জিতু ফয়সাল
১
শহরতলিতেই ইয়াসমিনদের বাড়ি। বাড়ির পেছনেই রয়েছে আইভি লতা দিয়ে ঘেরা বাগান। বাড়িঘর খুব একটা নেই আশেপাশে। শহুরে উজ্জ্বল আলোর প্রকোপও দেখা যায় না, সারা আকাশ জুড়ে ফুটফুটে জোছনা। সবাই আনন্দে মেতে আছে। বেশ ভালই লাগছে। তারাগুলো মৃদু মৃদু জলছে চাঁদকে ঘিরে। যেন কাক-ডাকা ভোরের নিস্তব্ধ পরিবেশ। ঘর থেকে বেরিয়ে মা সবাইকে নিয়ে বাগানে নেমে আসেন। ইয়াসমিন নিবিড়ভাবে তাকিয়ে থাকে ঝলমলে চাঁদের দিকে আর ভাবতে থাকে এমন জোছনা রাত কি আবার ফিরে আসবে?
“শুনেছি এই রাতে নাকি পরিদের দেখা মেলে” মা বললেন, “এই আকাশ পরিমণ্ডলে সাত পরি রয়েছে। এদের প্রত্যেকেরই নিজ নিজ দায়িত্ব রয়েছে বিভিন্ন কাজের উপর। এদের দেখা মেলে না কিন্তু এরা মানব কল্যানের কাজে এগিয়ে আসে। সপ্তপরি হ্যানিয়েল মানব মনের সুন্দর আকাঙ্ক্ষিত ইচ্ছাগুলো পূরণ করে দেয়। মনের ইচ্ছেকে চিরকুটে লিখে ফুলদানি অথবা গাছের কোটরে রেখে দিলে মনের সব ইচ্ছেই পূরণ হয়।
ইয়াসমিন বলে, “মা, আমার যে অনেকগুলো মনের ইচ্ছে এখনও না বলা রয়ে গেছে।”
— “সপ্তপরি তোমার কথাও রাখবে দেখে নিও।”
ওর মন খুশিতে ভরে উঠল। মনে মনে ভেবে নিল তার ইচ্ছাগুলো হ্যানিয়েলকে জানাবে সে।
২
পরদিন বিকেলে শিক্ষকের সাথে রওনা করেছে কমিউনিটির পথে। গাড়ির মধ্যে ইয়াসামিন তেমন একটা কথা বলছে না শুধু এদিক ওদিক তাকিয়ে দেখছে। একসময় গাড়ি টার্ন নিয়ে উপরের দিকে উঠছিল। ইয়াসমিন জিজ্ঞেস করল, “আমরা কোথায় যাচ্ছি?”
শিক্ষক — “আমরা দূরে এক পাহারের উপর তোমার নতুন ঠিকানায় যাচ্ছি।”
পাহাড় বেয়ে যেতে কমিউনিটির কাছাকাছি আসতে কিছুটা রাত ঘনিয়েছে, পূর্নিমার চাঁদের আলো যেন সবুজ পাহাড়কে আলোকিত করে রেখেছে। হঠাৎ চোখে পড়লো হরিণের পাল।
গাড়ি থেকে নেমে হরিণ পালের কাছাকাছি দাঁড়িয়ে কিছুক্ষণ তাকিয়ে দেখল তাদের । জোছনার ঝলমলে আলোতে বিস্তৃত সবুজের মাঝে কিছুটা সুখ অনুভব করলো সে।
যথারীতি জীবন শুরু করে ইয়াসমিন। নতুন এলাকায় নতুন সব বন্ধুদের কাছে পেয়ে ভুলে যায় কিছুটা বাড়ির কথা। প্রতিদিন কলেজ শেষে ইয়াসমিন ঠিক ঠিক চলে যেত স্টেশনে আট নম্বর বিনারিতে যেখানে দেখা হতো সকল বন্ধু-বান্ধবদের সাথে। বিকেলের পুরো সময়টা সেখানেই কাটাতে তার পছন্দ ছিল। সকলের মাঝে মন ভরে আড্ডা বেশ ভালই লাগতো তার।
সময় হয় এলো, তাকে বাড়ি ফিরে যেতে হবে।
যথাসময়ে ট্রেন এলো, টুপ করে উঠে পড়ল সে।
অনেক খোঁজাখুঁজির পর একটি কেবিন খালি পেয়ে ঢুকে পড়ল । ইয়াসমিন জানালার পাশে তার পছন্দের জায়গা করে নিল। এরি মধ্যে একটি তরুন এসে তার পাশের সিটে গিয়ে বসলো। ট্রেন চলছে। জানালার দিকে তাকিয়ে গভীর হয়ে কী যেন ভাবছে সে!
ছেলিটি জিজ্ঞেস করলো, “অমন করে কী দেখছো?”
–“দেখো কী ফুটফুটে জোছনা, চাঁদের আলো তোমার ভাল লাগে না?” প্রশ্ন করল ইয়াসমিন।
ছেলেটি খুশি হয়েই জানাল, জোছনা রাত তারও খুব ভাল লাগে।
— “মনে হচ্ছে এই অদ্ভুত জোছনার সাথে তোমার একটি নিবিড় সম্পর্ক গড়ে উঠেছে।”
ট্রেনের খোলা জানালা দিয়ে শিরশিরে ঠান্ডা বাতাস বয়ে যাওয়াতে গলায় একটু ব্যাথা অনুভব করছে ইয়াসমিন। গলায় জড়ানোর মত তেমন কিছু নেই। হ্যান্ড ব্যাগ থেকে ছেলেটি তার বেগুনি রঙের মাফলারটা বের করে দেয়। ইয়াসমিন গলায় জড়িয়ে নেয়।
–“বাহ্ অদ্ভুত রঙের মাফলার। জোৎস্না রাতের সপ্তপরি হ্যানিয়েল’ এর ডানার রঙও ছিল বেগুনি আর পোশাক ছিল আকাশি রঙের। মা বলতেন, বেগুনি রঙ ব্যবহার করলে পরি হ্যানিয়েল-এর সান্নিধ্য পাওয়া যায়। আর গলায় ব্যথা তাও সেরে যায়।”
ছেলেটির সাথে কথা বলতে ভালই বোধ করে ইয়াসমিন। মা-বাবার সংসারে আদেল একা, শহরেই থাকে। স্প্যানিশ গীটারে তার খুব ভাল হাত। সেই সাথে গানের গলাও বেশ। কথার ছলে পার হয়ে যায় অনেকটা সময়। ছেলেটিকে যেতে হবে বেশ কিছু দূর। তারই এক বন্ধুর বোনের বিয়ে অনুষ্ঠানে। দু’দিন পরেই ফেরত আসবে।
৩
গভীর রাত, ইয়াসমিনের ঘুম ভেঙে যায়। বুকের মধ্যে ধড়ফড় করে ওঠে। তাড়াতাড়ি করে এক গ্লাস পানি খেয়ে নেয়। টিপ টিপ পায়ে হেঁটে যায় জানালার দিকে। ফুটফুটে অপরূপ এক জোছনা যেন ছেয়ে আছে আকাশ জুড়ে। হঠাৎ ছেলেটি’র কথা মনে পড়ে তার। আবেগে মন ভরে যায়। “অনেকদিন হয়ে এলো ওকে দেখি না,” ভাবল ইয়াসমিন।
ইয়াসমিন থাকত এক কমিউনিটিতে। সে রসায়নবিদ্যার ছাত্রী। সপ্তাহের শেষে ছুটির দিন চলে যেত তার মা-বাবার কাছে। শরতের মাঝামাঝি। রাতের আকাশে থাকে পরিপূর্ণ চাঁদের আলো।
ইয়াসমিন আর দেরী করতে চায়না জোছনা হারিয়ে যাবে তাই। তড়িঘড়ি আদেলের হাত ধরে বেরিয়ে পরে সে, চলে যায় দূর পাহাড়ে। পাহাড়ের ঢাল ধরে এঁকেবেঁকে বয়ে চলেছে নদী। জল থেকে চাঁদের ঝলক এসে পড়ছে ইয়াসমিনের চোখেমুখে। ছেলেটি এক দৃষ্টিতে চেয়ে থাকে তার দিকে। নীল চোখে ওকে দেখতে বেশ লাগছে। ইয়াসমিন হাত বুলিয়ে দেয় তার গালে। গিটারে উঠে আসে সুর।
–“জানো আমি জন্মেছিলাম ঝলমলে কোনো এক জোছনায়। সেই থেকে ভাল লাগা এই রাত। তোমার সাথে আমার পরিচয়ও হয়েছিল এমনি এক রাতে। কতবার ফুটফুটে চাঁদকে সাক্ষী করে মনের ভাললাগা ইচ্ছাগুলো বলেছি আমি।”
হটাৎ ফোন বেজে উঠল। বাড়ি ফিরে যেতে হবে ইয়াসমিনকে। আদেল গাড়িতে তাকে বাড়ি পৌঁছে দেবে। সকাল বেলায় একইভাবে ফিরে আসে কমিউনিটিতে। নিজেকে একটু অন্যমনষ্ক মনে হয়। কোনো কিছুতেই যেন মন বসাতে পারছে না। আজ রাতে রান্নার ভার পড়েছে ইয়াসমিনের উপর। রান্নার প্রস্তুতি চলছে। ওভেনে লাসানিয়া বসিয়ে দিয়েছে। আর চুলোতে চিকেন কাটলেট করা হচ্ছে। জানালার বাইরে একটু জোছনার উঁকিঝুঁকি দেখে ইয়াসমিনের মনটা ভাল বোধ করছে যেন। মনে মনে ভাবছে রান্নাটা নিশ্চয়ই ভাল হবে আজ।
রান্না শেষে ডাইনিং টেবিলে খাবার পরিবেশন করে সবাই এসে বসেছে। রান্নার খুব প্রশংসা করছে সবাই। ইয়াসামিনের চোখেমুখে এক ঝলক আবেগ বয়ে গেল। মনে মনে ভাবছিল আদেলের কথা, ও থাকলে কতই না খুশি হতো। কিছুদিন পরেই আসছে নতুন বছর, সকলে মিলে ভালই আনন্দ করবে এই উৎসবে। এবার নিশ্চিত আদেল আসবে।
৪
বছর চার পেরিয়ে যায় এরই মধ্যে। ইয়াসমিন ফাইনাল ইয়ারের ছাত্রি। লেখাপড়া নিয়ে বেশ ব্যস্ত। কাল তাকে ল্যাবে থাকতে হবে। এক্সপেরিমেন্ট রয়েছে। সকালে তাড়াহুড়ো করে বের হয়ে গেছে। ল্যাবে এক্সপেরিমেন্ট চলছে। অসাবধানতার কারনে এসিড ছিটকে পড়ে দৃষ্টিহারা হয়ে পড়ে ইয়াসমিনের সুনিল দু’চোখ। তাড়াহুড়ো করে এম্বুলেন্সে ওকে নিয়ে যাওয়া হয় শহরের সেন্ট্রাল আই হসপিটালে। ডাক্তার এসে ইয়াসমিনের নীল চোখ দেখেই বুঝে নেয় মেয়েটি তার পরিচিত।
আদেল মুহূর্তের মধ্যেই থমকে যায়। ইয়াসমিনের সব স্মৃতি তাকে ঘিরে ধরে। কোনোভাবেই নিজেকে স্বাভাবিক করতে পারছে না। ইয়াসমিনকে একটুও বুঝতে দেয়নি। এদিকে ডাক্তার আদেল’র নামটিও ইয়াসমিন’র মনের ভেতর বেশ গেঁথে বসে, কোথায় যেন খটকা লাগছে। কিছুতেই মনে করতে পারছে না যেন। এই হাসপাতালে আদেল একজন বড় ডাক্তার শুনে
আবেগের বশে কান্না পায় তার। ইয়াসমিনের চিকিৎসার দায়িত্বভার নেয় আদেল। ওর দৃষ্টি আমি ফেরাবই। অপারেশন থিয়েটারে যাবার সময় ইয়াসমিন জিজ্ঞেস করেছিল–
–“আদেল, আমি কি আবার দেখতে পাব তোমাকে?”
আদেল নিশ্চিত করে কিছু বলতে পারলো না, শুধু জানালো, বেশ সময় নেবে।
–“আমাকে তুমি নিয়ে যাবে জোছনা রাতে সেই পাহাড়ের ঢালে?” আকুতি জানায় ইয়াসমিন।
এক রূপসী জোছনা রাতে আদেল হাত ধরে ইয়াসমিনকে নিয়ে যায় সেই পাহাড়ে। ইয়াসমিনের মন বলছে সে আবার তার দৃষ্টি খুঁজে পাবে। জোছনা রাতের সপ্তপরি হ্যানিয়েল আমার কথা ফেরাবে না। আদেল লক্ষ করে ইয়াসমিনের চোখে জল। কথার এক ফাঁকে ক্লান্ত হয়ে ঘুমিয়ে পড়ে সে। তৃষ্ণার্ত ইয়াসমিনের জন্যে আদেল কাছেই পাহাড়ি ঝর্না থেকে একটু জল আনতে যায় ফেরার পথে শুনতে পায় ইয়াসমিনের কন্ঠ যেন খুঁজছে আদেলকে। কাছে যেতেই জড়িয়ে ধরে আদেলকে, “আমি তোমাকে দেখতে পাচ্ছি, সপ্তপরি যে আমাকে দৃষ্টি ফিরিয়ে দিয়েছে।
লেখক পরিচিতি
জন্মঃ ১৯৬৭
লেখক জিতু ফয়সালের জন্ম ঢাকায়। ১৯৮৭ সালে গ্রাজুয়েশন শেষ করে তিনি ভাগ্যান্বেষণে চলে যান ইউরোপে এবং ইতালিতে গিয়ে স্থায়ী হন। সেখানে গিয়ে বছরখানেকের মধ্যে ভালমতো রপ্ত করে নেন ইতালীয় ভাষা।
১৯৯৫ সালে Enaip Professional Institute থেকে লাভ করেন CNC (Computarized Numeric Control) ডিপ্লোমা এবং প্রোগ্রামার হিসাবে কাজ শুরু করেন। এরপর থেকে আঠারো বছর যাবৎ Assembly Department-এর গুরুদায়িত্ব নিয়ে নিরলস কাজ করে চলেছেন জিতু ফয়সাল। অবসর সময়ে অনেক ধরনের সামাজিক কর্মের সঙ্গে নিজেকে জড়িত রাখেন তিনি, এবং শখ হিসাবে ভ্রমণ করেন জাদুঘর-জাতীয় প্রতিষ্ঠানসমূহে।
Leave a Reply