এস এম শাহনূর
বাংলা সাহিত্যে একমাত্র বাঙালি নোবেলজয়ী সাহিত্যিক রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর। তাঁর চট্টগ্রাম ভ্রমণের সাথে জড়িয়ে আছে বন্দর নগরীর দুটি বাড়ি। একটি-
জেনারেল হাসপাতাল পাহাড়ের উত্তর দিকের কমলকান্ত সেনের দ্বিতল বাড়ি
এবং অপরটি নগরীর পার্সিভিল হিলের ‘দি প্যারেড’ নামের বাড়িটি।
চট্টলার প্রথম থিয়েটার হল – সদরঘাট এলাকার কমলবাবুর থিয়েটার (অধুনালুপ্ত লায়ন সিনেমা হল), এবং চট্টগ্রাম পুরাতন রেল স্টেশন- বটতলী স্টেশন।পরিতাপের বিষয় বটতলী রেল স্টেশন ছাড়া বাকীগুলোর কোনো অস্তিত্বই এখন আর নেই। এত এত বছরেও তার পদধূলিতে ধন্য স্থানগুলোতে গড়ে উঠেনি কোনো স্মৃতি চিহ্ন,নেই কোনো স্মৃতি স্মারক।
১৯৯৫ সালে চট্টগ্রাম থেকে প্রকাশিত দৈনিক আজাদীর ৩৫তম বর্ষপূর্তিতে ‘হাজার বছরের চট্টগ্রাম নামক সংকলনে লেখা হয়েছে, “রবীন্দ্রনাথ দুদিনের সফরে চট্টগ্রামে এসেছিলেন ১৯০৭ সালের ১৭ জুন সোমবার। তার সফর সঙ্গী ছিলেন ভাইপো সুরেন্দ্রনাথ ঠাকুর ও বন্ধু কেদারনাথ দাশগুপ্ত।”২
বরিশাল সফর শেষে কবি ভ্রাতুষ্পুত্র সুরেন্দ্রনাথ ঠাকুর (১৮৭২-১৯৪০), কেদারনাথ দাশগুপ্ত (১৮৭৮-১৯৪২) প্রমুখকে সাথে নিয়ে ১৭ জুন ১৯০৭ তারিখ সকালে চট্টগ্রাম রেলওয়ে স্টেশনে এসে পৌঁছেন।
“রবীন্দ্রনাথের চট্টগ্রাম আসার উদ্দেশ্য ছিল বঙ্গীয় সাহিত্য পরিষদের শাখা খোলার জন্য চট্টগ্রামের কবি সাহিত্যিকদের উৎসাহিত করা ও সুহৃদ যামিনীকান্ত সেনের আমন্ত্রণ রক্ষা।”২
কবি সংবর্ধনার অন্যতম উদ্যোক্তা (যামিনীকান্ত সেনের পিতা) সাংস্কৃতিক ব্যক্তিত্ব উকিল কমলাকান্ত সেন মারা যান ১৯০৬ সালে। তাঁর প্রতি কবিমনে শ্রদ্ধাবোধ জাগ্রত হওয়ায় কবিকে চট্টগ্রাম আসতে আরো বেশি আবেগতাড়িত ও অনুপ্রাণিত করেছিল।
রবীন্দ্রনাথকে চট্টগ্রামে অভ্যর্থনা কমিটির প্রধান যামিনীকান্ত সেন ছিলেন চট্টগ্রাম হিতসাধনী সভার অন্যতম প্রতিষ্ঠাতা।কলকাতা হাই কোর্টের উকিল।পরে শান্তিনিকেতনে শিক্ষকতা করেন।
‘রবীন্দ্র ভুবনে বাংলাদেশ’ এ উল্লেখ আছে, “রবীন্দ্রনাথের আগমন উপলক্ষে চট্টগ্রাম রেল স্টেশন কর্তৃপক্ষকে অনুরোধ করে ত্রিপুরাচরণ চৌধুরী ও কাজেম আলী মাস্টার প্রমুখের উদ্যোগে রেল স্টেশনটি ফুল ও পাতা দিয়ে সাজানো হয়। স্টেশন থেকে ঘোড়ার গাড়িতে করে কবিকে জেনারেল হাসপাতালের পাহাড়ের উত্তর দিকে যামিনীকান্ত সেনের বাবা কমলাকান্ত সেনের দুইতলা বাড়িতে নিয়ে যাওয়া হয়।
সেই বাড়ির সামনের মাঠে সেদিন কবিকে দেখতে ও কথা বলতে অনেকেই জড়ো হয়েছিলেন। সেই বাড়ি আর নেই। বর্তমান জেমিসন রেডক্রিসেন্ট হাসপাতালের পাশেই ছিল সেই বাড়িটি।”১]
১৭ জুন সন্ধ্যায় চট্টগ্রাম কলেজের আইনের অধ্যাপক সাহিত্যিক রজনীরঞ্জন সেনের (১৮৬৭-১৯৩৪)বাসায় স্থানীয় স্বদেশপ্রেমিক কবি-সাহিত্যিকদের সাথে চট্টগ্রামে বঙ্গীয় সাহিত্য পরিষদ-এর শাখা গঠন সম্পর্কে মতামত প্রকাশ করেন কবি।পার্সিভিল হিলে ‘দ্যা প্যারেড’ নামের যে বাড়িতে সেই সভা হয়েছিল সেই বাড়িটিও এখন নেই।
১৭ তারিখ কমলাকান্তের বাসায় রাত্রিযাপন করে ১৯০৭ সালের ১৮ জুন মঙ্গলবার সকালে কবি কয়েকজন সঙ্গীসহ শহর দেখতে বের হন এবং কর্ণফুলী নদীর তীরে জাহাজঘাটে গিয়ে জাহাজের মাঝি-মাল্লার সাথে কথা বলেন।২
১৮ জুন ১৯০৭। ওইদিন বিকেলে নগরীর সদরঘাটস্থ কমলাবাবুর থিয়েটার হলে হাজারো স্বদেশপ্রেমিক সাহিত্যিক ও সংস্কৃতিকর্মীদের উপস্থিতিতে কবিকে জাঁকজমকপূর্ণ এক সংবর্ধনা দেয়া হয়। বর্ষণমুখর শেষ বিকেলে হাজারো মানুষের স্বতস্পূর্ত উপস্থিতি কবিকে বেশ আনন্দ দিয়েছিল।সংবর্ধনার জবাবে কবিগুরু সেখানে ভাষণ দেন।ওই সভায় রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর একটি গান গেয়েছিলেন বলেও জানা যায়।
পরবর্তীতে এই থিয়েটার হলটি লায়ন সিনেমা হল,
অধুনালুপ্ত লায়ন সিনেমা হলের স্থানে এখন বহুতল ভবন নির্মিত হয়েছে।
১৮ জুন রাত ৮:৩০ মিনিটে সফরসঙ্গীদের নিয়ে ট্রেনে করে চট্টগ্রাম ত্যাগ করেন রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর।
নোবেল পাবার ৬ বছর আগেই চট্টগ্রামবাসী কবিকে সংবর্ধনা দিয়েছিল যা সত্যিই চট্টগ্রামবাসীর জন্য গর্বের। এছাড়াও ১৯– সালের ৭ জুলাই চট্টগ্রামের কৃতি সন্তান কেদারনাথ দাশগুপ্ত লন্ডনে কবিগুরুকে সংবর্ধনা দিয়েছিলেন।
[কবির অনুপ্রেরণায় দেরিতে হলেও ১৯১১ সালের ১৫ আগস্ট বঙ্গীয় সাহিত্য পরিষদের চট্টগ্রাম শাখা গঠিত হয়েছিল। রবীন্দ্রনাথের চট্টগ্রাম আগমনের ছ’বছর পর ১৯১৩ সালের ২২ ও ২৩ মার্চ চট্টগ্রামে অনুষ্ঠিত হয় বঙ্গীয় সাহিত্য পরিষদের ষষ্ঠ অধিবেশন। মিউনিসিপ্যাল স্কুল প্রাঙ্গণে অনুষ্ঠিত দুই দিনের অধিবেশনে অবিভক্ত বাংলার খ্যাতিমান ব্যক্তিরা উপস্থিত ছিলেন। তাঁদের মধ্যে অন্যতম হলেন প্রখ্যাত বিজ্ঞানী ও সাহিত্যসেবী আচার্য প্রফুল্লকুমার রায়, সাহিত্যিক অক্ষয় চন্দ্র সরকার, প্রখ্যাত কবি ও নাট্যকার দ্বিজেন্দ্রলাল রায় (ডিএল রায়), ছন্দের যাদুকর কবি সত্যেন্দ্রনাাথ দত্ত, রাষ্ট্রবিজ্ঞানের খ্যাতনামা অধ্যাপক ও সুসাহিত্যিক বিনয় সরকার, প্রখ্যাত চিন্তাবিদ ও সাহিত্যপ্রেমী রাধাকুমুদ মুখোপাধ্যায়, বাগ্মী-রাজনৈতিক নেতা ও সাহিত্যসেবী বিপিনচন্দ্র পাল প্রমুখ।]
➤লেখক: এস এম শাহনূর
কবি ও আঞ্চলিক ইতিহাস গবেষক
#তথ্য ঋণ:
[১] ‘রবীন্দ্র ভুবনে বাংলাদেশ’।। সালাম আজাদ
বিশ্বভারতী গ্রন্থনবিভাগ।
[২] হাজার বছরের চট্টগ্রাম’ গ্রন্থ
[৩] চট্টগ্রামে রবীন্দ্রনাথ,নজরুল ও অন্নদাশংকর।।নিতাই সেন
প্রথম প্রকাশ-ফেব্রয়ারি ২০১২
অ্যাডর্ন পাবলিকেশন
আন্দরকিল্লা, চট্টগ্রাম।
Leave a Reply