চৌধুরী ব্রেন্তা এস।।
হিমাংকের নিচে বিনা নোটিশে তাপমাত্রা নেমে এসেছে মায়নাস সাতে, শুভ্র বলাকার বুকের নরম পালকের মত তুষারধারা বিরতীহীন। কারাভাজ্জো কোয়ার্টারের সকল বাড়িগুলোর উৎসব আয়োজনে বৈদ্যুতিক লেড প্রজেক্টর লাইটে এনিমেশন চিত্রের রঙ ঝলক হালকা হয়ে আসছে চাঁদের অকৃপণ আলো আর ধবল তুষারের উজ্জ্বল মোলায়েম দ্যুতিতে। তুলতুলে রেশমি মনোরম কাশ্মিরি কার্পেট যেন সারা চত্বরজুড়ে মাশম্যালো স্বাদে । পাড়াময় মেরুন কালো টালির চৌচালাগুলো আচ্ছাদিত স্বপ্নীল এক ইগলোপূরীর ক্যানভাস নয় যেনো বাস্তব রূপ। শুষ্ক তুষারের ঘনগাঢ় স্তরের উপর যখন চন্দ্রপ্রভা পিছলে যায় গরদ অথবা সিল্কের মনোহর ভাব সেখানে হার মানে।
কী এক অভাব আজ অনুভবে, বাগান ছাদ আঙিনা আর পথে চাপ ফেলুক না ফেলুক বুকের গভীরের চাপ হিমশীতল যতটা করেছে ফায়ারপ্লেসের বাড়তি তাপ উষ্ণতা দিয়ে চাঙা করছে না।
বাগানের ল্যাম্পের পাওয়ার লাইন সংযোগ বিচ্ছিন্ন করে জ্যোৎস্না উপভোগে দুতলার জানালার কাঁচের ভিতর দিয়ে নিবিষ্ট দৃষ্টিতে তাকিয়ে দেখে, ক্লান্তি নেই তুষারাবৃত পরিবেশ যেন আলাস্কার প্রতিকৃতি , কাচের ভারি জানালা ভেদ করে কোনো কোনো পাশে মোমআলোর মৃদু রোমান্টিক আভা তুষারকণায় জেল্লা ছড়ায় হীরক দ্যুতির চটকে, এ এক স্বপ্ন চরাচর চাঁদের প্রভাবে ঝলমল ঠিক সেদিনের মত।
ভাবনার উপত্যাকায় হারায়। আজকের এই ভরা পুর্ণিমার রাত কেমন এক অপরিসীম অভাবে শূণ্য করে আছে দেহমন।
কল্পনার মত, অতীত মধুময় যতই ব্যথা জাগে কিছু সে অধ্যায় প্রাণবন্ত থাকে না স্বপ্নের মত, চোখের তারা নীল অঞ্জনের ছোঁয়ায় ছায়ায় ঝিকমিকিয়ে উঠে না আশার উদ্দীপনায় ।মাঝেমধ্যে থাকে শরীর মন দুর্বল করা দীর্ঘশ্বাস।
ভাবনার অতল থেকে ডলফিনের মত বোধের এন্টিনা সজাগ করে আচমকা স্ক্যাউক্যাট লুম্বিনির লাফের শব্দে চিন্তার ট্যানেল থেকে চলমান বাস্তবে ফিরে চন্দ্রাহত বিপাশা লুম্বিনির গম্ভীর ডাকের সাথে লেজ নাড়ানোতে বুঝে অনুমান করতে চাইলো ,দৈনন্দিন খেই হারালে চলবে না, আত্বস্ত হয়ে এক মগ কাপ্পোচিনো করতে গেলে সহসাই মনে পড়ে হিম রাত খরগোস বাগানে! আগে শুধু বর্ণা ছিল তার একাকিত্ব অনুভব উপলব্ধি করে পূর্ণকে কিনে এনেছিল। টর্চ নিয়ে বুট পায়ে কাঠের ঘর থেকে খরগোস দুটি বর্ণা পূর্ণকে এনে কম্বলে জড়িয়ে বেজমেন্টে রেখে উপরে আসতে শুনে ল্যান্ডলাইনে ফোন বাজছে, মেয়ে লাগুনা! পিকআপ করতেই অভিযোগ! মা তুমি আজকাল বেশি অন্যমনস্ক ! দুই ফোনে রিং করে মেসেজ দিয়ে সারা নেই, বাড়ি আসছি না, তুমিও আগামীকাল থাকবে না, তারচেয়ে ত্রিশ তারিখ ফিরব। নিউ ইয়ারের টেবিলে রাজহাঁস থাকবে কী? জানতে দিও, মেহমান আসবে দুজন। তোমার স্পেশাল ছানার তৈরি ওভেন সন্দেশ মেনুতে রেখো প্লিজ।
সংকল্প আগামীকাল দুপুরে ফিরবে মিশর থেকে। ছেলেটা কাজ ছাড়া কিছু বুঝে না, এবার যদি দুদিন বাসায় থাকে!
ওয়াসরুম থেকে অভ্যাসের অ্যালার্মের মত আরগান ওয়েল হাতে অবয়বে বুলিয়ে আয়নায় চোখ রাখে চুলের দিকে, করোনাকাল, গত মার্চে চুল কাটিয়েছিল। বেশ কিছু সাদা চুল সিঁথির পাশে। খেয়ালই করেনি , নিশ্চয় একমাসে পাকেনি। হাসি পেলো ভেবে তুষার সিঁদুরের বিগত চিত্রধারা সিনেমা প্রজেক্টরের মত জানলার কাঁচে চলতে শুরু করলো-
নেপালে হোটেল মুনলাইটের লভিতে বিপাশা শতদ্রুর দেখা, বিপাশা হোটেল ছাড়বে শতদ্রু প্রবেশ করবে, ভদ্রতা দেখিয়ে কাউন্টারে অগ্রাধিকার দিলো বিদেশী ছয়জনের টিম দেখে, ওয়েটিং এ বসে পৌঁছা সংবাদ জানাচ্ছিল দেশে , লাইন খারাপ কেটে গেল, সৌজন্যতায় ফোন এগিয়ে বিপাশা জানালো ইতালিয়ান নেটওয়ার্কে তেমন সমস্যা নয় জানিয়ে দিন আপনার ছেলেকে। শতদ্রু বিস্ময়ে তাকিয়ে প্রশ্ন করে আপনি বাংলা বলতে পারেন?
আমি বাঙালী শুধু নই বাংলাদেশী।
কিসে যেন তলিয়ে যায় মাঝবয়সী। বিপাশা ইশারা করে ফোন করার, ছেলেকে জানিয়ে দেয় দ্বিরুক্তি ছাড়া। রেইনকোট ফেলে বের হয়ে আসে হোটেল থেকে, শতদ্রু সেটা নিয়ে বাইরে আসে টেক্সির কাছে , বিপাশা জানায় রেখে দিন ভ্রমনে কাজে লাগতে পারে , পরে ফেলে দেবেন। টেক্সি ছুটে চলে কিন্তু অদৃশ্য হয় কিন্তু মায়াজালের এক রেশমি সুতোর বাধনহীন টান রেখে।
সাতদিন পর একটা মেসেজ – নম্বরটা ছেলের ফোনের কলিং লিস্ট থেকে নিতে বাধ্য হয়েছি , কোনো এক সম্রাজ্ঞীর হীরার রিং আটকে ছিল দানের সেই রেইনকোটে। কিভাবে পৌঁছাই প্রাপকের নিকট?
বিপাশা চমকে যায়, বাসায় ফিরে বুঝেছিল রিং একেবারেই হারিয়েছে।
যোগাযোগ যতই বাড়তে থাকুক কথা হোক ফোনে সোশ্যাল মাধ্যমে রিং এর প্রসঙ্গ আর একবারও তুলেনি কেউ।
নভেম্বরের শেষে শতদ্রু লিখে- আমি নরওয়েতে আসছি আগামী সপ্তায়, দুদিন থেকে জুরিখ এসে কমো লেকে আসার ইচ্ছা, তারপর রোম। রোমান সাম্রাজ্যের প্রতি এক যাদুময় আকর্ষণ বহু বছরের সেটা বর্ধিত হয়ে আল্পস সমান ইচ্ছেরা কিলবিল করে।
বিপাশা রিপ্লাই দেয় না। প্রতীক্ষার পর শতদ্রু ফোন দেয়, বিপাশা জানায় এমাসে তার একদিন সুযোগ নেই কোথাও বের হবার আগামী কাল সে বাথ যাচ্ছে।
শতদ্রু যতই আনন্দের ফোয়ারার শ্বাসরুদ্ধ হতে অনুভব করলো সহসা নিজেক সামলে নিয়ে বললো এবার একা নই আমি , খুব ভাল হলো আগামীবার প্ল্যান করে ঘুরা যাবে আপত্তি না থাকলে।
বিপাশার গম্ভীর জবাব, হ্যাঁ , হ্যাঁ হতেই পারে।
৩য় বারও বিপাশা অন্য কারনে এড়িয়ে যায় দেখা করা। কিন্তু এড়িয়ে যতই যায় শতদ্রু ততই আগ্রহান্বিত হয় সরবে নীরবে। অমায়িক ব্যবহার বুদ্ধিগুণে রাজত্ব নেয় বিপাশার সমস্ত জুড়ে। যাদুর কাটির মত ইশারায় ছুটে চলে ইদানিং মায়াজালে প্রেমের ক্ষমতায় সুদীর্ঘ একা থাকা মেয়ে।
আগামী ভ্রমণ শুধু দুজনার, ডোলোমাইট উপত্যাকা। রুপালী পূর্ণিমায় রাত কাটানো হবে সকল চাওয়ার শীর্ষে।
বোযেন আসতে দুঘন্টা শতদ্রু জানায়, বিপাশা গাড়ি ছাড়ে, অল্প দেখা মনের মানুষটি এই এক বছরে এত কাছে এসে বিশ্বাসের হিমালয় গড়েছে। স্টেশন থেকে পিক করে পাহাড়ী পথে এগিয়ে যায় রোম থেকে কেনা সাতটি লাল গোলাপ কলি আর বিপাশার গোলাপি পিয়নী আদান-প্রদানে আনন্দ বুঝে নেয় একে অন্যের।
রহস্যময় প্রকৃতির অপার সৌন্দর্য শুধু গিলে খাচ্ছে মানুষটি তা কেবল নয় স্বর্গীয় অপ্সরা দেখছে কাছে, ছোঁয়ে দেখতে চায় বাস্তবে আছে নাকি সে। বিপাশা হাসে শুধু, কথা পুরাপুরি হারায় অল্পভাষীনি। গন্তব্যে হাজির জানান দিচ্ছে নেভিগ্যাটর।
কয়লার ফায়ারপ্লেসের উষ্ণতায় বাইতার ভিতরে বসন্ত আবহ,বাইরে তুষারাবৃত কল্পনার রোমান্টিক পরিবেশ। বিপাশার বর্ননা আর নেটে খুঁজে দেখার সাথে হাজারগুণ বেশি। এ এক কাল্পনিক ভুস্বর্গ, ভালবাসায় আপ্লুত হয়ে ধন্যবাদ জানায় পরম তৃপ্তির সাথে।
শতদ্রুর একটুও ক্লান্তি নেই। বিপাশা ফ্রেশ হবার অনুরোদ জানিয়ে রান্না করে আনা লাজানিয়া, ওভেনে করা পাস্তা, চেস্টনাট কেক, সন্দেশ , টেবিল সাজায়, খাবারের পরিতৃপ্তি তুঙ্গে কথা তুলে শতদ্রু- এত দেরী হলো আমাদের সাক্ষাতে কিন্তু অভিমান নেই এমন স্বপ্নীল পুর্নিমাযাপনে আমন্ত্রণের জন্য।
দেশ থেকে নিয়ে আসা গোলাপী শাড়িটা বিপাশার হাতে তুলে দিলো সেই রিং এর সাথে। নিজে পরিয়ে দেবার অগাধ আগ্রহে সাজিয়ে তুলে ইডেন গোলাপের সকল পাপড়ির ভাঁজ , পরিয়ে দেয় ডায়মন্ডের এক নাকফুল । বিপাশা বন্ধ দুয়ার খুলে দৌড়ে, মেহেদী রাঙা হাতে চুড়ির ঝনঝন তুলে, ছুটে শতদ্রু, চাদের আলোর ফোয়ারা বেয়ে নেমে আসে যেন বিপাশার খুশির ঢেউ শতদ্রুর চাওয়ার উত্তাল সমুদ্র উচ্ছ্বাসে দুর্বার। যেন ভুস্বর্গে ওরা দুজন আদম ইভ বাহুবন্ধনে , পকেট থেকে ছোট্ট কৌটা খুলে সিঁথিতে দেবে মাত্রই ডেকে উঠে বনের লোপা চাঁদের বিপরীতে মুখ তুলে, সুখস্বপ্নে এক বিদ্ঘুটে আওয়াজে বিপাশা কেঁপে উঠে ধাক্কায় পড়ে যায় কৌটা সিঁদুরে রক্তিম তুষার, তুলতে গিয়ে হয়না তোলা। শীত অনুভব করে ভিতরে ঢুকে দুজন।
Leave a Reply