পাভেল আমান।।
উনবিংশ শতাব্দী শেষার্ধে উপনিবেশিক ভারতবর্ষে যে কয়েকজন মহান ব্যক্তির আবির্ভাব হয়েছে স্বামী বিবেকানন্দ তাদের মধ্যে অন্যতম।পরাধীন
ভারতবাসীকে জ্ঞান-বিজ্ঞান শিক্ষা সামাজিক সংস্কার ধর্মবোধ বা আধ্যাত্মিকতার দীপ্তিময় গৌরবোজ্জ্বল জীবনের পথ প্রদর্শনে যে কয়েকজন মনীষী আজও ভারতবর্ষে চিরস্মরণীয় হয়ে আছেন তন্মধ্যে স্বামী বিবেকানন্দের অবদান এক কথায় স্বীকার্য।পরাধীন ভারতবর্ষে তখন প্রয়োজন ছিল এক নবজীবনের উদ্দীপনা। দেশ ও জাতি যখন নিজের গৌরবময় অতীত বিস্মৃত হয়ে নির্লজ্জ পরমুখাপেক্ষিতে ও অন্ধ অনুকরণে আসক্ত হয়, তখনই নতুন করে জাতির সত্তাকে নাড়া দেওয়ার প্রয়োজন হয়, দিয়ে যান কোন মহাপ্রাণ। উনবিংশ শতাব্দীর অন্তিম লগ্নে গোটা বিশ্বের বুকে হিন্দুধর্মের জয়ধ্বজা স্থাপন করে এলেন বীর সন্ন্যাসী স্বামী বিবেকানন্দ।তিনি বলেছিলেন “যদি এই পৃথিবীতে এমন কোন দেশ থাকে, যাকে ‘পুণ্যভূমি’ নামে বিশেষিত করা যেতে পারে, যদি এমন কোন স্থান থাকে…..যেখানে মানুষের ভেতর ক্ষমা, দয়া, পবিত্রতা, শান্তভাব প্রভৃতি সদ্ গুণের বিকাশ সবচেয়ে অধিক পরিমাণে হয়েছে, যদি এমন কোন দেশ থাকে, যেখানে সর্বাপেক্ষা অধিক আধ্যাত্মিকতা ও অন্তর্দৃষ্টির বিকাশ হয়েছে, তবে নিশ্চিতভাবে বলতে পারি সে আমাদের মাতৃভূমি এই ভারতবর্ষ। ”
বহুমুখী ও বহুমাত্রিক প্রতিভার অধিকারী ছিলেন স্বামী বিবেকানন্দ। তাঁর আধ্যাত্মিকতা, সৃজনক্ষমতা, দেশপ্রেম ও সাহসিকতা সকলের কাছে সুবিদিত। এই সবের পাশাপাশি ছিল তেজস্বী বাগ্মীতা। আমাদের অন্তরের প্রতিচ্ছবি যেমন সবচেয়ে বেশি করে ধরা দেয় চোখের আলোয়, বিবেকানন্দের অন্তরের কথা তেমনই সবচেয়ে বেশি ধরা পড়ে তাঁর ইস্পাত শাণিত উজ্জ্বল শিকাগো বক্তৃতামালায়। বস্তুতপক্ষে, শিকাগো বক্তৃতামালার মধ্য দিয়ে বিশ্ববাসীর মানসলোককে ইতিবাচক ও শক্তিশালী চিন্তা, ভাব ও আদর্শের দ্বারা প্রদীপ্ত করাই ছিল তাঁর লক্ষ্য। বেদান্তের মুক্ত স্বচ্ছ দৃষ্টি, সুগভীর মানবপ্রীতিকে অগাধ আত্মবিশ্বাসে প্রশস্ত দীপাধারে প্রজ্জ্বলিত করেছেন সমগ্র মানবজাতির পথনির্দেশ করার জন্য। বিবেকানন্দ দিয়েছেন বিশ্ববোধ। অপূর্ব তাঁর উচ্চারণ, অসামান্য মানববোধ। অনির্ণেয় প্রসারিত আকারে তিনি মানব ও মানবজাতিকে দর্শন করেছেন, উপস্থিত করেছেন নব মানবধর্ম। ঘোষণা করেছেন, কোনও জাতি অপর জাতি থেকে নিজেকে বিচ্ছিন্ন করে বাঁচতে পারে না। কেবল সংকীর্ণ জাতীয় ভিত্তিতে কোনও বৃহৎ সমস্যার সমাধান হতে পারে না। সমগ্র বিশ্বকে সঙ্গে না নিয়ে একটি পরমাণুও চলতে পারে না। মানুষের কাছে তার অন্তর্নিহিত বাণী প্রচার করা এবং দেবত্ব-বিকাশের পন্থা নির্ধারণ করতে গিয়ে তিনি তাঁর গভীর উপলব্ধি ব্যাখ্যা করেছিলেন, এই সংসার কুসংস্কারের শৃঙ্খলে আবদ্ধ। এক ধর্মের প্রতি আর এক ধর্মের হানাহানি, ধর্মান্ধতা এবং গোঁড়ামির অন্ধকার যুগ যুগ ধরে বিশ্বভ্রাতৃত্ববোধ এবং মানবিকতাকে তমসাচ্ছন্ন করে রেখেছে। এই সকল দুঃখের মূলে রয়েছে অজ্ঞতা। জগতকে আলো দেখানোর জন্য চাই আত্মবিসর্জন। এটাই ছিল অতীতকালের কর্মরহস্য; যুগ যুগ তাই-ই চলতে থাকে। জগতে যাঁরা সবচেয়ে সাহসী ও বরেণ্য, তাঁদের চিরদিন ‘বহুজনহিতায় বহুজনসুখায়’ আত্মবিসর্জন করতে হবে। আজ এক দিকে বিজ্ঞান-প্রযুক্তির অভূতপূর্ব উন্নতি, দর্শন-মনন-প্রজ্ঞার অপরিসীম বিস্তৃতি, সমাজ-সভ্যতার দ্রুত সম্প্রসারণ, অন্য দিকে মানুষে মানুষে হিংসা, দুর্নীতি, দুর্বৃত্তায়ন, অভাবনীয় স্খলন-পতন-বিভেদ-বিদ্বেষ-বিপর্যয়-বীভৎস কার্যকলাপ ইত্যাদি তামসিক উল্লাসে প্রচণ্ড ভাবে ব্যাহত শুভচেতনা, নৈতিক মূল্যবোধ। মানুষ দিশেহারা। কেন এমন অবস্থা? তার ব্যাখ্যা এবং নিদান আছে বিবেকানন্দের বীক্ষায়। তিনি মানুষ, যথার্থ মানুষ, ভাল মানুষ, সচেতন-শুভ্র-সুন্দর-বুদ্ধ-শুদ্ধসত্ত্ব-প্রমুক্ত মানুষ চান। জন্মালেই আমরা সবাই মানুষ হয়ে উঠি না। মানুষ হয়ে উঠতে হয়। চৈতন্যের সম্প্রসারণে মানুষের পশুত্ব থেকে দেবত্বে উত্তরণ। স্বামীজির কথায়, ‘মান’ আর ‘হুঁশ’ সংবলিত প্রকৃত মানুষ হয়ে ওঠা। মানুষ হয়ে সর্বার্থে পিছিয়ে পড়া অজ্ঞ, কাতর, শোষিত, বঞ্চিত, অত্যাচারিত মানুষজনের পাশে থেকে জীবনের মূল স্রোতে শামিল করার বিষয়টিকে বিবেকানন্দ গুরুত্ব দিয়েছেন বিশেষ ভাবেই।আমরা সবাই আত্মপরতায় বাঁচতে চাই। পরার্থে জীবন উৎসর্গের বিষয়টি যেন থেকে যায় বাক্যবন্ধনীতে। এই আত্মপরতা থেকেই দেশ ও জাতির প্রতি আসে অবজ্ঞা। এই অবজ্ঞা-অবহেলার কারণেই বিচ্ছিন্নতাবোধের মাথা চাড়া দেওয়া, জাতীয় সংহতির বিপন্নতা, জাতীয়তাবাদ-জাতীয়তাবোধের অবমাননা। অনন্ত প্রেম ও করুণা নিয়ে এই পৃথিবীতে শত শত বুদ্ধের আবির্ভাব প্রয়োজন। স্বামীজী বিশ্ববাসীকে আত্মদীপ্ত হতে বলেছেন।স্বামী বিবেকানন্দ প্রাসঙ্গিক অতীত, বর্তমান, ভবিষ্যতে বারে বারে। দেশের চারপাশ যখন ধর্মান্ধ -কুসংস্কারীতে ছেয়ে যাচ্ছে, চারপাশ যখন ধর্মকে হাতিয়ার বানিয়ে নোংরা রাজনীতির খেলায় নিজেকে মাতিয়ে রেখেছে, সেই ক্রান্তিকালে বিবেকানন্দ ভারতবাসী, বিশ্ববাসীর পথ প্রদর্শক।
১৮৬৩ সালের১২ জানুয়ারি কলকাতার এক বাঙালি পরিবারে এই মহান সমাজ সংস্কারক মহাপুরুষের জন্ম।তাঁর চল্লিশ বছরের ঝঞ্ঝাময় জীবন যেমন শত বাধা পেরিয়েও স্বপ্নময়, তেমনই ১২৫ বছর অতিক্রান্ত শিকাগো বক্তৃতার উদ্ভাস এতদিন পরেও নতুন যুগের নাগরিকদের প্রকৃত মানুষ হয়ে ওঠার বাসনাকে জাগিয়ে তোলে। স্বামীজীর সেই উপদেশ, সেই বাণী সুধু আমাদের দেশেই নয়, সমগ্র পৃথিবীর মানুষ সাদরে গ্রহণ করেছেন এবং তা জীবনচর্যায় কাজে লাগাচ্ছেন। অন্য ধর্মবিশ্বাসী মানুষ খ্রীস্টান, বৌদ্ধ, মুসলমান, জৈন, জরাথ্রুষ্টিয়, ইহুদি প্রভৃতি ধর্মের মানুষও তাঁদের জীবনে স্বামীজীর বাণী-আদর্শকে গ্রহণ করতে সচেষ্ট হয়েছেন।ধর্ম নিয়ে আজ পৃথিবী সন্ত্রস্ত। মৌলবাদীদের আস্ফালন সর্বত্র। মানুষ বিপন্ন। বিবেকানন্দ মন ও মুখের সত্যতায় স্পষ্টত জানান‘ধর্ম মানুষের বন্ধু।’ তা কোনও শর্তাধীন নয়। বিনিময়যোগ্য স্বার্থের আদানপ্রদানে সঙ্কুচিতও নয়। ধর্ম বিবর্তনের পথেই এগোয়। ধর্ম সমাজের দায় বহন করে। নিরন্ন মানুষের জন্য অন্ন, অসুস্থ প্রপীড়িতের জন্য ত্রাণ-সেবা, অনাথ-বিধবার অশ্রুমোচনের দায়িত্ব ধর্মকেই নিতে হয়।স্বামী বিবেকানন্দের জন্মের দেড়শো বছর অনেক দিন আগেই
আগেই অতিক্রান্ত। অথচ এখনও তাঁর চিন্তা-চেতনার, ভাবনার প্রসার সে ভাবে হয়নি। গাঁধী যে ভাবে ‘সর্বোদয়’ ভাবনার মাধ্যমে সমাজের সার্বিক উন্নয়নের কথা ভেবেছিলেন, কার্ল মাক্স ভেবেছিলেন ‘সাম্যবাদ’ সমাজব্যবস্থার কথা, স্বামী বিবেকানন্দও তেমন সার্বিক উন্নয়নের কথা ভেবেছিলেন। তবে তাঁর পরিকল্পনায় মাত্রা পেয়েছিল ব্যক্তি-চরিত্রের উৎকর্ষ সাধন। আর তা সম্ভব জনসাধারণকে শিক্ষাদানের মধ্য দিয়ে।
আমৃত্যু স্বামীজি দেশের নবীন প্রজন্ম তথা যুবসমাজকে দেশের কারিগর তথা কান্ডারী রূপে গড়ে তুলতে উৎসাহ যুগিয়েছেন। প্রতিনিয়ত তিনি যুবসমাজকে দেশীয় সংস্কৃতি কৃষ্টি ঐতিহ্য সম্পর্কে অনুপ্রাণিত করেছেন এবং পাশাপাশি জাতীয়তাবাদের চেতনায় তাদের উদ্বুদ্ধ করেছেন। কারণ ভারত বর্ষকে প্রগতিশীলতার পথে এগিয়ে নিয়ে যেতে গেলে যুব সমাজকে সর্বতোভাবে প্রস্তুতির শিখরে নিয়ে যেতে হবে। সেখানেই দেশ ও জাতির পরাকাষ্ঠা।
স্বামী বিবেকানন্দ প্রাসঙ্গিক অতীত, বর্তমান, ভবিষ্যতে বারে বারে। দেশের চারপাশ যখন ধর্মান্ধ -কুসংস্কারীতে ছেয়ে যাচ্ছে, চারপাশ যখন ধর্মকে হাতিয়ার বানিয়ে নোংরা রাজনীতির খেলায় নিজেকে মাতিয়ে রেখেছে, সেই ক্রান্তিকালে বিবেকানন্দ ভারতবাসী, বিশ্ববাসীর পথ প্রদর্শক। তাঁর জন্ম দিবসে আপামর ভারতবাসী তথা বাঙালিরা জাতি-ধর্ম-বর্ণ নির্বিশেষে একত্রিত হয়ে স্বামীজীর প্রদর্শিত পথে যদি আমরা চলতে পারি, তাঁর আদর্শ চিন্তাভাবনা দর্শনকে সংবেদনশীল মননে গ্রহণ করতে পারি তবেই স্বামীজীর জন্ম দিবস পালনের প্রাসঙ্গিকতা ও তাৎপর্য।
পাভেল আমান, হরিহর পাড়া- মুর্শিদাবাদ
Leave a Reply