বকুল আশরাফ
পুরো বেলকনি জুড়ে আলো। জ্যোৎস্নার আলো। মনে হয় হাত বাড়ালেই ছুঁয়ে দেয়া যায়। চোখ ধাঁধানো আলোর মিষ্ট স্বভাব হৃদয়টাকে ভরে দিল আজ। অদমনীয় আকর্ষণে জ্যোৎস্না যেন ডাকছে। সামলানো যায় না। চাঁদও পাড়ছে না জ্যোৎ¯œাকে সামলাতে। অশান্ত সমুদ্র যেন, স্ফীত। চোখের পাতা নড়ে উঠলেই জ্যোৎস্না যেন সমুদ্রের শান্ত ঢেউ হয়ে দুলে উঠে। কোন কোলাহল নেই, চারিদিক নিঝুম। ঝিঁঝির ডাকও কমে এসেছে। ঘুমাবার সময় অসহ্য মনে হচ্ছিল এই ঝিঁঝির ডাক। ঝিঁঝিঁগুলো এতো নগ্নভাবে ডাকে কেন বিরতিহীন! রিফাত ইদানিং মাথার পেছনে বা’দিকটায় এক ধরনের যন্ত্রণা অনুভব করে। সকালের কাঁচা রোদ ছাড়া আর যে কোন গাঢ় আলো সহ্য হয় না রিফাতের। চোখে বিঁধে। এক মুঠো রোদ্দুর ছুঁতে গিয়ে একদিন চোখের ভেতরটা অন্ধকার হয়ে গিয়েছিল, তাকাতেই পারেনি আলোর দিকে। অথচ এখন বাঁশঝাড়ের মাথার উপর পূর্ণিমার গোল চাঁদটা স্থিরভাবে আলো বিলিয়ে যাচ্ছে পৃথিবীতে আর রিফাতের চোখে। রিফাতের প্রতিদিনের ছোট্ট পৃথিবীটা অনেক সংকুচিত হয়ে আসছে। সবটুকু কাছে পেতে ভালো লাগে না রিফাতের। ও ভাবে, মেঘের তাড়া খেয়ে চাঁদটা যদি পালাতো, তবে কেমন হতো! মেঘ যদি চাঁদকে গিলে ফেলতো! যদি চাঁদটা লুকিয়ে পড়তো মেঘের আড়ালে! মনে হতো রক্তক্ষরণে বিবর্ণ জ্যোৎ¯œা। স্থায়িত্ব রিফাতের ভালো লাগে না। ওর কোন চাই-চাই স্বভাব নেই। আজ ওর খুব আলো দেখতে ইচ্ছে করছিল, তাই বুঝি আজ এত আলো! জ্যোতির্ময়! জরির সুতোয় বোনা জ্যোৎস্নার চাদর। নাকি চাঁদের অভিমান জ্যোৎস্না হয়ে ঝরছে! মন দিয়ে, ভালোবাসা দিয়ে চাইলে সব কিছুই কাছে চলে আসে। হাত বাড়ায় রিফাত। চাঁদটা দূরে সরে যায়। বাঁশঝোপের সরু সুতীক্ষè পাতাগুলোর ফাঁকে কানিবক-এর উপস্থিতি টের পায়। ঝোপের নিচে কি যেন নড়া-চড়া করে এবং দৌঁড়ে পালিয়ে যায়। ইঁদুরের উৎপাত বেড়ে গেছে। হেমন্ত এলে এমনটা হয় এই গ্রামে। হেমন্তের আলাদা একটা ঘ্রাণ আছে। এই ঘ্রাণটা উপভোগ করে রিফাত। শহরে কোনদিন এই হেমন্তের ঘ্রাণ অনুভব করেনি। গ্রামে এলেই ঘ্রাণ নাকে লাগে।
গ্রাম আর নেই। শহরের ছোঁয়া গ্রামকে শহুরে স্বাদ এনে দিয়েছে। বাড়ির দোতলার ঘর থেকে নিচে তাকালে পুরোটা দেখা যায় না। তাই কিছুই দেখে না রিফাত। শুধু টের পায় কোন ক্ষুদ্র প্রাণির চলাচল। মৃদুু বাতাসে নড়ে উঠলে জ্যোৎস্নায় জন্মানো ছায়াগুলো দুলে উঠে। ছান্দিক দোলা লাগে রিফাতের মনে। খুব সঙ্গোপনে জ্যোৎস্নারিফাতের কাছে চলে আসে। পূব দিকে তাকাতে গেলে মাথায় আবার ব্যথা অনুভব হয়। চোখ মেলতে গিয়ে স্পষ্ট দেখতে পায় না রিফাত। মনে হয় বাঁশঝাড়টা ছোট হতে হতে ঘাস হয়ে গেছে। চাঁদটাও দেখা যায় না আর! সান্তনা খুঁজে রিফাত, বাঁশ তো এক ধরনের ঘাসই। বড় জাতের ঘাস। অস্পষ্টভাবে আবার জ্যোৎস্নার আলো ভেসে ওঠে চোখের সামনে। কেমন যেন পাংশুটে আলো। কে যেন জ্যোৎ¯œার গায়ে কালো অন্ধকার মেখে দিয়ে এমন পাংশুটে রঙ বানিয়ে দিয়েছে। জরির সুতোয় বোনা জ্যোৎস্নাকে মনে হচ্ছে কারা যেন জরির বদলে খড়কুটো দিয়ে বুনে দিয়ে গেছে। কেন এমন হলো! এখন আর বকপাখি গুলোকেও দেখা যায় না। মনে হয় বাঁশঝাড়ের আড়ালে চাঁদটা লুকিয়েছে। অহংকারী দীর্ঘায়িত ঘাসগুলো চাঁদটাকে আড়াল করে রেখেছে। এখন আর অদমনীয় আকর্ষণ নেই। রিফাত বিপদের গন্ধ পায়। তবে কি কেউ গিলে ফেলেছে! কেউ টেনে নামিয়ে নিয়ে যাচ্ছে চাঁদটাকে বাঁশ ঝাড়ের উপর থেকে! আবার কি অন্ধকার নেমে আসবে! অন্ধকার কি খুবই ভয়ের! এতো অন্ধকার কেন! চোখে এতো কম দেখছে কেন ! ও কি চোখ হারিয়ে ফেলছে! ও যদি অন্ধ হয়ে যায়! ও কি আর জ্যোৎস্না দেখতে পাবে! কি করে জ্যোৎস্নাকে অনুভব করবে! জ্যোৎস্নার স্নিগ্ধতা কি ও টের পাবে! যদি অন্ধ হয়ে যায় তবে কোনদিনও জানতেও পারবে না এই জ্যোৎস্নাস্নাত রাতের মাধুর্যের ইতিকথা। শুধু ছুঁয়ে দিয়ে শুধু অনুভব করবে! এমন করে ভাবতে চায়নি রিফাত। মাথার যন্ত্রণা বাড়ে। তখনই ঘুম ভেঙে যায় রিফাতের। ঘরের ভেতর অনেক অন্ধকার। অন্ধকারের ঘোরের মধ্যেই ভাবতে থাকে; এ কেমন স্বপ্ন! স্বপ্নে জ্যোৎস্না দেখার রহস্য কি! ডানে বামে তাকায় কিছুই দেখা যায় না। ফ্যানটা ঘুরছে না। বিদ্যুৎ চলে গেছে। মোবাইলের আলোতে হয়তো দেখে নেয়া যেতোÑএখন বাজে কয়টা। মোবাইল হাতরাবে কোথায়। বা’দিকে টেবিলটা স্পর্শ করে। টেবিলে রাখা পানির গ্লাসটা খুঁজে পেয়ে দু’ঢোক পানি পান করে রিফাত। গ্লাসের পাশে রাখা আইড্রপ খুঁজে নিয়ে নিজে নিজেই দু’চোখে ড্রপ দেয়। আবার শুয়ে পড়ে রিফাত। ড্রপ-এর কিছু অংশ চোখের ভেতরের জলের সাথে মিশে গিয়ে জল সাগরে ভাসিয়ে রাখে চোখ দুটোকে। আর কিছু অংশ দু’চোখের কোণ বেয়ে গড়িয়ে নামলে বালিশ তা শুষে নেয়।
ড্রপভেজা চোখে রিফাত এখন প্রকৃত জ্যোৎস্নাকে শুধু কল্পনাতেই আনতে পারে।
Leave a Reply