সোনিয়া তাসনিম খান
রাত তখন অনেক গভীর। নিকষ কালো আঁধারের সাথে ঝিঁঝিঁ পোকার ডাক কেমন অস্বস্তির মাত্রা কে আরও বাড়িয়ে তুলছে। মন্থর বাতাসে খেলছে শীতল আমেজ। ধান ক্ষেতের মাঝে জেগে ওঠা আলের কাঁদা প্যাকে কিছু ধূসর ব্যাঙ লাফিয়ে অন্ধকারের মাঝে ডুবে যায়। শিম শিম বাতাসে আন্দোলিত হচ্ছে ধানের শীষ। হঠাৎ করে মনে হয় অশরীরী কোন অস্তিত্ব যেন পিছু ডাক দিয়ে যাচ্ছে। আকাশের বুকে এতক্ষণ সাঁতরে বেড়ানো যে শ্বেত, দুধেল শশাংক মোম জোছনা ঝড়িয়ে যাচ্ছিল, ওটা আচমকা মেঘের আড়ালে গুটিশুটি মেরে লুকিয়ে গিয়েছে। অন্য সময় হলে জোৎস্নার এমন লুকোচুরি খেলাতে বিরক্ত হয়ে যেত তারেক। তবে আজ মোটেও রুষ্ট হলো না ও, বদলে কেমন এক স্বস্তি অনুভব করল যেন। আজ বুঝি আড়ালে থাকা প্রকৃতিও ওর অন্তর্ধান পর্বের নেপথ্য সাথী হয়ে চলছে। আঁধারের মাঝেও তাহলে এক পরম শান্তি লুকিয়ে থাকে! তা আজ নতুন করে অনুভব করল তারেক। গ্রামের ডাকাবুকো নওজোয়ান তারেক শেখ। তামাটে মুখাবয়বে কেমন এক কাঠিণ্য! তাতে কি অদ্ভুত এক দ্যুতি! এই নিকষ তমসার মাঝে জ্বলে উঠছে। বিদ্রোহী দু’নয়ন যুগলে কি এক দুর্বার নেশার হাতছানি। এলোমেলো কোঁকড়া চুলগুলো নেমে এসেছে ঘাড়ে। বাতাসে আরও আলু থালু হয়ে পড়ছে ওরা। ওর মাথায় বেঁধে নেওয়া লাল পট্টির মাঝে অজানা এক সংকল্প কোন বাঁধা পড়ে গেছে। তারেক দ্রুত বেগে হাঁটছে। ওর চলার গতি যেন বাতাসের গতি কেও পেছনে ফেলে দিচ্ছে। দূরে কোন বাঁশঝাড়ে বাতাসের ছন্দ জেগেছে শনশন। একটা শেয়াল ডাকল বুঝি খুব কাছ থেকে। একবার, দুবার, তিনবার। তারেক থমকে দাঁড়ায়। সংকেতটা গভীর মনোযোগ দিয়ে বুঝবার চেষ্টা করে ও। ঐ তো আরো একবার। নাহ! কোন ভুল নেই। এমনটাই হবার কথা ছিল। ওর চলার দিশা ঠিক পথই নির্দেশ করছে। তারেক আবারও পা চালায়। গাঁয়ের পথের ধূলো মাটিতে ভরে উঠেছে ওর পদ যুগল। মৃত্তিকা ফুঁড়ে উদগত হয়ে আসা সেই সোঁদা ঘ্রাণ যেন মুক্তির মাদকতা ছড়িয়ে দেয় চন্চল চিত্তে। দু একটা কুকুরের ডাক রাতের নি:স্তব্ধতাকে চৌচির করে দিচ্ছে। “ হুয়াও…হু…” ঐ তো! আরও একটা শেয়াল ডাকল বুঝি। তারেক এবার রীতিমত ছুটতে থাকে। ও ছুটছে তো ছুটছেই। অন্তহীন দৌড়ে সামিল হওয়া ওর বিরামহীন পায়ের গতি এক সময় স্থির হল সুবিশাল জলরাশির সম্মুখে। এই তো ওদের কাকলি নদী। যার কোলে হেসে খেলে কেটেছে শৈশব, জন্ম নিয়েছে তারুণ্য। যে স্রোতস্বীনী ওকে পরতে পরতে পাঠ পড়িয়েছে মুক্ত জীবনের। যার আঁচলে নির্ভয়ে আশ্রয় নিয়েছে এই শান্তি প্রিয় নিশিপুরের স্বস্তি। আজ সেই স্বস্তির পালে উল্টো হাওয়ার গতি লেগেছে। সেই পালে নির্মল শান্তি ফিরিয়ে আনতে আজ ঘর ছেড়েছে তারেক। আজ এই বহতা নদীর বেগবান গতি ওকে পৌঁছে দেবে ওর জীবনের সেই চরম প্রান্তে; যে প্রান্ত থেকে জীবন আবারও স্বপ্ন দেখতে শিখবে নতুন করে ঘুরে দাঁড়াবার, নতুন করে বেঁচে থাকবার। বুক ভরে এই মাটির ঘ্রাণ নেবার! ভাবনার দোলাচলে দুলতে দুলতে ঘাটে পৌঁছে যায় তারেক। সেখানে মৃদু স্রোতের লয়ে দুলছে ছোট এক তরী। তাতে সওয়ার হয়ে রয়েছে ওর মতই কতজন স্বপ্নালু ভবঘুরে। এদের কেউ বা চাষা, কেউ বা মাঝি, কেউ বা হতচ্ছাড়া বাউন্ডুলে। কিন্তু আজ নিয়তি এদের গ্রথিত করেছে একই সুরে, সেই সুর স্বাধীনতার সুর। তারেক এক পা নাওয়ে তুলে নেয়
– আইলা ভাইজান, কেউ আলাপ পায় নাই তো?
রাসুর গলা। আশ্চর্য! চাল চুলোহীন, লাজুক, উদাসীন সেই যুবকের গলার স্বরে আজ যেন আত্মবিশ্বাস আর দায়িত্ববোধের ঝংকার বেজে উঠছে। এ যেন মুখোশের আড়াল থেকে বেড়িয়ে পড়া এক অজানা, অচেনা, নির্ভীক দৃঢ়চেতা সত্ত্বা।
– সব ঠিক আছে তো ভাইজান?
মাথা নাড়িয়ে হ্যাঁ বলে তারেক।
– খালাম্মা রে কইছ?
ক্ষণিকের জন্য থমকে যায় তারেক। মমতা মাখা একটা মুখ উঁকি দেয় মানস পটে। মা যখন জানতে পারবে তখন কি করবে? রাগ করবে কি? কেঁদে কেটে বুঝি বুক ভাসিয়ে ফেলবে একদম। গলার কাছে আবেগের বাষ্প জমে উঠল এক দলা। একটু বুঝি দুর্বল হয়ে পড়েছিল ও। চট করে আবেগকে সরিয়ে নিল সহজেই। “মা”…মা কে মুক্ত করতেই তো আজ ঘর ছাড়ছে এই দামাল ছেলের দল। এখন দুর্বল হলে চলবে না। শক্ত হতে হবে। পাহাড়ের সম অটল হতে হবে। তবেই না মুক্ত হবে দেশ। হেসে উঠবে শ্বাশতময়ী বঙ্গ মাতা। সেটা ভেবে নিয়ে ইস্পাত দৃঢ় উত্তর ভেসে আসে পরমুহুর্তেই
- চিঠি থুইয়া আইছি। চিন্তা নাই।
উত্তর করে তারেক স্মিত হাসি হাসে এবার। ওর সঙ্গে যোগ দেওয়া আরও জন পাঁচেক তরুণের প্রত্যয়ী হাসি যেন তমস্রা কে ম্লান করে দিল অনায়সে। ভাবাবেগে ভরা স্বপ্ন বিভোর দৃষ্টি সকল চকচক করে ওঠে পুণরায়। সুঠাম, সবল হাত এবারে ধরে নেয় কান্ডারী। দৃপ্ত, আত্মবিশ্বাসী কন্ঠ ছড়িয়ে পড়ে অনীল পবনে
– চল তবে…
– হ্যাঁ। চল…জয় বাংলা
- জয় বাংলা
ছোট দুটি শব্দ। কিন্তু তাতে বুঝি লাখো কন্ঠের বজ্র নাদ ছলকে উঠল। ছলাৎ ছলাৎ ছন্দ তুলে তরী একটু একটু করে এগিয়ে যাচ্ছে ওর স্বীয় লক্ষ্যে। খেয়াতে সওয়ার সকল যাত্রীর যে গন্তব্য একটাই। একটাই অভিলাস, একই অভিপ্রায়। তা হলো মুক্তি…মুক্তি এই আঁধার বৃত্ত বলয় থেকে। মুক্তি এই পরাধীনতার শিকল থেকে। মুক্তি শকুনের নখর থাবার আঁচর হতে। ওরা ছুটছে! ছুটছে সেই ক্ষণ ছিনিয়ে আনতে, যেদিন নির্ভয়ে নির্মল হাসি হাসতে থাকবে না আর কোন ভয়, কোন সংশয়। নতুন দিনের সেই লাল সূর্যকে ছিনিয়ে নিতে ওরা আজ পাড়ি দিচ্ছে দূরে বহুদূরে। ওরা ফিরবে। ওদের যে ফিরে আসতেই হবে। আর ওরা ফিরবে কোন নতুন এক ভোরে, এক মুঠো লাল সবুজ সঙ্গে নিয়ে।
Leave a Reply