তাহমিনা কোরাইশী
সেই ছোটবেলার অভ্যাস আকাশ দেখা,সেই বাতিক তার আজও তেমনি। তারাদের সাথে মিতালী করা কখনো পরী হয়ে উড়ে যাওয়া। গল্পের নায়িকা সে নিজেই। একতলা বাড়িটার ছাদ মিতালীর ভীষণ পছন্দের স্থান । মাদুড় বিছিয়ে চিত হয়ে শুয়ে আকাশ দেখা , তারাদের সাথে ভেসে বেড়নো । অবশ্য বড় ভাই অয়ন তার সঙ্গী ছিল আকাশ রাজ্যের গবেষণার কাজে। ছোটখাটো একটা দূর্বীণযন্ত্র ওদের হাতে আসে। তাই দিয়ে আকাশপাঠ চলতো রীতিমত। ঐ যে কালপুরুষ ইংরেজী নাম ওরিয়ন । হাতে বাঁকানো ধনুক,কোমরে কোমরবন্ধ হাতে তলোয়ার সাথে একটি লুব্ধক। ঐ লুব্ধকই হচ্ছে আকাশের উজ্জ্বলতম তারা। এ ভাবে সপ্তর্ষিমন্ডল,গ্রেট বেয়ার বা বড় ভাল্লুক, কুম্ভ, মীন,বৃষ,বৃশ্চিক,ধনু নানান তারাদের সাথে ওদের পরিচয়।পশ্চিম আকাশে সূর্য অস্ত যাওয়ার পরে আমাদের দিকে যে তারাটি চেয়ে থাকে সেই তো সন্ধ্যাতারা আর পূর্ব আকাশে সকালে সেই শুকতারা। অয়ন বলে সেই কিন্তু আদতে শুক্রগ্রহ। মিতালী চুপ করে থাকার পাত্র? ভাইয়া , এতো কিছু জানার পরে তুমি আমাকে এ বি সি ডি শেখাচ্ছো? ভাই বোন আনন্দে আপ্লুত আকাশ বিদ্যায় আর গবেষণায়। কিন্তু মিতালী ভাইকে কখনো জোছনা রাতের ভাগ দেয় না । এটা যেনো একান্তই নিজের । জোছনায় আনন্দে ভেসে যাওয়া আর অমানিশায় ভূতের ভয়ে নিজেকে গুটিয়ে নেয়া।
শৈশব কৈশোর পেরিয়ে যৌবন। পেয়ে যায় এক বন্ধু স্বামী যে তার মনের মত একজন মানুষ। ভালোবাসায় কতটা সময় পেরিয়ে যায়।মাহতাব ওর বড় ভাই অয়নের ছোটবেলার বন্ধু। দুজনে মন মানসিকতা ও মননে যথেষ্ট মিল আছে। আর মাহতাব মিতালীর ছাদ জীবনের সব বৃত্তান্তই জানতো । ওকে কখনো কখনো আকাশ পরী বলেও ডাকতো। ভালোবাসায় কানায় কানায় পূর্ণ ছিল ওদের জীবন।প্রথম প্রথম মাহতাব ওকে সঙ্গ দিত চিত হয়ে আকাশ দেখার খেলায়। তারাদের কল্পনার সুতোয় জুড়ে দিয়ে কত কিছুই না ভাবতো মেঘ,ঘোড়া,হাতি,মানুষ। পৃথিবীর দুই মেরুর চুম্বকিয় আকর্ষণে সূর্য থেকে উৎগিরণ সেই তো মেরুজ্যোতি দশ এগারো বছর পর পর দেখা যায় । দুজনের মধ্যে ছেলেমানুষি দুজনকে আকৃষ্ট করতো। যখন এলো ঘরে আলো ছড়িয়ে এক কন্যা সন্তান লাবনী পাল্টে গেলো ওদের নিত্যদিনের ধারাবাহিক জীবন। ছাদে গিয়ে তারা গোনা, বৃষ্টিতে ভেজা ,জোছনায় ডুবে যাওয়া কিছুটা ব্যাহত হলো ।মাহতাব ব্যস্ত হয়ে পরে তার ব্যবসা নিয়ে। ম্যনপাওয়ার বা মানব সম্পদ বিদেশে রপ্তানি করা। বেশ ভালো ভাবে কাজটি সে আয়ত্ব করেছিল । নিজের মুনাফার ব্যাপারে যতটা না তিক্ষ্ন দৃষ্টি তার চেয়ে নজর মানুষের সেবা করার দিকে ওর কাজের ব্যাপারে লাভ এতোটা প্রাধান্য পায়নি যতটা তার কাছে মানুষ উপকার পেয়েছে। যে কারণে তার অফিসে লোকজনের ভিড় । কাজের চাপও বেশী । মানুষের আস্থা অর্জন করতে পেরেছে সাথে তার সুনাম বেড়েছে। পিছনে ফিরে আর তাকাতে হয়নি । সিঁড়ি বেয়ে উঠে গেছে নিজের অবস্থানে।
লাবনীকে নিয়ে ছোট সংসার । সময় ও সুযোগ মত ছাদবাগানের পরিচর্যা করে। জুঁই,বেলী,হাসনাহেনা দোলনচাপা গন্ডি খোয়ার নয় বরং স্বর্গ রাজ্যের মতই সুন্দর ওর কাছে। নিজের ইচ্ছেতেই কারাবরণ। মাহতাব নারী স্বাধীনতায় ,নারী অধিকারে বিশ্বাসী একজন পুরুষ মিতালীর কোন ব্যপারে বাঁধা দেয়ার প্রশ্নই ওঠে না। মিতালী তার রাজ্যের রাজত্ব সাচ্ছন্দে চলিয়ে যাচ্ছে । কোথাও কোন ব্যত্য় নেই । পার হলো পাঁচটি বছর। এক নাগাড়ে এতো সুখ কি বিধাতার সহ্য হয়?
হঠাৎ এক প্রচন্ড ঝড়ের তীব্রতায় হুড়মুড় করে ভেঙ্গে যায় সাজানো সংসার। মাহতাব প্রতিদিনের মত সেদিনও বেড়িয়েছে অফিসের উদ্দেশে। অফিসে কাজগুলো সেরেছে দুপুর পর্যন্ত কিন্তু অফিস থেকে বের হয়ে কোথায় গেছে কেউ বলতে পারে না। সাথে ড্রাইভারকে নেয় নি। কেউ একজন এসেছিল তার গাড়িতে গেছে লাঞ্চে। কেমন একটা ধোঁয়াশার মধ্যে অফিসের লোকজন। খোঁজা খুঁজি পরলো মাহতাবের কোথায় যেতে পারে, কি এমন কাজ করলো কাউকে না বলে বেড়িয়ে যেতে হলো । না, বাসায় ও বলে নি কিছু । সন্ধ্যা গড়িয়ে যায় রীতিমত শংকায় উৎকন্ঠায় এ সময়গুলো পার হচ্ছে । থানা পুলিশ হাসপাতাল আত্মীয় স্বজনের বাড়ি সব জায়গাতে চলছে খোঁজ এক নাগাড়ে। তার কি কোন শত্রু বা প্রতিদ্বন্দ্বিতা ছিল কারো সাথে! কারা এ ভাবে তাকে তুলে নিয়ে গেলো? না কোন হদিস বা চিহ্ন পাওয়া গেলো না। একেবারে ভেঙ্গে পড়ে মিতালী। অফিসের স্টাফরাও হতবাক এমন একজন ভালো মানুষের শত্রু থাকতে পারে। কে তার সাথে এমন কাজ করলো কেউ কিছু ভাবতে পারছে না। কেউ দেখলো না অফিসের বস , জলজ্যান্ত একজন মানুষ মধ্য দুপুরে এতো লোকজনের সামনে থেকে গায়েব হয়ে গেলো? অবাক করার মতই ব্যাপার ।খোঁজ খবর করা কোথাও বাদ নেই দেশের বিভিন্ন স্থানে বিদেশে যাদের সাথে তার ব্যবসায়িক সম্পর্ক আছে। এমন কি পুলিশে জিডি করা হয়েছে তারা অফিসে এসে জেরা করছে সকল স্টাফ তাদের সাথে রিলেটেড সবাইকে। কোন কুল পাওয়া যায় কি না ? কোন কূল কিনারা পাওয়া যাচ্ছে না। প্রশ্নবোধক চিহ্ন কেবল সবার মুখে । শান্তি নেই পাগল প্রায় অনিশ্চিতায় কাটে দিন মিতালির। আঁধারের মাঝে কেবল আঁধারই গাঢ় হয়। যে মানুষটি কারো ক্ষতি করে নি কখনো কারো তার এমন পরিণতি হবে কেনো। তবে কি সে কারো কারো সাথে ব্যবসায়িক প্রতিদ্বন্দ্বিতা ছিল? তা তো থাকতেই পারে । এ কারণে এ ভাবে একটা মানুষকে গুম করে দেয়া সম্ভব! কোন ভাবেই উত্তর মিলছে না। অবশ্য অফিসের স্টাফরা অনেকেই বলার চেষ্টা করেছে- ব্যবসায়িক ভাবে তাদের আধিপত্য সিংহভাগ তাতে করে অন্যদের ঈর্ষা হবার কথা। তাই পথের কাটা সরিয়ে দেয়নি তো ওরা এক জোট হয়ে। মানব চরিত্র বিধাতাও বোঝেন না। এমন একটা চিন্তা ওদের মাথায় ঘুরছিল।কিন্তু তথ্য প্রমাণ হাতে নেই কি আর করা!
কারো জন্য দিন তো স্থবির হয়ে দাঁড়িয়ে থাকে না। দিন কেটে যায় বছর গড়িয়ে যায় । কোথায়ও কোন আশার আলো নেই। এভাবে দশটি বছর পার হয়ে গেলো মিতালীর আর লাবনী মা মেয়ের যাপিত জীবন । মিতালীকেই দায়িত্ব নিয়ে স্বামীর কাজ এগুতে হলো। সংসার চলার মত কিছু উপার্জন হলেই হলো। লাবনীর লেখাপড়া সংসার সব কাজ শেষ করে নিজের জন্য সময় থাকে না। তবুও মাঝে মধ্যে ছাদ বগানের হাতছানি টের পায় মিতালী । বৃষ্টিতে না ভিজলেও জোছনায় স্নাত হতে সাধ জাগে। আজীবন প্রতিক্ষা এ প্রতিক্ষার শেষ কি মৃত্যু, ভাবে মিতালী। কেবল বিষন্নতা ছেয়ে থাকে ।
তবুও পূর্ণিমা রাত আসে । চাঁদ ওঠে আকাশ জুড়ে রূপো রঙের প্লাবনে ভাসিয়ে ।শীতল পাটি বিছিয়ে মিতালী চিত হয়ে শুয়ে আকাশ দেখে । সেল ফোনে মৃদু মুর্ছনায় চলে গান। “আজ জোছনা রাতে সবাই গেছে বনে , মাতাল সমীরণে ” । জোছনার সাথে কথোপকথন চোখের জল আর বাঁধ মানে না। মিতালী হঠাৎ অনুভব করে ওর মাথার চুলে কে যেনো বিলি কাটছে। এ কাজটি করতো মাহতাব। রোমান্টিকতায় শিহরিত মিতালী। তীব্র ফুলের সুবাস বেলী,হাসনাহেনা মৌ মৌ চৌহদ্দি । ফিসফিস করে কথা বলে মাহতাব – কাঁদছো কেনো পাগলি? আমি তো আছি সফেদ জোছনায়, বৃষ্টি ভেজা বাদল রাতে ,শিশিরের ভেজা ঘাসে। তোমার পাঁজরের ভাঁজে ভাঁজে আছি তো আমি । কোথায় খোঁজ আমাকে?
মিতালী হঠাৎ সম্বিৎ ফিরে পায়। চিৎকার করে কেঁদে ওঠে বলে- তুমি এসেছো ? এতো দিন কোথায় ছিলে? কি ভাবে ছিলে তোমার মেয়েকে ছেড়ে আমাকে ছেড়ে?
দুহাত বাড়িয়ে কাছে টানতে চায় মিতালী ।ওর কথার কোন উত্তর না দিয়ে ছায়ামূর্তি জোছনা আলোয় লম্বা একটা রেখা টেনে হারিয়ে যায়।মিতালীর জল ভরা চোখের ঝাপসা দৃষ্টিতে মাহতাবকে আর দেখতে পায় না। কেবল লম্বা একটা রেখা দূরে চলে যায়। চোখের জল মুছে প্রখর দৃষ্টিতে আবার সামনে তাকায় । ওর দৃষ্টি আটকে যায় বিম্ব প্রতিবিম্বে হয়ে সামনে দাঁড়িয়ে থাকা ওর মেয়ে লাবনীর মুখে।
Leave a Reply