পাভেল আমান
ভারতের স্বাধীনতা সংগ্রামের ইতিহাসে যে সমস্ত বিপ্লবী, শহীদ তথা বীর সন্তানের আত্ম বলিদানে চির স্মরণীয় হয়ে আছেন তন্মধ্যে অগ্নিযুগের বিপ্লবী ভারতের প্রথম সর্বকনিষ্ঠ শহীদ ক্ষুদিরাম বসুর নাম ইতিহাসে পাতায় চির ভাস্বর। পরাধীনতার শৃংখল থেকে দেশমাতৃকাকে মুক্ত করার অদম্য ইচ্ছায় বিপ্লবী ক্ষুদিরাম অকুণ্ঠ চিত্তে বরণ করেছিলেন ফাঁসির দড়ি। একটা সমাজ, দেশ, জাতি তথা যুব সমাজকে উজ্জীবিত করেছিলেন তার মহান আত্মাহুতি বিনিময়ে।৩ ডিসেম্বর ভারতবর্ষের এক অগ্নিস্ফুলিঙ্গ, সূর্য সন্তান ক্ষুদিরাম বসুর জন্মদিন। যিনি তরুণ বয়সে মাতৃভূমির জন্য নিজের জীবন বির্সজন দিয়েছিলেন।ক্ষুদিরাম বসু ১৮৮৯ খ্রিস্টাব্দের ৩ ডিসেম্বর তৎকালীন ব্রিটিশ ভারতের বেঙ্গল প্রেসিডেন্সির অন্তর্গত মেদিনীপুর শহরের কাছাকাছি কেশপুর থানার অন্তর্গত মৌবনী গ্রামে জন্মগ্রহণ করেন। তাঁর পিতা ত্রৈলোক্যনাথ বসু ছিলেন নাড়াজোলের তহসিলদার। তাঁর মায়ের নাম লক্ষিপ্রিয় দেবী। তিন কন্যার পর তিনি তাঁর মায়ের চতুর্থ সন্তান। তাঁদের দুই পুত্র অকালে মৃত্যুবরণ করেন। অপর পুত্রের মৃত্যুর আশঙ্কায় তিনি তখনকার সমাজের নিয়ম অনুযায়ী তাঁর পুত্রকে তার বড়ো দিদির কাছে তিন মুঠো চালের খুদের বিনিময়ে বিক্রি করে দেন। খুদের বিনিময়ে কেনা হয়েছিল বলে শিশুটির নাম পরবর্তীকালে ক্ষুদিরাম রাখা হয়। ক্ষুদিরামের বয়স যখন মাত্র ছয় বছর তখন তিনি তাঁর মাকে হারান। এক বছর পর তাঁর পিতার মৃত্যু হয়। তখন তাঁর বড়ো দিদি অপরূপা তাঁকে দাসপুর থানার এক গ্রামে নিজের বাড়িতে নিয়ে যান। অপরূপার স্বামী অমৃতলাল রায় ক্ষুদিরামকে তমলুকের হ্যামিল্টন হাই স্কুলে ভর্তি করে দেন।ক্ষুদিরাম বসু শৈশবকাল থেকেই দুরন্ত ও বেপরোয়া প্রকৃতির ছিলেন। আর পরবর্তীতে এই দুরন্তপনা প্রকৃতির সাথে বিপ্লবী চেতনার মিশ্রণে ক্ষুদিরাম হয়ে ওঠেন ইংরেজ সাম্রাজ্য কাঁপানো এক অগ্নিস্ফুলিঙ্গ। বাংলায় গুপ্ত সংঘের প্রতিষ্ঠাতা সদস্য হেমচন্দ্র কানুনগোর সাথে যখন ক্ষুদিরাম বসুর প্রথম দেখা হয় তখনি সেই অগ্নিস্ফুলিঙ্গ ফোটে ওঠেছিলো ক্ষুদিরামের চলনে-বলনে।শৈশবের দুরন্তপরনার ইতিহাস ক্ষুদিরামের জীবনেই থেকে গেলেও ভারত বর্ষের ইতিহাসের খাতায় ক্ষুদিরাম বসুর নাম প্রথম আসে ব্রিটিশ বিরোধী ‘সোনার বাংলা’ লিফলেট বিলি করতে গিয়ে। সালটা ১৯০৬ ছিলো। ফেব্রুয়ারি মাসে মেদিনীপুরে আয়োজন করা হয় এক কৃষি-শিল্প প্রদর্শনীর। ক্ষুদিরাম লোকারন্যের মাঝেও সেদিন মেলার প্রবেশদ্বারে দাঁড়িয়ে ‘সোনার বাংলা’ লিফলেট বিতরণ করছিলেন খোলামেলাভাবে। প্রকাশ্যে ব্রিটিশ বিরোধী লিফিলেট বিতরণের ফলস্বরূপ তাঁকে ধরাও পড়তে হয় এক কন্সটেবলের হাতে। কিন্তু শৈশবের দুরন্তপনা আর ব্রিটিশ বিরোধী চেতনা ততোদিনে মিলেমিশে একাকার হয়ে গেছে। সেদিন বক্সিং এর কেরামতিতে সেদিন কনস্টেবলের নাক ভেঙে দিয়েছিলেন ক্ষুদিরাম। তবে কন্সটেবলের নাক ভাঙলেও নিজেকে ছাড়াতে পারেন নি ক্ষুদিরাম। সে যাত্রায় ক্ষুদিরাম বসুর ভাগ্য ভালো ছিলো বলতে হয়। কারণ সেসময় আরেক বিপ্লবী সত্যেন্দ্রনাথ কালেক্টরিতে এক ডেপুটির অফিসে কাজ করতেন। সেই প্রদর্শনীর সহকারি সম্পাদকও ছিলেন তিনি। পুলিশের কাছ থেকে ক্ষুদিরাম ধরা পড়লে তিনি কৌশলে ছাড়িয়ে নেন। অবশ্য পরে এই কৌশলের কথা পুলিশরা টের পেয়ে যায় এবং সত্যেন্দ্রনাথ চাকরি থেকে বরখাস্ত হন। অন্যদিকে ক্ষুদিরামের নামে দেওয়া হয় ‘রাজদ্রোহী মামলা’। বলা হয়ে থাকে এটিই সম্ভবত বিপ্লবীদের বিরুদ্ধে এটিই সর্বপ্রথম রাজদ্রোহী মামলা ছিল।
১৯০৮ সালের ৩০শে এপ্রিল রাত ৮টার সময় ক্ষুদিরাম বসু ও প্রফুল্ল চাকী রাতের অন্ধকারে, স্থানীয় ইউরোপীয় ক্লাবের গেটের কাছে একটি গাছের আড়াল থেকে কিংসফোর্ডের গাড়ি ভেবে, একটি ঘোড়ার গাড়িতে বোমা নিক্ষেপ করে। এর ফলে এই গাড়িতে বসা নিরপরাধ মিসেস কেনেডি ও তার কন্যা মারা যান। বিষয়টি জানাজানি হয়ে গেলে, পুলিশ সমগ্র অঞ্চল জুড়ে তল্লাসি চালাতে থাকে। ক্ষুদিরাম বসু হত্যাকান্ডের স্থল থেকে ২৫ মাইল দূরে ওয়েইনি স্টেশনে ধরা পড়েন। এই সময় অপর বিপ্লবী প্রফুল্ল চাকীকেও ধরার চেষ্টা করা হলে, তিনি নিজের রিভলবারের গুলিতে আত্মঘাতী হন। তিনি বোমা নিক্ষেপের সমস্ত দায়িত্ব নিজের উপর নিয়ে নেন। কিন্তু অপর কোনো সহযোগীর পরিচয় দিতে বা কোনো গোপন তথ্য প্রকাশ করতে রাজি হননি। ভারতীয় দণ্ডবিধি ৩০২ ধারা অনুসারে তাঁকে মৃত্যুদণ্ড প্রদান করা হয়। ফাঁসির আদেশ শুনে ক্ষুদিরাম বসু হাসিমুখে বলেন যে, মৃত্যুতে তাঁর কিছুমাত্র ভয় নাই।স্বাধীনতার আকাঙ্খায় এমনই নির্ভীক ছিলেন মেদিনীপুরের এই বিস্ময় যুবক। রায় ঘোষণার পর জীবনের শেষ কযেকটা দিনে কারাগারে বসে মাৎসিনি, গ্যারিবল্ডি ও রবীন্দ্রনাথের লেখা পড়তে চেয়েছিলেন। ১০ আগস্ট আইনজীবী সতীশ চন্দ্র চক্রবর্তীকে ক্ষুদিরাম বলেছিলেন, ‘রাজপুত নারীরা যেমন নির্ভয়ে আগুনে ঝাঁপ দিয়া জওহরব্রত পালন করিত, আমিও তেমন নির্ভয়ে দেশের জন্য প্রাণ দিব। আগামীকাল আমি ফাঁসির আগে চতুর্ভুজার প্রসাদ খাইয়া বধ্যভূমিতে যাইতে চাই।’ক্ষুদিরামের মৃত্যু হয়েছে আজ এক শতাব্দীরও বেশি সময় পেরিয়ে গেছে। এই নামটি আমাদের কাছে এখনো বিপ্লবের প্রতীক হয়ে আছে। ক্ষুদিরাম যুগে যুগে আমাদের অনুপ্রেরণা দিয়ে আসছেন মুক্তির স্বপ্ন দেখতে, অন্যায়ের প্রতিরোধ করতে। ক্ষুদিরাম যেন কাজী নজরুল ইসলামের সেই দুরন্ত পথিক, যে নিজে মরে গিয়ে লক্ষ্য প্রাণকে জাগানোর জন্য নিজের বুক পেতে দিয়ে বলছে, “তবে চালাও খঞ্জর!”বস্তুত পক্ষে শহীদ ক্ষুদিরাম বসুর যে রকম দেশপ্রেম দুর্জয় সাহস ও বিপ্লবী মানসিকতা ছিল তা আজ স্বাধীনতার ৭৩ বছর পরে ভারতবর্ষের বুকে বিরল৷ এখন বিচ্ছিন্নতাবাদ, সন্ত্রাসবাদের কারণে লোকে নিহত হয় অহরহ কিন্তু সেইসব হতভাগ্য মানুষের দেশপ্রেম থাকে না৷ এখন প্রায়ই ভারতবর্ষের এইসব বরেণ্য শহীদ গণের আত্মবলিদানের ঘটনা তারা জানতে চায় না৷ এটা স্বাধীন ভারতবর্ষের লজ্জা৷ বস্তুতপক্ষে এখন দেখা যায় দেশপ্রেম এখন বহু ভারতবাসীর মন থেকে বুদবুদের মতো উবে গেছে৷ পরাধীন ভারতবর্ষের এই বীর শহীদবৃন্দের নবমূল্যায়ন দরকার, তবেই ভারতবর্ষ জগৎসভায় নিজের আসন সুপ্রতিষ্ঠিত করতে পারবে৷ প্রকৃতপক্ষে আত্মবিস্মৃত জাতি দেশপ্রেমবঞ্চিত হয়ে জড় বস্তুতে পরিণত হয়৷ এই অবস্থা কাটাতে পারলে দেশবাসী স্বমহিমায় উজ্জ্বল হবে৷ শহীদবৃন্দের আত্মবলিদান কখনো বৃথা যায় না৷ বর্তমান এই অস্থিরতার মুহূর্তে দেশ গড়ার কাজে দেশপ্রেমের প্রকৃত আদর্শে উদ্বুদ্ধ হয়ে একজন ভারতীয় হিসেবে জাতি-ধর্ম-বর্ণ নির্বিশেষে প্রত্যেকের শহীদ ক্ষুদিরাম বসুর জীবন দর্শন, আদর্শ, দেশাত্ববোধকে স্মরণ করে আমাদের সামনের দিকে এগিয়ে যেতে হবে। এখানেই এই মহান দেশনায়ক, বিপ্লবী তথা ভারত মাতার শ্রেষ্ঠ সন্তানকে স্মরণ করার প্রাসঙ্গিকতা।
-পাভেল আমান -হরিহরপাড়া-মুর্শিদাবাদ-
Leave a Reply