শনিবার, ২৭ Jul ২০২৪, ১১:১০ পূর্বাহ্ন

শিরোনাম :
ব্রাহ্মণবাড়িয়া-৪ (কসবা-আখাউড়া) আসনে আইন মন্ত্রী আনিসুল হক বে-সরকারি ভাবে নির্বাচিত কসবায় ভোট দিয়ে বাড়ি ফেরার পথে সড়ক দুর্ঘটনায় নিহত ১ আহত-৪ কসবায় এলজিইডি’র শ্রেষ্ঠ কর্মকর্তা-কর্মচারীদের মাঝে পুরস্কার বিতরণ অনুষ্ঠান আগরতলায় স্রোত আয়োজিত লোকসংস্কৃতি উৎসব কসবা প্রেসক্লাব সভাপতি’র উপর হামলার প্রতিবাদে মানবন্ধন ও প্রতিবাদ সভা কসবায় চকচন্দ্রপুর হাফেজিয়া মাদ্রাসার বার্ষিক ফলাফল ঘোষণা, পুরস্কার বিতরণ ও ছবক প্রদান শ্রী অরবিন্দ কলেজের প্রথম নবীনবরণ অনুষ্ঠান আজ বছরের দীর্ঘতম রাত, আকাশে থাকবে চাঁদ বিএনপি-জামাত বিদেশীদের সাথে আঁতাত করেছে-কসবায় আইনমন্ত্রী আনিসুল হক ১৩ দিনের জন্য ভোটের মাঠে নামছে সশস্ত্র বাহিনী
চান্নি রাইতের কান্দন

চান্নি রাইতের কান্দন

শেলী সেনগুপ্তা

হুরমতি বেওয়ার উঠোনে তারার হাট বসে গেছে। বড় মাদুর পেতে বসে আছে হুরমতি বেওয়া আর পাড়ার বাচ্চারা ওকে ঘিরে আছে, ওরা গল্প শুনছে।
– বলো গল্পদাদী, তারপর কি হলো?
– তারপর রাজকন্যে আর রাজপুত্র পঙ্খীরাজ ঘোড়ায় চড়ে পরীর দেশ থেকে ফিরে এলো।
– গল্পদাদী, গল্পদাদী, আরেকটা গল্প বলো।
– আজ আর নারে দাদুভাই, কাল এসো, অনেক সুন্দর সুন্দর গল্প বলবো।
অনিচ্ছা সত্বেও ছোট ছোট পা ফেলে ওরা ফিরে যায়। হুরমতি বেওয়া দীর্ঘশ্বাস ফেলে মাদুর গুটিয়ে নিজের ঘরে ফিরে যায়।
রোজ রাতে ওরা চলে আসে। হুরমতি বেওয়া পান চিবোও আর গল্প বলে আর ওরা মনোযোগ দিয়ে শোনে। পাড়ার বাচ্চারা ওকে গল্পদাদী বলেই ডাকে। ওর ভান্ডারে যে কত গল্প জমা আছে তা নিজেও জানে না। এ গ্রামের সবাই জানে হুরমতি বেওয়া বাচ্চাদের সাথে সময় কাটাতে খুব ভালোবাসে।
দু’টো দুধের গাই আর বেশ কয়েকটা হাঁস হুরমতি বেওয়ার সংসার। ওদের নিয়েই দিন কাটে। চারপাশে ঝোপঝাড় আর গাছওয়ালা বাড়ির একমাত্র অধিবাসী হুরমতি বেওয়া। তিনকূলে কেউ নেই। সারাদিন নিজের মনে ঘরে কাজ করে আর নিজের সাথেই কথা বলে। বাড়ির সামনে ছোট্ট একটা পুকুর আছে। মাঝে মাঝে বড়শী দিয়ে মাছ ধরে। যা পায় তাতে একার ভালোভাবেই চলে যায়। সারাদিন ঘরে কাজ করে সন্ধ্যে হলেই কুপি জ্বালিয়ে পাড়ার বাচ্চাদের অপেক্ষা করে। সারাদিন যে উঠোনটা দু’একটা পাখির ডাক ছাড়া কিছুই শোনা যায় না, সন্ধ্যায় সে উঠোন শিশুদের কলকাকলিতে ভরে ওঠে।
হুরমতি বেওয়া পাড়ার কারো সাতেপাঁচে থাকে না, কেউ তাকে নিয়ে কিছু ভাবেও না। দিনক্ষণও খুব একটা মনে রাখে না। সন্ধ্যা হলে মাঝে মাঝে আকাশের দিকে তাকিয়ে থাকে, যেন কিছু একটা খুঁজে। তারপর নিশ্চিন্ত মনে নিকোনো উঠোনে মাদুর পেতে অপেক্ষা করে। আশপাশের বাড়ি থেকে একে একে শিশুরা আসতে শুরু করে আর গল্পদাদী তার গল্পের ঝোলা খুলে বসে। পান মুখে দিয়ে একের পর এক গল্প বলতে থাকে। আর মুগ্ধ শ্রোতারা নিবিষ্টমনে শুনে। হাসির গল্পে যেমন হেসে ওঠে তেমনি গা ছম ছম ভয়ের গল্পে কেঁপে কেঁপে ওঠে। এদিক ওদিক তাকায় আর গল্পদাদীর গা ঘেঁষে বসে। মনে হয় যেন গল্পের দৈত্য-দানবরা এখনই এসে পড়লো। গা ছম ছম অবস্থায় গল্প শেষ হতেই গল্পদাদী ওদের আরো একটা মজার গল্প বলে হাসিয়ে দেয়। পরের দিন আরো অনেক গল্প বলার প্রতিশ্রুতি আদায় করে শিশুদের আসর ভাঙ্গে।

মাসের সবগুলো দিনরাত ভালোই কাটে, শুধু পূর্ণিমা রাতে গল্পদাদীর উঠোনে থাকে না শিশুদের কলকাকলি, গল্প শোনার বায়না নিয়ে শিশুরা ছুটে আসে না। সবাই জানে জ্যোছনারাতে গল্পদাদী কখনোই ঘরের বাইরে বের হয় না। অন্ধকার ঘরে মুখ লুকিয়ে বসে থাকে। সন্ধ্যার আগেই দরজা দিয়ে বসে থাকে। এ সময় জ্যোছনা ধোয়া উঠোনে কুয়াশার মতো কান্না ঝরে, হুরমতি বেওয়া একনাগারে কেঁদেই যায়। ককিয়ে ককিয়ে কান্নার শব্দ উঠোন ছাড়িয়ে গ্রামের পথে পথে ছড়িয়ে যায়। পুকুরে ঢিল ছোড়ার কম্পনে কান্না ছড়িয়ে পড়ে গ্রামের প্রান্তরে। বাড়ির আশপাশ দিয়ে যাওয়ার সময় যে কারো কারো চোখ ভিজে ওঠে।
গ্রামের শিশুরা সবসময় বেশ আনন্দে থাকে শুধু জ্যোস্না রাতে ঘরে বাইরে আসে না। সারা গ্রাম জুড়ে কারো কান্নার শব্দ ঢেউএর মতো দুলে দুলে যায়, শিশুরা ভয়ে মায়ের আঁচলে লুকিয়ে থাকে।

কেউ জানে না কেন কাঁদে হুরমতি বেওয়া? নতুন কেউ এ এলাকায় এলে ভয় পায়। এলাকার বৃদ্ধরা ঘোলাটে চোখে আকাশ দেখে, বৃদ্ধারা আঁচলের খুটে চোখ মুছে। হুরমতি বেওয়ার দুঃখের স্রোতে নিজেদের দুঃখটুকু মিশিয়ে দেয়,এ যেন পূজোশেষে নদীতে ভাসিয়ে দেয়া কনকাঞ্জলি। চালধোয়ার জলের মতো জ্যোস্না গড়ানো রাতে হুরমতি বেওয়ার কান্না শুনতে শুনতে কদমতলী গ্রামে বাতাস ভারি হয়। গ্রামের মানুষের চোখে ঘুমের পর্দা টানিয়ে দেয়।
এ রাতে হুরমতি বেওয়ার মতো আরো একজন নির্ঘুম রাত কাটায়। বাঁকানো লাঠিতে ভর দিয়ে হুরমতি বেওয়ার উঠোনে এসে দাঁড়ায় রহমত আলী বুড়ো। বদ্ধ দরজার সামনে বসে আফসোসে মাথা ঝাঁকায় আর নিঃশব্দে চোখের জল মুছে। তারপর বুকভাঙ্গা কান্না শুনতে শুনতে নিজের বাড়িতে ফিরে যায়।
রহমত আলী বুড়ো এ গ্রামের বয়স্ক লোকদের যে ক’জন জীবিত একজন। অনেক গল্প বুকের মধ্যে ধরে রেখেছে বাঁধ দেয়া নদীর মতো। মাঝে মাঝে গল্পগুলো বুকের ভেতর বড়শী কাঁটা গেলা মাছের মতো ঘাঁই মারে। প্রতিটা ঘাঁইয়ে কঁকিয়ে ওঠে রহমত আলীর মন।
রহমত আলী বুড়ো শুধু জ্যোস্না রাতেই হুরমতি বেওয়ার উঠোনো এসে দাঁড়ায়। অন্য সময় নিজের ঘরের দরজায় বসে নিজের মনে গান গায়। বেশ সম্পন্ন গৃহস্থ রহমত আলী বিপত্নীক। সংসারে এক নাতি ছাড়া আর কেউ নেই।
খুব ছোটবেলা থেকে নাতি বিজয় মামার বাড়িতে বড় হয়েছে। এখন ঢাকায় পড়াশুনা করে। দাদাকে খুব ভালোবাসে। ছুটিছাটা পেলেই দাদার কাছে চলে আসে।
এবার গ্রীষ্মের ছুটিতে দাদার কাছে এসেছে। বেশ কিছুদিন থাকার ইচ্ছা। সুযোগ পেলেই মনের সুখে সারা পাড়া চষে বেড়ায়। মাঝে মাঝে বড়শী দিয়ে মাছ ধরে। বাড়ির পাশের নদীতে নৌকা বাইচ করে। পাড়ার ছেলেদের নিয়ে হুরমতি বেওয়ার বাড়ির বাগান থেকে ফল পেড়ে বেশ মজা করে খায়, কিছু দাদার জন্যও নিয়ে আসে।
ঢাকা থেকে বিজয়ের ক’জন বন্ধু এসেছে। ওরা সিদ্ধান্ত নিয়েছে চাঁদনী রাতে নদীর পাড়ে বসে গল্প করবে। বিজয় ওদের জন্য চাল ভাজা আর বাদাম ভাজা এনে রেখেছে।
আজ পূর্ণিমা রাত, হাঁটি হাঁটি পা পা করে সন্ধ্য ঘনিয়ে আসছে। একটু একটু করে গ্রামটা বিষন্নতায় চাদরে ঢেকে যাচ্ছে। বিজয়ের কেমন যেন লাগছে। সন্ধ্যা থেকে দাদার মনটা খারাপ। আপন মনে হুক্কাতে দম দিচ্ছে। বিজয়ের বন্ধুরাও চুপচাপ হয়ে গেছে। ওদেরও ছুঁয়ে যাচ্ছে বিষন্নতা। একটা করুণ কান্নার সুর ফেনিয়ে ফেনিয়ে উঠছে। কাঁদছে, হুরমতি বেওয়া কাঁদছে।
লাঠিতে খুট খুট করে শব্দ করে রহমত আলী বুড়ো এসে দাঁড়ালো গাছগাছালিতে ভরা ঊঠোনে। পায়ে পায়ে বিজয়ও আসলো। পেছন থেকে দাদার কাঁধে হাত রেখে দাঁড়ালো। নাতির হাতটা ধরে ঝুঁকে ঝুঁকে ফিরে এলো নিজের দাওয়ায়।
বিজয়ের বন্ধুরাও রহমত আলী বুড়োকে ঘিরে দাঁড়ালো। সবার চোখে ব্যথাভরা প্রশ্ন।
লাঠিতে চিবুক ঠেকিয়ে রহমত আলী বুড়ো বসে আছে। এতোগুলো তরুণ চোখের সামনে বেশিক্ষণ ঝুঁকে বসে থাকতে পারলো না। ধীরে ধীরে মুখ তুলে তাকালো, কান্নাভেজা কন্ঠে বললো,
ঃ হুরমতি আমার দোস্ত করম আলীর বিবি, বিয়ার ক’মাস পরই শুরু অইলো মুক্তিযুদ্ধ। আমি আর করম আলি যুদ্ধে গেছিলাম, স্বাধীনতা আইনতে গেছিলাম। হুরমতি আমাগোরে গামছা বাইন্ধা গুড়-মুড়ি দিছিলো।
যুদ্ধে থাইকতে থাইকতেই খবর পাইলাম, এমন চান্নি রাইতে হুরমতির ইজ্জত লুইট্যা নিছে কাদের রাজাকার। বহুত চেষ্টা কইরছে পলাইয়া যাইতে, পারে নাই। চান্দের ফকফকা আলো হ্যারে পলাইতে দেয় নাই। কাদের রাজাকার ধইরা ফালাইছে। খবরডা হুননের আগেই বন্ধু যুদ্ধে মইরা গেছে।
তহন বাড়ির চাইর ধারে এমুন গাছও আছিলো না। হেই থেইকা হুরমতি বিবি বাড়ির চাইর ধারে গাছ লাগাইয়া ভইরা ফালাইছে, কিন্তুক চান্নি রাইত আইলে নিজেরে সামলাইতে পারে না, ঘরের মইধ্যে পলাইয়া পলাইয়া কান্দে। হ্যার কান্দনে গেরামডাও যেন কাইন্দা উডে।
শুনতে শুনতে ওদের চোখও জলে ভরে উঠলো। হুরমতি বেওয়ার কান্নার শব্দে চাঁদের আলোও কেঁপে উঠছে।
————————————————————–

এই সংবাদটি শেয়ার করুনঃ

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *




raytahost-demo
© All rights reserved © 2019
ডিজাইন ও কারিগরি সহযোগিতায়: Jp Host BD