শান্তা মারিয়া
বুড়ির হাতে চাঁদের আলো পড়ে অদ্ভুত দেখাচ্ছে। মনে হয় অনেক যুগ এই হাত চাপা পড়ে ছিল মাটির নিভৃতে। শ্যাওলা ধরা ত্বক, শিকড়ের দৃশ্যমানতায় শিরা উপশিরার জাল তার হাতের উপর বিছিয়ে আছে। বুড়ির কথায় পুরানো এক গ্রাম্য সুর। এই সুর আজকের নয় কিছুতেই। সেই রাঢ়, বঙ্গ, সমতট, হরিকেল জনপদের কথার টান তার মায়াবী কণ্ঠে। ও হয়তো এই একই গল্প বলে চলেছে প্রতি কবোষ্ণ পূর্ণিমায়। সেই গল্পের সুরে সুরে মাথা দোলাচ্ছে আরণ্যক বাতাস। জোছনায় কালচে রং ধরা গাছেরা তাদের নির্লিপ্ত মুখোসের আড়ালে মুখ লুকিয়ে শুনছে কুহকিনীর কাহিনী। বাঁশবনের ভিতর দিয়ে বাতাস বওয়ার শব্দ কণ্ঠে তুলে মাটির ঘরের ছোট্ট দাওয়ায় বসে বুড়ি বলে চলেছে তার জীবনের নিগূঢ় কাব্য। জোছনা এসে পড়েছে ছনে ছাওয়া কুটিরের চালে। সেসব বুড়ির যৌবনকালের গল্প। নাম তার সুন্দরী। সোনারবরণ কন্যা, মেঘবরণ কেশ। দেহে তার তখন সাগরের উত্তাল ঢেউ। সেই জোয়ারে, সেই পানপাতা মুখের জৌলুসে, জোছনামাখা হাসির ঝলকে কত পুরুষ তাকে কামনা করেছে। কত পুরুষ ধরা দিয়েছে শংখিনীর মোহে। তাদের কেউ ছিল উজান গাঙের দুরন্ত মাঝি, কেউ ছিল সর্দার লাঠিয়াল, কেউ অরণ্যের তুখোড় শিকারী। সবাই তারা জোয়ান মর্দ। পুরুষকে কিভাবে বশ করতে হয় তা সেকালে সুন্দরীর চেয়ে বেশি আর কে জানতো।
বুড়ি বলে,তখন ভাবছিলাম তারা আমারে ভালোবাসে। কিন্তু আজ বুঝি, রূপ আর যৌবন ছাড়া তারা আমার কাছে আর কিছুই চায় নাই।
বুড়ির আক্ষেপে মাটির গভীরে শুয়ে থাকা তার প্রেমিকদের শবদেহগুলো প্রতিবাদে পাশ ফিরে শোয়। অনেক আগেই ধুলো হয়ে যাওয়া পুরুষের প্রেম মাটির গভীর থেকে হাত বাড়িয়ে দিতে চায়।
মনীষা মন্ত্রমুগ্ধ হয়ে বুড়ির কথা শোনে। কিন্তু কথাগুলো সে বিশ্বাস করতে পারে না। তার অস্তিত্বের নিবিড় প্রদেশে যদিও সে জানে এটাই হয়তো জীবনের চরম সত্য কিন্তু তার চেতনের উপরিস্তরে যেখানে মেধা ও মননের বাস সেখানে প্রতিবাদ জাগে। তার অস্তিত্ব উপহাস করে বলে, তুই কি ভাবিস তোর মেধা তোর রূপের চেয়ে দামি? নির্বোধ রূপ ছাড়া তোর আছে কি? মনীষার মনে পড়ে যায় মাত্র গত সপ্তাহে তার প্রেমিক সৌরভ প্রতিশ্রুতিতে তাকে মুগ্ধ করেছে। সৌরভ ও মনীষা দুজনেই কক্সবাজার বান্দরবানের একটি বিদেশি এনজিওতে কাজ করছে কয়েকবছর ধরে। বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাস থেকেই তাদের যৌথ জীবনের স্বপ্ন প্রবাহিত হয়েছে কর্মক্ষেত্রে। দশ বছর ধরে বহতা প্রেম। হয়তো আর কয়েক মাসের মধ্যে তারা বিয়ে নামক সামাজিক প্রতিষ্ঠানটির সদস্য হয়ে যাবে। কিন্তু বিয়েতে সৌরভের যতই আগ্রহ থাক মনীষা দ্বিধা ছাড়তে পারে না। বিয়ের সিদ্ধান্ত নেয়ার আগে তার প্রশ্ন জাগে সৌরভের ভালোবাসার যৌক্তিকতা নিয়ে। সোজা কথায় সে জানতে চায়, কেন সৌরভ তাকে ভালোবাসে? সে সুন্দরী, উচ্চশিক্ষিত, আর্থিকভাবে স্বচ্ছ্বল বলে? প্রশ্নটি যখন সে সৌরভকে করেছিল, মানুষটির চেহারায় একই সঙ্গে ঝলসে উঠেছিল অপমান ও অভিমান। তবে সৌরভের অনেক কথার ভিড়ে একটি কথা মনীষাকে নিশ্চিত করেছে। সৌরভ বলেছে,
রূপ তো শুধু বাইরে। তোমার চেয়ে সুন্দরী মেয়ে কি নেই? অনেক আছে। কিন্তু তোমার মতো মনের দিক থেকে সুন্দর আর তো কাউকে চোখে পড়ে না। শুনতে যদিও খুব ফর্মাল কথা বলে মনে হচ্ছে, তবুও বলি, আমি তোমার মেধা, তোমার মননকে ভালোবাসি। তোমার ভিতরের মানুষটাকে ভালোবাসি। তোমার সঙ্গে যে ইনটেলেকচুয়াল কমিউনিকেশনটা করতে পারি সেটাকে ভালোবাসি।
এনজিওর পক্ষ থেকেই তিনদিন আগে সৌরভ গিয়েছে নেদারল্যান্ডস। সেমিনার পেপার প্রেজেন্ট করতে। আর মনীষা এসেছে বান্দরবানের এই ছোট পাহাড়ি গ্রামটিতে তাদের জীবনমান নিয়ে ফিল্ড রিপোর্টের কাজে।
পাহাড়ি গ্রামটিতে আজ ভরা জোছনার প্লাবন। অরণ্য মাতাল হয়ে উঠেছে আলোর নেশায়।
বুড়ি বলে চলে,
আমার কথা অহন তোমার বিশ্বাস হবে না। একবার যদি আমার এই বুড়াকালটা তোমারে দিয়া তোমার যৌবন আমি নিতে পারতাম তাইলে তোমারে দেখায়া দিতাম, মনের মানুষ কেমনে তোমার বশে থাকে।
বুড়ির কথার তীব্র সুর মনীষার বিশ্বাসের ভিত্তিতে আঘাত হানে। একটা প্রতিযোগিতার আহ্বান, বিদ্রুপের আঁচ তার গায়ে জ্বালা ধরায়। এক দেহসর্বস্ব গ্রাম্য বুড়ির জন্য যা সত্য তা কি তার মতো মননশীল নারীর জন্যও? সৌরভ তাকেই ভালোবাসে কোন সন্দেহ নেই। তাহলেও সন্দেহের দোলাচল মনীষাকে আহত করে। সে তিক্ত কণ্ঠে বলে,
সেটা সম্ভব না জেনেই তুমি আমাকে এসব বলছো।বুড়ির ঠোঁটের কোণে নীলরঙা হাসি খেলা করে। সে বলে ওঠে,
জোছনা ফিনিক ফুটছে। আজকে সব কিছু সম্ভব।সাহস থাকলে বল।যাচাই হয়ে যাক কেমন তোর প্রেম।
মনীষার ভিতরে দ্যূতক্রীড়ার খেয়াল তীব্র হয়ে ওঠে।
বুড়ি তীক্ষ্ণচোখে মনীষার দিকে তাকায়। বুড়ির ইচ্ছা মনীষা বোঝে, মনীষার জিদও বুড়ির ভিতরে বিদ্রুপ জাগায়। চাঁদ বুঝতে পারে তাদের গোপন ইচ্ছার গলিঘুঁজি। কবেকার হরিকেল বন্দরে স্বপ্নডিঙা ভিড়ায় ভানুমতি।
কবোষ্ণ পূর্ণিমার জোছনা ঝরে পড়ে তাদের দেহে। প্রকৃতি খুলে দেয় বাস্তব-অবাস্তবের মধ্যে লুকিয়ে রাখা তার তৃতীয় দরজা। বুড়ির দেহ থেকে ফোটায় ফোটায় ঝরে যেতে থাকে বলিরেখা। মনীষার শরীর ভারি হয়ে ওঠে তার ছুঁড়ে ফেলা বার্ধক্যের চাপে।
বিদেশ থেকে ফিরে এসে মনীষাকে আর খুঁজে পায় না সৌরভ। মনীষা চলে গেছে তার জীবন থেকে। কোথায় কেউ জানে না। সৌরভ ভাবে মনীষা তাকে ইচ্ছা করেই ত্যাগ করেছে।
কিন্তু জীবন তো শূন্য থাকে না। সে জীবনে এসে দাঁড়ায় সুন্দরী। এই অরণ্যেই একদিন তার সঙ্গে পরিচয়। সুন্দরীর প্রেমে নিজেকে সমর্পণ করে সৌরভ ভুলতে চায় মনীষাকে। সুন্দরীও মনীষাকে দেখিয়ে দেয় জয়ের উচ্চতায় তার অবস্থান কোথায়।
সৌরভ সুন্দরীকে ভালোবাসার বাঁধনে যত শক্ত করে বাঁধতে চায় ততোই কোথায় যেন সুর কেটে যায়। প্রেমের যে কথাগুলো সে বলে তা যেন মুখস্ত আবৃত্তি। এমন মনভোলানো কথা সুন্দরী জন্ম-জন্মান্তরে শুনেছে কতশত বার। এইসব কথা তাকে আর দোলায়িত করে না। সৌরভ নিজেও ছন্দপতনটা বোঝে। বাঁশিটা কেবল বোঝা হয়ে রয়েছে আগের মতো সুর তুলতে পারছে না। সুন্দরী যেন শূন্যগর্ভ এক স্বর্ণমূর্তি। যার ভিতরে সৌরভের ভালোবাসার সংলাপ কেবলি ফাঁকা প্রতিধ্বনি তোলে। জয়ের নেশায় সৌরভের প্রেমে জড়ালেও সুন্দরীর রক্তনদী নিস্তরঙ্গ বয়ে যায়। আগেই জিতে নেয়া এক পুরনো খেলায় আর তার মন আবিষ্ট হয় না। এই প্রেম, ভালোবাসার নিগূঢ় কথন, মান অভিমান সবকিছুতেই ধীরে ধীরে ক্লান্তি এসে ভর করতে থাকে তার উপর।ভালোবাসার খেলায় বড় বেশি উত্তেজনা। বরং নিজের সেই শান্ত স্থবির জীবন অনেক কাম্য মনে হতে থাকে তার। সুন্দরীর নির্লিপ্ততা খেয়াল করে সৌরভ তাকে আরও বেশি প্রেমে ভাসিয়ে দিতে চায়। হোক তা অভিনয়, তবু অভিনয়েরও একটা নেশা আছে বৈকি। নিজের অভিনয়কেই ভালোবাসতে থাকে সৌরভ।
সৌরভের প্রেম যতই তীব্র হয়, ততোই ভিতরে ভিতরে হাঁপিয়ে উঠতে থাকে সুন্দরী। যে জীবন সে একবার পাড়ি দিয়েছে, সেই নদীতে আবার অন্তহীন সাঁতার তাকে ক্লান্ত করে তোলে। বার্ধক্যের শান্তির জন্য তার সমগ্র অস্তিত্ব হাহাকার করে। মনীষা তার কাছে পরাজিত। কিন্তু জয়পরাজয় দিয়ে তো ভালোবাসার হিসেব মেলানো যায় না।
অন্যদিকে পরাজয় মেনে নিয়ে হতাশ হলেও মনীষা ফিরে চায় তার প্রেম আর তারুণ্য। যে খেলা সে স্বেচ্ছায় মাঝপথে ছেড়ে এসেছে তাকে আবার শুরু করতে চায়। না হয় সৌরভের প্রেম তার রূপের প্রতিই ছিল। তবু তো ছিল। পুরুষের ভালোবাসায় একটা উত্তাপ আছে যা জীবনের শীতলতার বিপরীতে বড় বেশি মোহময়। সেই মোহের তৃষ্ণা না মিটতেই তাকে ত্যাগ করতে হয়েছে।মনীষা তাই আলোক সন্ধানী পতঙ্গ হয়ে ফিরে ফিরে আসে সুন্দরীর কাছে। যদি দূর থেকেও দেখা মেলে সৌরভের। নিজের ভালোবাসাকে নিয়ে যে বাজি ধরে এটাই হয়তো তার প্রায়শ্চিত্ত।
সুন্দরীর দেহের অতলে আকণ্ঠ নিমিজ্জিত হলেও সৌরভ তৃষ্ণার্ত থাকে মনীষার জন্য।মনীষা চলে যাওয়ার তীব্র অভিমানে সে সুন্দরীর প্রেমকে অবলম্বন করেছে বটে কিন্তু তার শূন্যতা পূরণ হওয়ার নয়।মনীষা তাকে যা দিতে পারতো তা সুন্দরী কখনও পারে না। মনীষা তার জীবন থেকে হারিয়ে গেলেও ভালোবাসা আজও তার প্রতি অবিচল। সুন্দরীও সেকথা উপলব্ধি করে। জয়ী হয়েও জয় তার হয়নি, আর পরাজিত হয়েও কোথায় যেন ঠিকই বিজয়িনী মনীষা। এখন বরং এই নাটকের যবনিকা পড়া দরকার। কিন্তু কিভাবে আবার বিনিময় করবে তারা।
রূপের বোঝায় ক্লান্ত সুন্দরী নিঃস্ব হয়ে যাওয়া মনীষাকে বলে,
কোনো এক কবোষ্ণ পূর্ণিমায় তোর চোখে তাকিয়ে যদি সে তোকে চিনতে পারে একমাত্র তাহলেই আমরা ফিরে যেতে পারবো আগের জীবনে।
আকাশভরা জোছনায় জগতের নিয়ম কানুনের বজ্র আঁটুনি খসে পড়ে।বাস্তবের পোশাক ঢিলে করে প্রকৃতি তখন মৃদু হাসে। কবোষ্ণ পূর্ণিমা নেমে আসে ধুলোমাটির গ্রহটিতে। সেই জোছনায় ইচ্ছেরা পাখা মেলতে পারে তৃতীয় ভুবনে।
সুন্দরী ও মনীষা অনন্তকাল অপেক্ষা করছে সৌরভের জন্য। আশায় ও নিরাশায় দুলছে জীবন। জোছনা ফিনিক ফুটছে। সৌরভ পাহাড়ী পথ ধরে এগিয়ে আসছে।সুপ্রাচীন হরিকেল জনপদের আকাশে তখন কবোষ্ণ পূর্ণিমা।
Leave a Reply