বৃহস্পতিবার, ২০ মার্চ ২০২৫, ০৮:০৯ পূর্বাহ্ন

ইন্দু

– দীপক সাহা

গাঢ় অন্ধকারে কিছুই ঠাহর করা যাচ্ছে না ….।…কালো মেঘের বুক ফেড়ে বেরিয়ে আসা বিদ্যুৎ এর আলোয় পদ্মার ভয়ঙ্কর রূপ ঠিকরে আসছে। শান্ত জল অশান্ত হয়ে উঠেছে, সহস্র ফণা তুলে ফোঁস ফোঁস করতে করতে এগিয়ে আসছে, সাদা ফেনায় ফুলে উঠেছে, রাগে ফুঁসছে, গগনবিদারী তর্জন গর্জন … বারে বারে নৌকার ওপর আছড়ে পড়ছে, নৌকা টালমাটাল …নাসির প্রাণপনে দাঁড় বাইছে, কিন্তু প্রকৃতির এই রুদ্র মূৃর্তির পাশে সবকিছু তুচ্ছ। আচমকা নৌকায় জল ঢুকছে, নৌকার তলা ফেটে গেছে, তলিয়ে যাচ্ছে নৌকা আর নাসির জলের মধ্যে হাবুডুবু খাচ্ছে …..

মাথায় নরম হাতের স্পর্শে নাসির ধড়মড় করে চৌকির ওপর উঠে বসলো। স্ত্রী মল্লিকা, কিগো ওরকম করছ কেন? স্বপ্ন দেখছ নাকি? তরতর করে নাসির ঘামছে…, বুকের কলিজা ঘনঘন ওঠানামা করছে। এক গ্লাস জল মল্লিকা নাসিরের হাতে তুলে দিল। ঢকঢক করে জল খেয়ে কিছুক্ষণ পর নাসির ধাতস্থ হয়ে দেখে বিছানায় পাশে ছেলে-মেয়ে দুটি অঘোরে ঘুমোচ্ছে। উঠোনে রাখা মাছ ধরার বড় জাল আর বৈঠা হাতে বেরিয়ে পড়লো সে।

জোছনা রাতের পদ্মা অপরূপা। পদ্মার এ দিকটায় দিনের বেলায় লোকজনের আনাগোনা। কিন্তু গভীর রাতে একেবারে নিঝুম। এই সময়টা নাসিরের বেশ লাগে। প্রকৃতিকে একান্তে পায়। সে পদ্মার পাড়ে তরতরিয়ে নামছে। মাথার উপর চাঁদ দেখে বুঝলো রাত অনেক বাকি। এখনো আকাশের চাঁদ, তারারাই নাসিরদের জানান দেয় রাতের মুহূর্তগুলো।

নাসির সাদা বালির ওপর বসে পড়ল। এখনো, মলয়, সহিদুল আসেনি, ওরা নাসিরের মাছ ধরার সঙ্গী। কাছেই তার মাছ ধরার নৌকো উপুর হয়ে শুয়ে, পাটাতনের গায়ে লেখা ইন্দু নামটা চাঁদের আলোয় চিকচিক করছে। বড় আদর করে এই নাম রাখা, তার প্রথম ভালোলাগা, ভালোবাসাকে মনে রেখেই। নৌকোটিকে ঢেউয়ের ছন্দে চালনা করতে করতে নাসির খুঁজে ফেরে তার ইন্দুকে। …তারপর যখন খোল জুড়ে রুপোলি মাছে ভরে যায় তখন নাসির নিশ্চিন্তে গা বিছিয়ে দেয় ইন্দুর কোলে…।

অন্যদিন এই সময় বালির উপরেই ঘুমিয়ে পড়ে সে। আজ ঘুম আসছে না। দুঃস্বপ্নটা বারে বারে ভিড় করছে মনে। অনেকক্ষণ হয়ে গেল নাসির বালির পিঠে শুয়ে, … চাঁদটা সবে পদ্মায় স্নান সেরে আকাশে উঠে এসেছে। তার রূপের আলো বিস্তীর্ণ পদ্মার পার ছুঁয়ে,পদ্মায় ঝরে পড়ছে অবিরত। চাঁদের আলোয় মলয় আর সহিদুলের অস্পষ্ট মুখ দেখে নাসির উঠে পড়ে। এবার ভাসাবে তরী। মাছ ধরে,বাজারে বিক্রি করে ফিরতে ফিরতে বেলা গড়িয়ে যায়। সারা রাত জেগে মাছ ধরতে হয়; তারপর বাছাই করা, আড়তদারের সঙ্গে দর কষাকষি; অনেক ধকল।

সময়ের ভেলায় নাসির ফিরে যাচ্ছে সেই প্রথম প্রেমে,ইন্দু দাঁড়িয়ে আছে নৌকার পাটাতনে। মেয়েটির রোজ বায়না বাবার সাথে মাছ ধরতে যাবে পদ্মায়, সময় সুযোগে স্টোভে চা, ভাত ফুটিয়ে পদ্মায় বাবার মুখে তুলে দেবে। মা মরা মেয়েটি বাবাকে কাছছাড়া করতে চায় না। বাবা পরাণ গাইন মেয়েঅন্ত প্রাণ, তাই মেয়ের আবদার মেনে নেয়। নাসিরও কিশোরী ইন্দুর মিষ্টি কথা, চপলতা আর সরলতায় হাবুডুবু খায়। মনে মনে ভালোবাসে। নাসির তখন কৈশোর পেরোনো সদ্য যুবক, বাবার সাথে বেরিয়ে পড়ে মাছ ধরার খুঁটিনাটি কৌশল রপ্ত করতে। পরাণ আর নাসিরের বাবা দুই বন্ধু একসাথে মাছ ধরতে যায় পদ্মায়। কিন্তু সেদিন নাসিরের বাবার কাঁপুনি দিয়ে জ্বর আসায় পরাণ একাই পদ্মায় নাও ভাসিয়েছিল মেয়েকে সঙ্গে করে…। আর ফেরেনি। মাঝরাতে হঠাৎ তুমুল ঝড়ে নৌকাসহ বাপমেয়ে পদ্মায় তলিয়ে যায়।

তারপর পদ্মা দিয়ে অনেক জল বয়ে গিয়েছে…নাসিরের লুকোনো কান্নার নোনা জল মিশে গেছে পদ্মার ঢেউ-এ। বউ ও দুটি ছেলে নিয়ে সে এখন সংসারী। পদ্মার ঢেউয়ের সাথে জীবনতরীর হাল বাইতে সে এখন ব্যস্ত। পদ্মার বুকেই তার জীবনসংগ্রাম …কোনও এক গাংচিলের তীক্ষ্ণ চিৎকারে নাসিরের ঘোর কাটে, চোখ মেলে বালির ওপরে উঠে বসল। মলয়, সহিদুল এখনো আসেনি, আজ বোধহয় আসবে না আর। জেলে নৌকার ছইয়ের ভেতর লণ্ঠনের আলো গুলো জোনাকির মতো টিম টিম করে ঘুরে বেড়াচ্ছে। আজ পূর্ণিমা, ভরা কোটাল। নাসির এগিয়ে গেলো নৌকার দিকে, নাসিরের স্পর্শ ইন্দুর গায়ে, “চল ইন্দু মাঝ দরিয়ায় ’’।

উঠোনে হাঁটুর মধ্যে মাথা গুঁজে বসে আছে নাসির। আকাশের অবস্থা ভালো নয়। দুপুরেই রাতের অন্ধকার নেমে এসেছে। কে যেন একটা কালো রঙের পোছ দিয়েছে খোলা আকাশটাকে। সকাল থেকেই কিছু সময় অন্তর ঘোষণা হচ্ছে ঝড়ের পূর্বাভাস। আর কয়েক ঘণ্টা পরেই ঘন্টায় দুশো কিমি.বেগে বয়ে যাবে ঘূর্ণিঝড় আমফান। একটা চিন্তার মেঘ ঘোরা ফেরা করছে নাসিরের মুখেও। স্থানীয় প্রশাসন স্কুল বিল্ডিং-এ সকলের থাকার ব্যবস্থা করা হয়েছে, পরিবারকে নিয়ে আজ রাতটা ওখানেই কাটাবে নাসির। কিন্তু নাসিরের ভাবনা যত তার নৌকাটা নিয়ে। আজ তার যা কিছু, সব ওই নৌকার দৌলতে, ছেলেমেয়ের পড়াশোনা, সংসারের খরচ সব কিছুই নৌকাটাই জোগাড় করে।

নাসির উঠে পড়লো, বাড়ি থেকে বেরিয়ে পদ্মার দিকে এগিয়ে গেলো, মল্লিকা পেছন থেকে ডাক দিল “আজ যাওনি, বিপদ আসতেছে।” নাসির ভ্রূক্ষেপ করে না, নদীপাড়ে নেমে এগিয়ে যায় নৌকার দিকে। নৌকাটা উপুড় হয়ে পড়ে আছে অভিমানী প্রেমিকার মতো বালির চড়ায়। আকাশে কালো ধোঁয়ার কুণ্ডলীর মতো মেঘ জড়ো হচ্ছে। পদ্মার ঘোলাটে ধূসর জল ফুলে ফুলে উঠে ক্রুদ্ধ নাগিনীর মতো এগিয়ে এসে বিষাক্ত ছোবল মারছে তটে…আর সাদা ফেনায় উগড়ে দিচ্ছে তার বিষ। দু-একটা বক দমকা হাওয়ায় বেসামাল হয়ে উড়ে যাচ্ছে বাসায়। নাসির হাঁটু গেড়ে বসে পড়ে নৌকার পাশে, আস্তে আস্তে পরম মমতায় নৌকার গায়ে হাত বোলায়, উঠে গিয়ে নোঙরটা মোটা গাছের সাথে ভালো করে বেঁধে দেয়। আরও দু একটা গাছের সাথে বাঁধা কাছি গুলোর বাঁধন পরীক্ষা করতে করতে….,মনে মনে ভাবে পৃথিবীতে প্রেমের বাঁধনই সব থেকে শক্ত বাঁধন;সেই বাঁধনেই যখন ইন্দুকে আগলে রাখতে পারলো না এই কাছি আর কি করবে একটা করুণ হাসি ঠোঁটের পাশে বেরিয়ে এসে চোখের জলের সাথে মিশে গেলো…।

নাসির বহুবার ঝড়ের তাণ্ডবের মুখোমুখি হয়েছে কিন্তু আজ রাতের অভিজ্ঞতা সম্পূর্ণ আলাদা। গত বছর ঝড়ে ঘরের চাল উড়ে গেছিল। কিন্তু তার মন পড়ে আছে নৌকাটির দিকে। সারারাত কাটলো উদ্বেগ নিয়ে সবার। ঝড়ের তাণ্ডবলীলা আর মুষলধারে বৃষ্টির উচ্চস্বরে মানুষদের হাহাকার চাপা পড়ে যাচ্ছে। মল্লিকা ছেলেমেয়ে দুটোকে নিয়ে অন্যদের সাথে স্কুলের হল ঘরে বসে আছে। নাসির অধৈর্য্য হয়ে উঠছে। কতক্ষণে সকাল হবে…

শেষ রাতে ঝড়ের বেগ কমে আসে। ভোর হয়েছে অনেক্ষণ কিন্তু সূর্যের মুখ দেখা যাচ্ছে না। কাল রাতের রেশ টেনে আজও প্রকৃতি ভারাক্রান্ত। ঝড় থেমে গেছে কিন্তু বৃষ্টির বিরাম নেই। নাসির বৃষ্টির তোয়াক্কা না করেই ছুটছে নৌকার কাছে….দৌড়ে গেল নৌকা বাঁধার জায়গায়…নাহ কোনো চিহ্ন নেই তার। নোঙর লাগানো গাছটা উপরে পড়ে কিছুটা পদ্মার গভীরে, কাছির ছেঁড়া অংশ ঝুলছে গাছের গায়ে…. পদ্মাতটে ভাঙা কাঠ, ভাঙা ঘরের চাল, ভাঙা নৌকার টুকরোর ভীড়ে ইন্দুকে পাগলের মতো খুঁজতে থাকে, পায় না। ..নাসির হাউ হাউ করে কাঁদতে কাঁদতে পদ্মায় ঝাঁপিয়ে পড়ে… আর্তনাদ করে বলে –“আর কতবার ইন্দুকে লইবি রাক্ষুসি….”। ঢেউয়ের ঝাপটায় একটা ভাঙা তক্তা নাসিরের বুকের কাছে ফিরে আসে….নাসির কোনো রকমে জাপটে ধরে দেখে….তক্তার গায়ে জ্বল জ্বল করছে লাল রঙে লেখা – “ইন্দু”।

দীপক সাহা ( পশ্চিমবঙ্গ)

এই সংবাদটি শেয়ার করুনঃ

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *




raytahost-demo
© All rights reserved © 2019
ডিজাইন ও কারিগরি সহযোগিতায়: Jp Host BD