত আছে। গ্রন্থাগারের উদ্যোক্তা আলমগীর কবিরকে গ্রন্থাগার বিষয়ে আর কোনো ভবিষ্যৎ কর্মপরিকল্পনা আছে কি-না তা জানতে চাইলে তিনি আমাকে (লেখককে) জানান-‘পরবর্তী কর্মপরিকল্পনা হলো আলোকিত মানুষ গড়ে তোলার জন্য জেলার প্রতিটি ইউনিয়নে একটি করে এই গ্রন্থাগারের শাখা স্থাপন করা এবং সর্বস্তরের মানুষের মধ্যে বই সরবরাহ করে বইপড়ার অভ্যাস গড়ে তোলার প্রচেষ্টা অব্যাহত রাখা।’ বইয়ের জন্য মানুষ পড়তে পারেন না-এমন বিষয়ের অভাব তিনি দূর করতে চান তাঁর ভবিষ্যৎ কর্মপরিকল্পনার মধ্য দিয়ে। তাই বলতে হয় মানুষের মাঝে জ্ঞানের আলো ছড়িয়ে দিতে গ্রন্থাগারের উদ্যোক্তা আলমগীর কবির একটি অনুকরণীয় দৃষ্টান্ত স্থাপন করেছেন।
কবি, গবেষক, প্রাবন্ধিক, ইতিহাসজ্ঞ
এবং
সহযোগী অধ্যাপক ও বিভাগীয় প্রধান, বাংলা বিভাগ, নওগাঁ সরকারি কলেজ, নওগাঁ
Leave a Reply