দীপক সাহা
পৃথিবী জুড়ে এখন শুধু করোনার ভয়ংকর চিত্র।পৃথিবীর অন্দরে কান পাতলে শোনা যায় মানুষের অসহায়তার আওয়াজ। চরম উৎকণ্ঠায় প্রতিটি মানুষ। সবথেকে বেশি বিপন্ন শৈশব। নোবেলজয়ী কৈলাস সত্যার্থী আশঙ্কা প্রকাশ করেছেন, এই পরিস্থিতির ফলে কয়েক লক্ষ শিশু ফের দাসত্ব, শিশু শ্রমিক, শিশু পাচারের জালে জড়িয়ে পড়বে। ফাঁদে পেতে কন্যা সন্তানদের দেহ ব্যবসার দিকে ঠেলে দেওয়া কিংবা বাল্যকালেই বিয়ে দেওয়ার প্রবণতা দেখা যাবে। করোনা আবহে কন্যা শিশুরা চরম হুমকির মুখে। উপমহাদেশের আর এক নোবেলজয়ী মালালা ইউসুফজাই দিন কয়েক আগে এক আন্তর্জাতিক মঞ্চে বলেছেন করোনার করাল গ্রাসে পৃথিবীব্যাপী প্রায় আড়াই কোটি মেয়ে স্কুলের আঙ্গিনা থেকে ঝরে গেছে। এমতাবস্থায় আন্তর্জাতিক শিশুকন্যা দিবস পালনের গুরুত্ব অপরিসীম।
রাষ্ট্রসংঘের অনুপ্রেরণায় এবং প্ল্যান ইন্টার ন্যাশনাল নামে এক বেসরকারি সংস্থার পৃষ্ঠপোষকতায় ২০১২ সালের ১১ অক্টোবর প্রথম শিশুকন্যা দিবস পালিত হয়েছিল। প্ল্যান ইন্টারন্যাশনাল “কারন আমি এক কন্যা” ( Because l am a Girl) নামক আন্দোলনের ফলশ্রুতিতে এই দিবসের ধারণা জাগ্রত হয়েছিল। শিশুকন্যা দিবস পালনের উল্লেখযোগ্য ক্ষেত্র সমূহ হলো সমাজে লিঙ্গ বৈষম্য দূর করা, শিশুকন্যার জন্মের অধিকার, শিক্ষার ও স্বাস্থ্যের অধিকার, আইনি অধিকার, চিকিৎসা সুবিধা, বাল্যবিবাহ রোধ, কন্যা পাচার রোধ, সামাজিক, রাজনৈতিক, অর্থনৈতিক ও মানবিক সাম্যের অধিকার ।
প্রতি বছর শিশুকন্যা দিবসের একটা থিম থাকে। প্রথম শিশুকন্যা দিবসের থিম ছিল– বাল্যবিবাহ বন্ধ করা। ২০২০ সালের থিম– My voice, our equal future, আমার কণ্ঠস্বর, আমাদের সমান ভবিষ্যত । ৬২ মিলিয়ন কন্যা পৃথিবীতে শিক্ষার আলো দেখেনি। গোটা বিশ্বে চারটের মধ্যে একটা মেয়ে ১৮ বছরের আগেই বিয়ে হয়ে যায়। পৃথিবীর কোন না কোন প্রান্তে প্রতি দশ মিনিটে হিংসার বলি হয় এক কন্যা এবং ১৩০ মিলিয়ন কন্যা যাদের বয়স ছয় থেকে সতেরো স্কুলে যায় না।
পৃথিবীব্যাপী অনেক কন্যা যৌন নির্যাতন ও ধর্ষণের শিকার এবং অনেক ক্ষেত্রেই অভিযুক্তরা শাস্তি পায় না। উপযুক্ত শিক্ষা ও সচেতনতা কন্যা শিশুর সার্বিক উন্নতির সহায়ক। এই দিবস পালনের অন্যতম প্রধান উদ্দেশ্য শিশুকন্যাদের আরো বেশি সার্বিকভাবে ক্ষমতায়ন করা এবং তাদের মানবাধিকার সুপ্রতিষ্ঠিত করা যাতে তারা সমাজের বিভিন্ন স্তরের চ্যালেঞ্জের মোকাবিলা করতে পারে। ১১ অক্টোবর শুধুমাত্র একটি দিবস পালন নয় এটা একটা আন্দোলন, পৃথিবীব্যাপী একটি বিপ্লব।
আমাদের উপমহাদেশে প্রাচীনকালে মহিলাদের একটি বিশেষ শ্রদ্ধা ও সম্মানের জায়গা ছিল এবং সমাজে তাঁরা বিভিন্ন ক্ষেত্রে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করতেন। পরবর্তী কালে বিশেষ করে মধ্যযুগে পুরুষতান্ত্রিক সমাজে মহিলাদের অবস্থান অনেকটা পেছনের সারিতে চলে যায়। পরবর্তীতে ইংরেজ আমলে রাজা রামমোহন রায়, বিদ্যাসাগর, রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর, মহাত্মা গান্ধী, নজরুল, বিবেকানন্দ প্রভৃতি মহাপুরুষ এবং মনীষীদের প্রচেষ্টায় মহিলারা আস্তে আস্তে আবার সমাজে সামনের সারিতে আসতে শুরু করে।
উন্নততর দেশ গঠনে মেয়েদেরও যথেষ্ট ভূমিকা আছে। প্রাতঃরাশ তৈরি থেকে মঙ্গল গ্রহে মহাকাশযান উৎক্ষেপণ সব ক্ষেত্রেই মহিলারা পুরুষদের সঙ্গে টক্কর দিচ্ছে। তবুও যখন কন্যা সন্তান জন্মায় তখন সেই শিশুকন্যার নিরাপত্তা ও ভবিষ্যত নিয়ে সংশয় দেখা দেয়। শিশুকন্যারা এখনও অনেক দেশে দ্বিতীয় শ্রেণীর নাগরিক। প্রতিনিয়ত লিঙ্গ বৈষম্যের অভিশাপ বয়ে নিয়ে বেড়াচ্ছে। অপরিণত বয়সে বিয়ে, অপুষ্টি এবং অশিক্ষা কন্যাদের নিত্যসঙ্গী। পিতৃতান্ত্রিক সমাজে আমাদের সীতা ,আমিনা ও মেরীর প্রতিনিয়ত সম্মান ও সম্ভ্রম লুণ্ঠিত হচ্ছে। সদ্যজাত কন্যার স্থান হয় রাস্তার ডাস্টবিনে। সামাজিক এবং অর্থনৈতিক চাহিদার পরিপ্রেক্ষিতে আমাদের সমাজে ছেলে বাচ্চার চাহিদা বেশি , ফলে কন্যাভ্রূণ হত্যার প্রবণতা ক্রমবর্ধমান। এখনো পৃথিবীর বিভিন্ন প্রান্তে কন্যা সন্তানকে পৃথিবীর আলো দেখতে দেওয়া হয় না। অমর্ত্য সেনের পরিভাষায় ” মিসিং ওমান “। বিগত কুড়ি বছরের পরিসংখ্যান বলছে , উপমহাদেশে প্রায় ১৩ মিলিয়ন কন্যা ভ্রূণহত্যা হয়েছে। তার ফলে পুরুষ ও মহিলার অনুপাত ক্রমশ বৃদ্ধি পাচ্ছে। কন্যাশিশু মৃত্যু হারও ভয়ংকরভাবে বেশী।
শিশুকন্যা ধর্ষণ একটি অসুস্থ ও চূড়ান্ত সামাজিক অবক্ষয়। ধর্ষণের সবচেয়ে বেশি শিকার ৭-১২ বয়সী বাচ্চারা। প্রায় প্রতিদিন এ রকম বর্বরোচিত ঘটনা আখছাড় ঘটছে। শুধুমাত্র পরিসংখ্যান দিয়ে ঘটনার বীভৎসতার গভীরতা মাপা যাবে না। সমাজে অস্থিরতা, রাজনীতিতে হিংসার ববহিঃপ্রকাশ, অসামঞ্জস্যপূর্ণ সমাজ যখন তৈরি হয়, তখন এ ধরনের অবক্ষয়ের প্রবণতা বাড়ে। রাষ্ট্র যদি চোখে ঠুলি পরে থাকে তাহলে এ ধরনের নারকীয় ঘটনা উত্তোরোত্তর বৃদ্ধি পাবে।
একবিংশ শতাব্দীতে এসেও কন্যাদেরকে মনে করা হয় অনুৎপাদক, অর্থনৈতিক বোঝা। তার প্রধান কারণ অনেক সমাজে বিয়ের সময় কন্যা পক্ষকে বিশাল পরিমাণ পন দিতে হয় ছেলে পক্ষকে। এমনকি শিক্ষিত পরিবারেও পণপ্রথার বলি হয় মেয়েরা। আইনকে বুড়ো আঙ্গুল দেখিয়ে এই সামাজিক ব্যাধি এখনো বহাল তবিয়তে। মধ্যযুগীয় ধ্যানধারণা, মেয়েরা শুধু গৃ্হস্থালির কাজ করবে এবং পুরুষদের আনন্দ দেবে।মেয়েদের কেবল সন্তান উৎপাদনের মধ্যেই সীমাবদ্ধ রাখা হয়। স্কুলছুট ছাত্রীর সংখ্যা অনেক বেশি। এশিয়ান ফাউন্ডেশন সংস্থার তথ্য অনুসারে লিঙ্গ বৈষম্যের ক্ষেত্রে ১৪৬টা দেশের মধ্যে ভারতবর্ষের স্থান ১২৭।
প্রতিটি শিশুকন্যার নিরাপদ জন্ম, সুরক্ষা, পুষ্টি, শিক্ষা, স্বাস্থ্যের সার্বিক বিকাশে বিশেষ প্রাধান্য দিতে হবে। কন্যাদের আরো বেশী ক্ষমতায়ন সমৃদ্ধ ও দক্ষ করে তুলতে হবে। কন্যারাই সমাজের মূল স্তম্ভ। ব্রিগহাম ইয়ং-এর উক্তি এ প্রসঙ্গে উল্লেখ্য – একটা ছেলেকে শিক্ষিত মানে একটা মাত্র পুরুষকে শিক্ষিত করা কিন্তু তুমি যদি একটা কন্যাকে শিক্ষিত করো তাহলে গোটা জাতিকে তুমি শিক্ষিত করবে। বর্তমান পৃথিবীতে মহিলারা শিক্ষা, খেলাধুলা, রাজনীতি, সাংবাদিকতা , শিল্প-সংস্কৃতি, বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি, এবং বিভিন্ন কর্মক্ষেত্রে পুরুষদের সঙ্গে পাল্লা দিয়ে কাজ করছে।
আন্তর্জাতিক শিশুকন্যা দিবসের মূল লক্ষ্য এবং উদ্দেশ্য সমাজে কন্যাদের সামাজিক, অর্থনৈতিক, আইনি, রাজনৈতিক এবং মানবিক অধিকার সুপ্রতিষ্ঠিত করা এবং লিঙ্গ বৈষম্য দূর করা। এটা খুব কঠিন এবং বিরাট কাজ। লিঙ্গ বৈষম্যহীন সুশীল সমাজ তৈরি করতে আমাদের সকলকে খোলা মনে এ ব্যাপারে এগিয়ে আসতে হবে। আমাদের মনে রাখা দরকার শক্তি, ক্ষমতা, কৃষ্টির উৎস কন্যারাই সমাজে আনতে পারে পরিবর্তন ও প্রতিষ্ঠা করতে পারে সবার জন্য উন্নত ভবিষ্যত। বিখ্যাত হলিউড অভিনেত্রী মেরিলিন মনরো যথার্থই বলেছিলেন –Give a girl the right shoes and she can conquer the world. এ মূহুর্তে বাংলাদেশের জাতীয় কাজী কবি নজরুল ইসলামের কবিতার দুটি লাইন ভীষণভাবে মনে পড়ছে —
বিশ্বের যা কিছু মহান সৃষ্টি চির কল্যাণকর,
অর্ধেক তার করিয়াছে নারী, অর্ধেক তার নর।
দীপক সাহা (প্রাবন্ধিক)কলকাতা,ভারত।
Leave a Reply