মঙ্গলবার, ১৩ মে ২০২৫, ০২:৫৬ পূর্বাহ্ন

আমার সমুদ্রবিলাস

পর্ব৩
সোনিয়া তাসনিম খান

প্লেন রানওয়ে দিয়ে ছুটতে শুরু করলে, মনে মনে দোয়া কালাম পড়তে থাকি। প্লেনের দৌড় দেখে মনে হচ্ছিল হলিউড মুভির কোন ডাইনোসর বুঝি শিকারের দিকে ধেয়ে যাচ্ছে। গতি একসময় একটু কমে এল এবং প্লেন আস্তে করে উপরে উঠে কিছুটা ব্যালেন্স নিয়ে আকাশের বুকে ঈগল পাখির মত ভেসে উঠল। এসময় দুকান বার বার চেপে আসছিল গ্রাভিটিয়েশেনের বিরুদ্ধাচরণ করার জন্য। বার বার খালি ঢোক চাপছিলাম সেই সময়ে। কিছু সময় পর অবশ্য স্ট্যাবল হলাম। সীটে বেল্ট আলগা করে এবারে আরাম করে বসি। উইন্ডোসাইড এ ছিলাম। জানালার দিকে ঘেঁষে নীচের দিকে তাকালাম একি! এটা কি আমাদের প্রাণের শহর ঢাকা! একে তো মনে হচ্ছে বুয়েট স্টুডেন্টদের হাতে তৈরী কোন মডেল! প্লেন হালকা টাল খেয়ে আরও ওপরে উঠল। এবার শুধু মেঘ আর মেঘ! আশ্চর্য মেঘেরও কত রং! কখনো মনে হয় এরা সফট টয়ের আকার ধারণ করে, কখনও পেঁজা তুলারাশি মনে হয়, কখনও বা এরা জমাট বাঁধা ঘন এক কয়লাস্তুপের মত প্রতীয়মান হয়ে উঠছে। সূর্যের ঝলমলে তীর্যক রশ্মি মেঘ ফুড়ে এদের সৌন্দর্যকে যেন আরও বিমূর্ত করে তুলে এক অনিন্দ্য ক্যানভাসে বন্দী করে ফেলছে। সে এক মহাশিল্প! মাঝে মাঝে মেঘের ঘনআস্তর ফুঁড়ে নীচে জলরাশি দেখা যাচ্ছে। নতুন আবিষ্কারে কোন আবিষ্কারক যেমন শিহরিত হয় ঠিক আমি যেন আমার মধ্যে তেমন ই এক শিহরণ অনুভব করলাম।

:আপনি যাচ্ছেন কোথায়?

পাশের ভদ্রলোকের কথায় ভাবনায় ছেদ পরল।

: মানে জানতে চাচ্ছিলাম ব্যাংককে কোথায় যাচ্ছেন?
: আমি আর্মস্টাডাম যাচ্ছি। ব্যাংককে আমার ট্রানসিট। অ্যারাউন্ড ফর নাইন আওয়ারস!

আমি উত্তর দিলাম।

: পড়তে যাচ্ছেন?
: না। আমার হাসব্যান্ডের সাথে শীপে জয়েন ইন করতে। হি ইজ অ্যা সীম্যান।
:ও! দারুণ! প্রথমবার না এর আগেও গিয়েছেন?
: না এবারই প্রথম।
:ও

এরই মাঝে হালকা স্ন্যাকস পরিবেশিত হলো। স্যান্ডউইচ, বাটার, কিছু ফ্রুটস। শেষে কফি নিলাম। কফি খেতে খেতে আরও আলাপ গড়ালো ভদ্রলোকের সাথে। বেচারা তার চার মাসের বাচ্চাকে বড়ই মিস করছে। উনি এতটাই আবেগতাড়িত ছিলেন যে তিনি তার ওয়ালেট থেকে তার পিচ্চির ছবিটা বের করে দেখালেন। আহারে! বেচারা! পৃথিবীটা বড়ই অদ্ভুত! তাতে অদ্ভুত সব সম্পর্কের মায়া। একেকটা সম্পর্ক একেক রকম মায়ার বাঁধনে বাঁধা! এই মায়ার টানেই তো মৃত্যুপথযাত্রী আক্ষেপ করে বুঝি ভাবে “ইস! আরও কিছু সময় যদি পেতাম! ” ইয়ার স্পীকারে লাইট মিউজিক শুনছিলাম হঠাৎ কেন যেন খুব রোমান্চকর লাগল। মনে হলো এই ভেবে যে, বিয়ের পর থেকে ও জাহাজে গেলে সবসময় দিনগুণি কখন ও আসবে? এবার ও হয়তো সময় ক্ষেপণ করছে এই আশায় কখন আমি ওর সামনে যেয়ে দাঁড়াবো? তাই না? মনে মনে ওকে বলি “এই তো, আরও কয়েক ঘন্টা মাত্র!”

রোমান্টিক চিন্তা চালুই ছিল বাঁধ সাধল এয়ার বাম্পিং! বাপরে! অত বড় প্লেন! কি ঝাঁকুনিটাই না খেল! স্পীকারে প্যাসেন্জারদের আবার ইন্সট্রাকশান দেয়া হলো সীটবেল্ট আবার বেঁধে নেবার জন্য। এরই মাঝে এক থাই ভদ্রলোক ওয়াশরুম গিয়েছিলেন কিনা তখুনি এই বিভ্রাট! বেচারা বাইরে এসে হচকিত ভাবে সীট গ্রহণ করে তার সাথীদের কি যেন বল্লেন আর অন্যরা তার প্রতি সীমপ্যাথি দেখানো তো দূর তার বিব্রতকর পরিস্থিতির মজা নেয়া শুরু করলো। বেচারা আর কিছু না বলে চুপ হয়ে গেল। এমন টুকরো টুকরো কিছু ঘটনা ঘটতে ঘটতে তিন ঘন্টা কোথা দিয়ে যেন কেটে গেল বুঝতেই পারলাম না! পাশের ভদ্রলোক তার কুম্ভকর্ণ ঘুমের অবশেষে ইতি টানলেন। স্পীকার আবার সচল হলো

‘প্লিজ ফাস্টেন ইওর সীটবেল্ট।’

প্লেন নীচে নামতে শুরু করে। প্লেনের উইংগসের বিভিন্ন পার্ট স গুলো তার বিভিন্ন ফাংশান করা আরাম্ভ করল এবং প্লেনের চাকা আস্তে করে রানওয়ে স্পর্শ করল এবং সেই সাথে শুরু হলো তার ক্ষীপ্র গতিতে দৌড়ে চলা। একসময় প্লেন থেমেও গেল। যাত্রীদের সাঁড়ির সাথে এক্সিট ওয়ের দিকে এগিয়ে গেলাম। এয়ার হোস্টেসরা কলের পুতুলের মত মাথা নেড়ে ধন্যবাদ এবং শুভকামনা জানালো। গ্যাংওয়ে অতিক্রম করে ব্যাংকক এয়ারপোর্টে পা রাখলাম। আমি বিস্মিত এবং বিস্মিত! এ এক অন্য দুনিয়া! আশ্চর্য একই পৃথিবী, কিন্ত এর একেক জায়গায় একেক বৈচিত্র! বিচিত্রতা এর মানুষে! বিচিত্রতা এর ভাষাতে! বিচিত্রতা এর সংস্কৃতিতে।

(চলবে)

এই সংবাদটি শেয়ার করুনঃ

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *




raytahost-demo
© All rights reserved © 2019
ডিজাইন ও কারিগরি সহযোগিতায়: Jp Host BD