শান্তশ্রী মজুমদার
(কলেজ শিক্ষিকা রামকৃষ্ণ মহাবিদ্যালয়)
আমার গল্পের পাঠকদের মনে কৌতুহলের সৃষ্টি হতে পারে, এ আবার কেমন গল্প! এমন অদ্ভুদ নামকরণ গল্পের। তাই গল্পের শুরুতেই বলে রাখছি —
চিনিভানুকে আমি চিনি না। কস্মিনকালেও চিনিভানুর সাথে আমার দেখা ও আলাপ হয়নি। হয়তো এ জীবনে তার সাথে কোনোদিন দেখা হবে না। চিনিভানুও আমায় চেনে না, চেনার কথাও না। তবুও চিনিভানুর উপস্থিতি আমার পরিবারের তিনজন সদস্যের জীবনের ভিতকে নাড়িয়ে দিয়ে আমার পরিবারকে মুহূর্তেই বিখ্যাত করে তুলেছিল। চিনিভানু মনিপুরের মেয়ে আর আমি ত্রিপুরার।
ত্রিপুরা, আসাম,মনিপুর, নাগাল্যাণ্ড,মেঘালয়, মিজোরাম, অরুণাচল উত্তর -পূর্ব ভারতের এই সাতটি রাজ্যকে বলা হয় সাত বোন। সেই হিসাবে চিনিভানু ও আমি মাসতুতো বোন। এবার হয়তো আমার গল্পের পাঠকরা প্রশ্ন করবেন, মাসতুতো বোন আপনার, আর বলছেন চেনেন না। সত্যি বলছি, চিনিভানুকে আমি চিনি না, তাকে আমি দেখিনি। তবু সে কি করে আমাদের বিখ্যাত করে দিলো?
——এমনিই হয়! ভাগ্যে যদি বিখ্যাত হওয়া থাকে, কে খণ্ডাবে! সবই কপাল। কপালের লিখন কে খণ্ডাবে!!
সেদিন ছিলো মার্চের ২০ তারিখ। সালটা,২০২০
কলকাতা এয়ারপোর্ট থেকে আমি, আমার মেয়ে আর আমার স্বামী রওনা দিয়েছি আগরতলার উদ্দেশ্যে। যে বিমানে আমরা ফিরছিলাম সেটা ছিলো এয়ার এশিয়ার বিমান। বিমানে মনিপুরের অনেক যাত্রী ছিলো। বিমানটি প্রথমে আগরতলার যাত্রীদের নামিয়ে তারপর মনিপুরের রাজধানী ইম্ফল যাবে।
মনিপুরের যাত্রীদের মধ্যে একটি মেয়ের নাম চিনিভানু। বিমান যথারীতি আগরতলা নামলে আমরা নেমে পড়লাম। আগরতলা থেকে ট্রেনে কুমারঘাট তারপর,আবার গাড়ি ভাড়া করে কৈলাসহর আসতে অনেক রাত হয়ে গেলো। দীর্ঘ একুশদিন ভ্রমণ করে বাড়ি ফিরছি। ঘরে চাল, ডাল,তেল লবণ কিছুই নেই।
তখন ভারতবর্ষে নতুন রোগ পদার্পণ করেছে।কোভিড -১৯.কোভিডের হাত থেকে মানব জাতিকে বাঁচানোর জন্য পরদিন ভারত সরকার ঘোষণা করেছে -জনতা কার্ফু। পুরো দেশে লকডাউন। দোকানপাট সব বন্ধ।
খুবই কষ্ট করে এইদিনটা কাটলো আমাদের। বাজার হাট করতে পারিনি। জনতা কার্ফুর পরদিন দুপুর একটায় ফোন আসলো, আগরতলা,এয়ারপোর্ট থেকে —এক মহিলা কণ্ঠস্বর জানালো, –আপনারা যে বিমানে এসেছেন, সেই বিমানে এক মহিলা যাত্রীর কোভিড -১৯ধরা পড়েছে। মহিলা করোনা পজিটিভ নিয়ে বিমানে আরোহন করেছে। ইম্ফলে গিয়ে পরীক্ষা করার পর উত্তর পূর্ব ভারতের প্রথম কোভিড রোগী হিসাবে তাকে কোয়ারান্টাইন করা হয়েছে। আপনাদের বিমানের আসন, সেই মহিলার সামনেই ছিলো। টিকিটের নাম্বার এবং সি সি টিভি ফুটেজ তাই বলছে। আপনারা যেহেতু কোভিড আক্রান্তের সাথে সফর করেছেন তাই আপনাদেরকেও কোয়ারান্টাইন করা হবে। বাড়ি থেকে বের হবেন না।কারো সাথে মিশবেন না।কাউকে বাড়িতে ঢুকতে দেবেন না।আপনারা আজ থেকে চৌদ্দদিন গৃহবন্দী থাকবেন।
নতুন যুগ, নতুন রোগ, নতুন শব্দ, নতুন নিয়ম —–
২০২০,কোভিড -১৯,মারণ রোগ, ভেকসিন আবিষ্কার হয়নি, কোনো ঔষধ নাই, বিশ্ব মহামারী চলছে, মানুষ মৃত্যু ভয়ে আতংকিত। কোয়ারান্টাইন, আইশোলেশন —নতুন নতুন নিয়ম।
ধলাইএর ডিস্ট্রিক ম্যাজিস্ট্রেট, কৈলাসহরের ডিস্ট্রিক্ট ম্যাজিস্ট্রেট, আগরতলা,এয়ারপোর্ট অথরিটি,কৈলাসহর থানা,কৈলাসহর হেল্থ ডিপার্টমেন্ট থেকে মুহুর্মুহু ফোন আসতে লাগলো। উপদেশ, নির্দেশ সতর্কতা —-নিমেষের মধ্যে আমরা তিনজন বিখ্যাত হয়ে গেলাম।
আধুনিক বিশ্বের আধুনিক প্রযুক্তির ব্যবহার চারদিকে। ওয়াটসআপে, ফেসবুকে শুধু আমাদের তিনজনের ছবি। কেউ কেউ দুঃখ প্রকাশ করছে, কেউ আবার,গালিগালাজ করছে, কেউ কেউ প্রচার করে পৈশাচিক আনন্দ উপভোগ করছে।
আমি যে সময়টার কথা বলছি, তখন ত্রিপুরা কোভিড রোগী শূন্য। জনমনে প্রবল আতংক। করোনার কোন ভেকসিন নেই, ঔষধ নেই। রোগ সংক্রমিত হলে অবধারিত মৃত্যু।
যাই হোক সেই দিনই ঘন্টাখানেকের মধ্যেই হেল্থডিপার্টমেন্ট থেকে একজন ডাক্তার, একজন সহকারী গাড়ি করে চলে আসলেন আমাদের বাড়ি।
তাদের মুখে মাক্স বাঁধা।পুরো শরীরে রেনকোটের মতো পোশাক। আমাদের বাড়ির সামনে সরকারী নোটিশ টানিয়ে দিলো —গৃহ কর্তার নাম, চৌদ্দদিনের কোয়ারান্টাইন। আমাদেরকে মাক্স দিয়ে গেলো। আর সাথে নির্দেশ –তিনজন তিনঘরে থাকবেন। পরদিন উনারা আবার গাড়ি করে আসলেন, আমাদের তিনজনের সোয়াব টেস্ট করতে হবে। সোয়াব টেস্ট করালাম। উনারা নমুনা নিয়ে চলে গেলেন। তিনদিন পর রিপোর্ট দেবেন বলে গেলেন। সোয়াব আগরতলা জিবি হাসপাতালে যাবে।সেখানে চরম নিরাপত্তায় পরীক্ষা হবে। এদিকে, আমাদের পাড়ায় শশ্মানের নিস্তব্ধতা বিরাজ করছে। আমাদের বাড়ির ওপর দিয়ে পাখি উড়ে গেলেও সে অশুচি হয়ে যাবে, এমন ভয়ংকর অবস্থা।
কেউ আমাদের বাড়ির ত্রিসীমানায় ঘেসে না।
শুধুই ফোনে খোঁজ খবর নিচ্ছিলো পরিচিতরা। দিনের মধ্যে পঞ্চাশ ষাট টা ফোন। শুধু অভয়বাণী, উপদেশ,নির্দেশ। গরমজল খাও,ভাপ নাও,আদা চা,খাও,লেবু রস খাও, লবঙ্গ দারচিনি তেজপাতার লিকার চা দিনে চার পাঁচবার খাও।
জীবনে যারা,কোনোদিন ফোন করে খোঁজ করেনি, তারাও ফোন করে খোঁজখবর করতে লাগলো।
ইতিমধ্যে গুজব রটে গেলো, আমাকে জি বি হাসপাতালে নিয়ে যাওয়া হয়েছে।
ফেসবুক, ওয়াটসআপে আমাদের তিনজনের ছবি পোষ্ট করে প্রচার করছে আমারই হিতাকাঙ্ক্ষী পুরোনো ছাত্ররা———– দেখে রাখুন, এই তিনজনের ছবি, এরা,করোনা,আক্রান্ত। এরা,বাইরে ভ্রমণ করতে গেছে। বাইরে থেকে কোভিড নিয়ে কৈলাসহরে এসেছে। এদের চিনে রাখুন। আমাদের পাড়ার এক ডাক্তার মহিলা আবার পোস্ট করছে –ইনি কলেজ শিক্ষিকা হয়ে কাজের মাসীকে বাড়িতে ঢুকতে দিয়েছেন, এমন শিক্ষিত মানুষকে ঘৃণা করা উচিত।
যতোদিন রিপোর্ট আসছিলো না, ততদিন চললো রটনা,নিন্দা,গুজব। এদিকে আমাদের ঘরে চাল ডাল নেই। কোনো বাজার নেই। কে বাজার করে দেবে!
আমরা মানসিক ভাবে ভেঙে পড়েছি। যদি সোয়াব টেস্টের রেজাল্ট পজিটিভ আসে তাহলে কি হবে! টেনশনে খাওয়া দাওয়া,ঘুম সব বন্ধ।
করোনা আক্রান্ত রোগী হিসাবে আমাদের শ্রাদ্ধ, শান্তি সব কাজ করে ফেললো ফেসবুকের আমার হিতাকাঙ্ক্ষীরা।
হায়রে চিনিভানু! একি করলি তুই! তোর রোগ হয়েছে, তুই বিমানে উঠলি কেন?তুই তো শুনেছি লণ্ডনে ডাক্তারী পড়িস, তবে হাসপাতালে থেকে চিকিত্সা করলি না কেন? কেন আমাদের মতো নিরপরাধ মানুষকে এমন বিপদে ফেললি? এই চিনিভানু লণ্ডন থেকে দিল্লী, দিল্লী থেকে কলকাতা,এলো বিমানে। কোন পরীক্ষা হোল না?বিমানে উঠার আগে?
তাহলে তো প্রথমেই ধরা পড়তো।
আমরা বেড়াতে গিয়েছিলাম দার্জিলিং। ভ্রমণ কালীন সময়ে ভারতে করোনা প্রবেশ করেনি। আমরা তবু সর্তক ছিলাম।মাক্স পরেছি। হাত স্যানিটাইজ করেছি।
খুবই ভালো করে বাড়ি ফিরেছি। তারপর এই বিপদ!
এই যে বললাম না,কপালের লিখন, কে খণ্ডাবে?
এক অপরিচিতা চিনিভানু আমাদের জীবনকে একেবারে তছনছ করে দিলো।
যারা,বিমানে ভ্রমণ করেন তারা সবাই জানেন যে, বিমানের সময়,মাত্র,চল্লিশ মিনিট। বিমানের ভেতর কেউ কথা বা গল্প করে না।কারো সাথে প্রত্যক্ষ সংস্পর্শ ঘটে না।আর সেদিন সবাই মুখে মাক্স পরেছিলো।
কয়েকদিন বিভীষিকা র মধ্যে থেকে ঈশ্বরের আশীর্বাদে, গুজবের মুখে থুথু দিয়ে আমাদের সোয়াব টেস্টের রিপোর্ট এলো নেগেটিভ। অর্থাৎ আমরা কেউ সংক্রমিত হই নি। করোনা মুক্ত।বুকের ওপর থেকে একটা বিরাট পাষাণ নেমে গেলো।
পৃথিবীটাকে খুব সুন্দর মনে হোল।বেঁচে থাকার আনন্দই আলাদা কিন্তু বেঁচে থেকে মৃত্যুর স্বাদ উপলব্ধি করালো চিনিভানু। চিনিভানুর কল্যাণে জীবনের এক অনাস্বাদিত দিক মর্মে মর্মে উপলব্ধি করলাম। গুজব এতো ভয়ংকর হোতে পারে, মানুষকে টেনশন দিয়ে মৃত্যুর মুখোমুখি দাঁড় করিয়ে দিতে পারে —–
এই কথাটা যে সব মূর্খেরা গুজব ছড়িয়ে পৈশাচিক আনন্দ উপভোগ করে, তাদের বোধগম্য হবে না কোনোদিন।
বর্তমানে ত্রিপুরায় কোভিড রোগীর সংখ্যা হাজারো। মৃত্যুও প্রচুর হয়েছে। মার্চ থেকে অক্টোবর -এই আট মাসে মানুষ কোভিডকে জীবনের সঙ্গী করে নিয়েছে। এখন আক্রান্তের সংখ্যা, মৃত্যুর সংখ্যা -কোনো কিছুর ই
হিসাব আর আমরা রাখি না।
আমার স্বামী এখন গর্ব করে গল্প করে, —এখন কোভিডে আক্রান্ত হলে কুকুরেও খোঁজ রাখেনা আর আমাদের সময়,কোভিডের সহযাত্রী হয়ে, শত শত লোক আমাদের খোঁজ রেখেছে। আমি মনে মনে এই ভাবনাকে নাম করণ করেছি ——করোনার অহংকার।
——————————
Leave a Reply