ড. মোহাম্মদ শামসুল আলম
নওগাঁ শহর থেকে ১৮ মাইল দক্ষিণে ছোট যমুনা নদীর পাদদেশে কাশিমপুর জমিদার বাড়ির অবস্থান। নওগাঁ-আত্রাই সড়কের কাশিমপুর নামক গ্রামের পশ্চিম পাশে অবস্থিত এই স্থানটিতে যে কোনো যানবাহনে চড়ে অনায়াসে গমনাগমন করা যায়। এই এস্টেটের সম্পত্তির পরিমাণ ছিল-৪৪৮২ একর বা সাতশত বর্গমাইল। পরগণার স্টেট ছিল তিনটি। সম্রাট আকবরের শাসনামলে জনৈক শিবরাম নামক এক ব্যক্তিকে কাশিমপুরে জায়গীর দেওয়া হয়। এই শিবরাম ছিলেন কুলীন ব্রাহ্মণ এবং কাশিমপুর জমিদারগণের আদি পুরুষ। মহারাণী ভিক্টোরিয়ার আমলে কাশিমপুরের জমিদার রায়বাহাদুর উপাধি প্রাপ্ত হন। নদীর ধারে ঘরের মতো সূচালো চালবিশিষ্ট বিশ্রামাগার এবং রাজপ্রসাদের কক্ষগুলোর দেয়ালের স্টাইল বা মিনাকরা অলঙ্কৃত টালিগুলো দর্শকদের আনন্দ ও বিনোদনের বস্তু। ভবনটির সম্মুখভাগ দক্ষিণ দুয়ারি। তবে সম্মুখ ভাগে একটি বিশাল আকৃতির উন্মুক্ত অঙ্গন রয়েছে।
পরিত্যক্ত জমিদার বাড়ি কাশিমপুর জমিদার প্রধান গ্রাম। এ গ্রামের নামের উৎপত্তি সম্পর্কে বলা যায় যে, সম্রাট আকবরের সময় কাশিম খাঁ নামক এক পাঠান জায়গীরদার এখানে বাস করতেন। তার নামানুসারেই এই গ্রামের নাম কাশিমপুর হয়েছে। মহারাজা মানসিংহ কাশিম খাঁর জায়গীর বাজেয়াপ্ত করে এক হিন্দু ব্রাহ্মণের নিকট পত্তন করেন। এই ব্যক্তি চৌধুরী জমিদারগণের পূর্বপুরুষ। বিভাগ পূর্বকালে এই জমিদারির অংশগুলো ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র অংশে বিভক্ত ছিল। কাশিমপুরের রায়বাহাদুর এস্টেটই ছিল প্রধান জমিদারির অংশ। গ্রামের চৌধুরীগণ চৌদ্দ চৌধুরীর এক চৌধুরী বংশীয় বলে পরিচিত। তঁারা বারেন্দ্র ব্রাহ্মণগণের মধ্যে প্রধান কাপ। রাজা কালীকান্ত লাহিড়ীর ভ্রাতুষ্পুত্র গিরিশচন্দ্র লাহিড়ী বাস করতেন এই কাশিমপুর জমিদারবাড়িতে। বাবু রামকিশোর লাহিড়ী ছিলেন এ বংশের প্রথম পুরুষ। তাঁর তিনটি পুত্র সন্তান ছিল। তাঁরা হলেন কালীকান্ত, কাশীকান্ত ও কালীশঙ্কর। কালীকান্তের কোনো পুত্র সন্তান ছিল না। কাশীকান্তের ছিল দুটি পুত্রজ্জঅমলাকান্ত ও রজনীকান্ত। কালীশঙ্করের এক পুত্র গিরিশচন্দ্র। তিনভাই কালীকান্ত, কাশীকান্ত ও কালীশঙ্কর একান্নবতর্ী পরিবারভুক্ত হয়ে কাশিমপুরে বাস করতেন। এক পর্যায়ে কালীকান্ত কাশিমপুর থেকে রাজশাহীতে গিয়ে বসবাস করেন। আর পেশা হিসেবে গ্রহণ করেন মোক্তারি। এই পেশার মাধ্যমে তিনি প্রচুর অর্থ সঞ্চয় করেছিলেন। উপার্জিত অর্থ ও কৌশল প্রয়োগ করে তিনি কয়েকটি জমিদারি ক্রয় করেন। একজন বুদ্ধিমান ও প্রতিভা সম্পন্ন মানুষ ছিলেন কালীকান্ত। তবে তিনি সরল প্রকৃতির মানুষ ছিলেন না। প্রতিভাগুণে তখন প্রায় ৮০ হাজার টাকা মূল্যমানের ভূ-সম্পত্তির মালিক হন। তঁার যেহেতু কোনো পুত্র সন্তান ছিল না, সেহেতু পুত্র সন্তানের আশায় তিনি দ্বিতীয় বিবাহ করেছিলেন। দ্বিতীয় বিবাহ করার পরেও তঁার কোনো পুত্র সন্তান ছিল না। তঁার স্ত্রী দুটির নাম কাশীশ্বরী ও মৃন্ময়ী। ছোট স্ত্রী মৃন্ময়ী ছিল যেমন বুদ্ধিমতী, তেমনি সর্বময় কতর্ৃত্বের অধিকারী। মৃন্ময়ীর মতের বাইরে কোনো কাজ করার ক্ষমতা ছিল না কালীকান্তের। অপর ভ্রাতা কাশীকান্ত, তাঁর স্ত্রী ও বড় পুত্র পরলোকে গমন করেন। কেবল কনিষ্ঠ পুত্র রজনীকান্ত ও কালীশঙ্করের একমাত্র পুত্র গিরীশচন্দ্র জীবিত ছিল। এই বংশের তৃতীয় পুরুষ হলেনজ্জরায় বাহাদুর গিরীশচন্দ্র লাহিড়ী। তিনি ছিলেন দানশীল ও প্রজাবৎসল একজন জমিদার। এস্টেটের তৃতীয় পুরুষ গিরিশচন্দ্র লাহিড়ীর আমলে এই জমিদারির শ্রীবৃদ্ধি ঘটে। গিরিশচন্দ্রের পুত্র কেদার প্রসন্ন লাহিড়ী রায় বাহাদুর উপাধি পেয়েছিলেন। রায় বাহাদুরের পুত্র শেষ জমিদার অন্নদা প্রসন্ন লাহিড়ী তীক্ষè বুদ্ধিসম্পন্ন একজন বিদ্বান ব্যক্তি ছিলেন। কাশিমপুরের চৌধুরী বংশের এবং লাহিড়ী পরিবারের কেউ এখন আর এদেশে নেই।
লেখকঃ গবেষক,প্রাবন্ধিক, ইতিহাসজ্ঞ,
সহযোগী অধ্যাপক ও বিভাগীয় প্রধান
বাংলা বিভাগ
নওগাঁ সরকারি কলেজ, নওগাঁ
Leave a Reply