মিলা মাহফুজা
ঘাটে স্থবির গাড়ির দীর্ঘ সারি। তিন কিলোমিটার, লেজ পর্যন্ত। ওপারে ঘাট ভেঙে গেছে স্রোতের তোড়ে। জেটিতে ফেরি ভিড়তে পারছে না। উত্তাল নদী কেবলই ভাঙছে পাড়। যত সময় যাচ্ছে তত যানের সারি লম্বা হচ্ছে। দিনের বেলা লঞ্চে পারাপার হয়েছে কিছু মানুষ। সন্ধের পর থেকে তাও বন্ধ। খালি বাস নিয়ে লাইনে আছে সিরাজও। খানিকটা সমানের দিকে আছে, আশা করছে তিন নম্বরে উঠে যেতে পারবে ফেরিতে। কিন্তু ফেরি চলাচল কখন শুরু হবে তারই ঠিক নেই! কে জানে কয়দিন পড়ে থাকতে হয় এখানে। সেবার চার দিন থাকতে হয়েছিল। অপেক্ষা করে বিরক্ত সিরাজ হেলপারের হাতে বাস ছেড়ে দিয়ে গেছে দু-গ্লাস টানতে। মরিয়মের ঘরে গলির মোড় থেকে নেয়া বটি কাবাব আর বোতল সাজিয়ে আয়েশ করে বসেছে কেবল। বাস মালিক ফোন দিল। ‘তোর মাইরে চু…’ গালটা ঝেড়ে ফোনটা কানে ধরল সিরাজ। একটানা শুনেই গেলো সে। শেষে ‘আইচ্ছা’ বলে ফোন কাটল। মরিয়ম সামনে বসে দাঁতে বাদাম কাটছিল। এটা ছিল তার তরফে আপ্যায়ন। সিরাজ ফোন রাখার পর দেখে এর মধ্যে নিজেই অর্ধেক বাদামই সাবাড় করে ফেলেছে। ‘শালার চুতমারানির নোলা এত বাদাম গেলনের পর কাবাব ঢুকবো কোন প্যাটে’-আক্ষেপটা পেটেই চালান করে মরিয়ম হাসিমুখে বোতলের ছিপি খুলে দুটো গ্লাসে ঢালল ঘোলাটে তরল। সঙ্গে সঙ্গে একটা গ্লাস তুলে কৎ কৎ করে দুই ঢোক গিলে ফেলল সিরাজ। আলচা মেরে কাস্টমারের তাড়া টের পেয়ে মরিয়ম বুকের বসন আলগোছ করল। সিরাজ সেদিকে নজর করে না। ঝট করে গ্লাসটা শেষ করে বাড়িয়ে দিল ভরে দিতে। মরিয়মের মেজাজ খিঁচড়ে গেছে। শালা একটু মৌজ করবে ভাবছিল, হইল না। ব্যাডা যেভাবে গিলছে তাতে একটু পরে একটা বুনো মোষ হয়ে শিং গুতানো ছাড়া আর কিছু বুঝবে না। এরকম কাস্টমার সামাল দেয়ার অভ্যেস আছে কিন্তু সে হলো ‘বসানো কাস্টমার’, সিরাজ কাস্টমারের উপরে কিছু। আজ সে আর কাস্টমার বসাবে না ঠিক করেছিল। মৌতাতে ডুবে কাটাবে কাল পর্যন্ত। মাঝে মাঝে তার নিজের ইচ্ছেও তো হয়! সিরাজ প্যান্টের চেন টানতে টানতে বলল, ‘শইল ঠান্ডা হইল না। ফিরনের সময় আবার আমুনে।’ মরিয়ম উত্তর দিল না। সিরাজ ঘাটে এসে দেখে রাতে আর কোনো লঞ্চই নাকি ছাড়বে না। লঞ্চঘাট নিরিবিলি হয়ে গেছে অনেকটাই। সে কি করবে ভেবে পায় না। ওপারে ঘাটে বাস ফেলে পালিয়েছে কোন্ বাইনচোত ড্রাইভার। অল্প বয়সী হেলপার একা রয়েছে সে বাসে। ওপারে গিয়ে বাসটা টার্মিনালে রেখে আসার জন্য মালিক ফোন দিয়েছে। কিন্তু এখন যেতে না পারলে সে কী করবে? মরিয়মের ওখানে ঘণ্টাখানেক না কাটালে হয়ত শেষ লঞ্চটা ধরতে পারত। কিন্তু ঘাটে এসে মরিয়মের ধারে না গেলে তার মাথা আউলাইয়া যায়। গাড়ির ইস্টিয়ারিং লাইন মতো থাকে না। একসিডেন হইলে তহন? তহন তো সিরাজেরই দোষ হইব। কিন্তু মালিকরে এহন কী কওন যায়? সিরাজ নদীর কিনারে আরও খানিকটা এগিয়ে যায়। আজ নদীর চেহারা ভয়ংকর। সারাদিনের কালো মেঘের আস্তর সরে গেছে ।এখন চান্দ উঁকি দিচ্ছে। সিরাজ দেখে- চান্দের আলোর নহর নামছে নদীর উপরে। ঢেউগুলা য্যান চান্দির নাহাল চিকমিকাইতাছে। য্যান হীরা জ্বলতাছে পানির ভিতরে। এমুন চাননি রাইতে নদীর এত রাগ তো দ্যাহা যায় না! কুনো খারাপি হইব নাকি? কুনো বালা-মুসিবত আইব নাকি?
সিরাজ বেরিয়ে গেলে মরিয়ম ব্লাউজের হুক আটকায় ধীরে ধীরে। মন মাথা দুটোই ভার লাগছে। সে বেরিয়ে আসে ঘরের বাইরে। আজ আর কাস্টমারের জন্য গলির মাথায় যেতে মন চাচ্ছে না। সামনের মদের ঠেকের দিকে যাবে কিনা ভাবল। এক পা দু’পা করে এগিয়ে দোকানটার কাছে এসেও তার থামতে ইচ্ছে করল না। সে পাকা রাস্তায় উঠে গেলো। রাত হয়েছে অনেকটা। খাবারের দোকানগুলো ঝাপ ফেলতে শুরু করেছে। আজ কাস্টমার কম। সেখানে দাঁড়িয়ে গাড়ির সারি লেজের দিকে তাকিয়ে কেন যেন ঢোড়া সাপের কথা মনে পড়ল মরিয়মের। চান্দের আলো ফুটছে। ঝিম ধরা বাস-ট্রাকের উপর গড়িয়ে গড়িয়ে পড়ছে আলোর রৌশনাই। তবু কেমুন জানি লাগে মরিয়মের। এক জোৎস্না রাতে পুকুর পাড়ে ঢোড়া সাপের সঙ্গম দেখেছিল সে। আজ আবার খুব পরিষ্কার দেখতে পাচ্ছে যেন, কিন্তু কেন? সিরাজ চলে গেছে বলে? সিরাজ কাস্টমারের বেশি কিছু? একটু বেশি। ওর সাথে সময়টা ভাল কাটে। ও-ও আসা-যাওয়ার পথে ঢুঁ মারতে ভোলে না। তা আসুক, মরিয়ম আর রসের পুকুরে ডুব দেবে না। একবারই দিয়েছিল। কী সুখের সেই ডুব! সুখ সুখ সুখ। সুখের রসে টুবটুবা শরীল, দিন। হারামখোর হান্নান বেঈমানি করবে তা চিন্তায়ও আসেনি। রাতের অন্ধকারে পালানোর কথা বলেছিল বেঈমানটা। সাপের সঙ্গম দেখার পর মরিয়ম ফুল ফুটে নিজের গন্ধে নিজেই মাতোয়ারা মরিয়ম ভাসতে চেয়েছিল জোৎস্নায়। আহ্, সেই নদীর নির্জন ঘাটে পারাপারের নৌকায় জোৎস্না জাপটে ধরেছিল শরীর। প্রত্থম উত্তেজনা, প্রত্থম চুমা, প্রত্থম সম্ভোগ! শুয়োরের বাচ্চা না হয় নরকে ফেলে পালিয়েছে কয়টা টাকা নিয়ে -কিন্তু মরিয়ম ভোলে কী করে সেই দিন! হাঁটতে হাঁটতে কখন ঘাটে চলে এসেছে মরিয়ম। নদীর উপচানো পানি খলাৎ খলাৎ করে ঘাই মারছে পাড়ে। সে বসে পড়ে পা নামিয়ে দেয় ঢেউ টলোমলো জলে। মাথার বেনি দুটো খোঁজে, বেনির আগায় লাল ফিতার ফুল। তার কিশোরকালের পা। তার গাল পাড়া মা। মাথার চুলে তেল দেয়া দাদি। আমতলায় তেঁতুলমাখা চাটা সখি আসমা। নদীর ঢেউয়ে ছু্টে আসে ছোট বোন ববিতা। বুবু বুবু ডেকে হয়রান । মরিয়ম- ময়না উত্তর দেয়- আসছি রে বুইন। ববিতা আবার ডাকে- বুবু, ভাতে দুধ মাখাই দেও। ময়না বলে- দিচ্ছি কচ্ছি, এটটু সবর ধর।
মালিককে ফোন করে সিরাজ।
মালিক ‘খানকিরপো, তরে কহন ফোন দিছি, আর তুই এহন কস লঞ্চ নাই, আইবি ক্যামনে?’
সিরাজ বিরক্ত হয়ে বলে, ‘গাল পাইড়েন না, আমি দ্যাখতাছি, আর কাউরে পাওন যাইব কিনা।’
মালিক চিল্লাই, ‘ওই সুমুনদির পো, চোপা চালাইবার লাগছিস? দিমু দাত ফালাইয়া। য্যামনে পারিস গাড়ি টার্মিনালে আন। আর আমারে ফোন দিবি না রাইতে।’
নদীর জলে চান্দের আলো মরে আসছে। সিরাজ তাকিয়ে দেখে আকাশে আবার মেঘ ঘন হচ্ছে। সে মোবাইল বের করে ফোন করল। বাসের একটা ব্যবস্থা করতেই হবে। আধাঘণ্টার চেষ্টার পর সে চিন্তামুক্ত হলো। বাসের চেয়ে সে আসলে হেলপার ছেলেটার জন্যেই চিন্তা করছিল। ছেলেটাকে চেনে, বাপ নেই, নুলো মায়ের একমাত্র ছেলে। একেবারে পেটের দায়েই কাজে দিয়েছে অতটুকু ছেলেকে। একদিন বলেছিল সিরাজকে। ছেলে বাড়ি না গেলে সারারাত টার্মিনালেই বসে থাকবে। সিরাজের নিজের মা তাকে ফেলে রেখে অন্য লোকের সাথে নিকা বসেছে । মাঝে মাঝে খোঁচায় কষ্টটা। বাস টার্মিনালে নেয়ার ব্যবস্থা করে একটু স্বস্তি নিয়ে লঞ্চ ঘাট ছেড়ে হাঁটতে শুরু করল সিরাজ। মরিয়ম ফ্রি থাকলে ওর ওখানেই থাকবে রাতটা। না হলে বাসের ভেতরে ঘুমাবে। ফেরি ঘাটের কাছে এসে দেখে কয়েকটা লোক জটলা করছে। কৌতূহল নিয়ে সে এগোলো সেদিকে। কেউ কেউ নদীর দিকে তাকিয়ে কী যেন দেখছে। একজন বলল, এমুন টান পানির! কই লই গ্যাছে তার দিশ পাওন যাইবনি ? তিনদিন পর লাশ ফিরা আইলে দেখা যাইব কেডা আছিল। সিরাজ শোনা কোন এক মেয়েলোককে নাকি পানির ভেতর থেকে কিছু একটা হঠাৎ লাফিয়ে উঠে ঘাট থেকে টান দিয়ে নিয়ে গেছে পানির নিচে। দুই-একজন ঘটনাটা এক ঝলকই মাত্র দেখেছিল। মেয়েলোকটা অনেকটা সময় এখানে একাই বসে ছিল দেখেছে অনেকে। একজন বলল, আতমোহত্যাও করবার পারে। সিরাজ বেশি মাথা ঘামাল না। সরে এলো। মরিয়মের ওখানে ঢুঁ মারবে একবার। মেঘের আড়ালে আড়ালে উঁকি দেয়া চান্দের ছাড়ান ছাড়ান আলোয় কী এক ভাবে আবিষ্ট হয়ে গেয়ে উঠলো- সখি তোরা প্রেম করিও না/প্রেম করছে যে জন সে জানে পীরিতের কী বেদন/ সখি তোমরা প্রেম করিও না … ।
Leave a Reply