-ইশরাত শিউলী ।।
ভূমিকা
বাংলা কাব্যের ধারায় বিজ্ঞানের সমন্বিত রূপ প্রদর্শনে হাসনাইন সাজ্জাদী এক নতুন দিগন্ত উন্মোচন করেছেন। তিনি বিশ্বাস করেন, আধুনিক যুগে কবিতাকে শুধু আবেগ বা রোমান্টিক অনুভূতির গণ্ডিতে আটকে রাখা চলবে না; বরং তাকে সময়, সমাজ ও বিজ্ঞানের আলোকিত ধারায় এগিয়ে নিতে হবে। তাঁর প্রণীত বিজ্ঞানকাব্যতত্ত্ব সেই প্রয়াসের সুনির্দিষ্ট দিকনির্দেশনা, যা তিনি ছয় দফায় ব্যাখ্যা করেছেন। প্রতিটি দফাই একবিংশ শতকের মানবসভ্যতার প্রেক্ষাপটে কবিতার ভূমিকা ও দায়িত্বকে স্পষ্ট করে।
১। রিপোর্টিং স্টাইলে কবিতা রচনা
সাজ্জাদীর মতে, কবিতার ভাষা হতে হবে সংবাদধর্মী—সরাসরি, স্পষ্ট ও বস্তুনিষ্ঠ।
• সংবাদ প্রতিবেদনের মতোই কবিতা তখন হয়ে ওঠে সময়ের দলিল।
• বাস্তব জীবনের ঘটনা যেমন প্রযুক্তি মেলা, জলবায়ু বিপর্যয় কিংবা মহাকাশ অভিযানের চিত্র কবিতায় উঠে আসে তাজা খবরের মতো।
এভাবে কবিতা সময় ও সমাজের ইতিহাস সংরক্ষণ করে।
২। মানুষের জন্য মানুষের লেখা কবিতা — লিঙ্গ বৈষম্য বিরোধী কবিতা
বিজ্ঞান কবিতা মানবতাবাদী; এর মূল লক্ষ্য মানুষের কল্যাণ।
• লিঙ্গ, বর্ণ বা শ্রেণিভেদে বিভাজন না করে কবিতা সবাইকে একত্রিত করে।
• নারী-পুরুষ সমতার পাশাপাশি তৃতীয় লিঙ্গের মর্যাদাও কাব্যে স্থান পায়।
এভাবে কবিতা মানবাধিকার ও ন্যায়ের কণ্ঠস্বর হয়ে ওঠে।
৩। ধর্মনিরপেক্ষ কবিতা রচনা
বিজ্ঞানকাব্যতত্ত্বে ধর্মীয় গোঁড়ামি বা সংকীর্ণতা নেই।
• কবিতায় থাকবে যুক্তি, সহনশীলতা ও মানবিক চেতনা।
• ধর্মভিত্তিক বিভাজনের পরিবর্তে কবিতা মানুষকে ঐক্যের পথে ডেকে আনে।
এখানে কবিতা বৈজ্ঞানিক যুক্তি ও নৈতিকতার উপর দাঁড়িয়ে সবার জন্য সমান বার্তা দেয়।
৪। ছোট ক্যানভাসে বড় উপমার কবিতা রচনা
সাজ্জাদী মনে করেন, কবিতার শক্তি শব্দের সংখ্যা নয়, বরং ভাবের গভীরতায়।
• স্বল্প শব্দে বৃহৎ দার্শনিক বা বৈজ্ঞানিক সত্য তুলে ধরা কবিতার প্রধান শিল্পরীতি।
• যেমন, ক্ষুদ্র একটি শিশির বিন্দুতেও প্রতিফলিত হতে পারে মহাবিশ্বের সৌন্দর্য।
এভাবে সংক্ষিপ্ত অথচ প্রগাঢ় কবিতাই বিজ্ঞান কাব্যের বৈশিষ্ট্য।
৫। কবিতার উপমা, উৎপ্রেক্ষা ও চিত্রকল্পে বিজ্ঞানের উপমা
কবিতার অলঙ্কারশাস্ত্রে বিজ্ঞানকে সম্পৃক্ত করেছেন সাজ্জাদী।
• প্রোটন-ইলেকট্রনের আকর্ষণকে প্রেমের উপমা, কৃষ্ণগহ্বরকে একাকিত্বের রূপক, DNA-কে উত্তরাধিকারের প্রতীক করা যায়।
• এভাবে বৈজ্ঞানিক আবিষ্কার কাব্যের কল্পনায় রূপান্তরিত হয়ে নতুন এক নান্দনিক জগৎ নির্মাণ করে।
৬। বিজ্ঞান যুগকে কবিতায় ধারণ করা
আধুনিক যুগে প্রযুক্তি ও বিজ্ঞানের অগ্রগতি মানবজীবনের অপরিহার্য অংশ।
• কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা, রোবট, জিন প্রকৌশল, মহাকাশযাত্রা, জলবায়ু সংকট—এসবই কবিতার বিষয় হতে হবে।
• বিজ্ঞান কবিতা ভবিষ্যৎ প্রজন্মকে সচেতন করে, আরেকদিকে শিল্পের নতুন সম্ভাবনা উন্মোচন করে।
উপসংহার
হাসনাইন সাজ্জাদীর ছয় দফা বিজ্ঞানকাব্যতত্ত্ব একদিকে কবিতাকে সমকালীন করে তোলে, অন্যদিকে ভবিষ্যতের দিশাও দেখায়।
• রিপোর্টিং স্টাইল কবিতাকে সময়ের ইতিহাস বানায়।
• মানবতাবাদ ও ধর্মনিরপেক্ষতা কবিতাকে সকল মানুষের কণ্ঠস্বর করে।
• সংক্ষিপ্ত অথচ গভীর উপমা ও বৈজ্ঞানিক চিত্রকল্প কবিতাকে দেয় নতুন সৌন্দর্য।
• আর বিজ্ঞান যুগের বাস্তবতা কবিতাকে যুগোপযোগী করে তোলে।
অতএব বলা যায়, সাজ্জাদীর বিজ্ঞানকাব্যতত্ত্ব বাংলা কাব্যধারায় নতুন এক মাইলফলক—যেখানে কবিতা হয়ে ওঠে জ্ঞান, সমাজ ও মানবতার বৈজ্ঞানিক সেতুবন্ধন।
…
Leave a Reply