পাভেল আমান
বাংলা কবিতার ভুবনে আঙ্গিক ,বিন্যাস,গঠনশৈলী সবদিক দিয়ে নতুনত্বের জন্য রবীন্দ্রনাথের পরে যার নাম উচ্চারিত তিনি আর কেউ নন। জীবনানন্দ দাশ। স্বকীয় সৃজনশীল প্রতিভায় বাংলা কবিতাকে তিনি আধুনিকতার উচ্চমার্গীয় স্তরে প্রতিষ্ঠিত করেছেন। তাঁর পূর্বে আর কেউ তার মতো সাধের প্রাণের বাংলাকে নিয়ে কাব্যরচনা করেননি। যা লিখিত হয়েছে, তা অন্যভাবে প্রতিভাত হয়েছে। যার ফলে বাংলা কবিতার চলমান ধারায় আজও তিনি চূড়ান্ত আধুনিক। সে জন্যই একমাত্র তিনিই মাথা উঁচু করে বলতে পারেন, ‘তোমার যেখানে সাধ চলে যাও, আমি এই বাংলার পারে রয়ে যাব।’
জীবনানন্দ দাশের জন্ম ১৮৯৯ সালের ১৭ই ফেব্রুয়ারি অবিভক্ত বাংলার বরিশাল জেলায়। ১৯২১ সালে কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে ইংরেজি সাহিত্যে এম.এ ডিগ্রি লাভ করেন তিনি। কর্মজীবনে কিছুকাল জীবন বীমা কোম্পানির এজেন্ট হিসেবে কাজ করেছেন। কয়েক বছর ‘দৈনিক স্বরাজ’ পত্রিকায় সাহিত্য বিভাগ সম্পাদনার দায়িত্বে ছিলেন। তবে অধিকাংশ সময়ই যুক্ত ছিলেন অধ্যাপনায়। জীবনানন্দ দাশের প্রথম প্রকাশিত কাব্যগ্রন্থ ‘ঝরাপালক’ প্রকাশিত হয় ১৯২৭ সালে। তাঁর অন্যান্য কাব্যগ্রন্থগুলোর মধ্যে ‘ধূসর পাণ্ডুলিপি’, ‘বনলতা সেন’, ‘মহা পৃথিবী’, ‘সাতটি তারার তিমির’, ‘রূপসী বাংলা’ ইত্যাদি উল্লেখযোগ্য। কবিতা ছাড়াও তাঁর প্রবন্ধগ্রন্থ ‘কবিতার কথা’, গল্পগ্রন্থ ‘গল্পসমগ্র’, এবং উপন্যাস ‘মাল্যবান’ ও ‘সতীর্থ’ বাংলা সাহিত্যে উল্লেখযোগ্য সংযোজন। জীবনানন্দ দাশের লেখা গল্পগুলোর মধ্যে উল্লেখযোগ্য ‘কুয়াশার ভেতর মৃত্যুর সময়’, ‘রক্তমাংসহীন’, ‘পাতা তরঙ্গের বাজনা’, ‘পালিয়ে যেতে’, ‘জামরুলতলা’ ইত্যাদি বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য। বুদ্বদেব বসু কবি জীবনানন্দ দাশকে অ্যাখ্যায়িত করেছেন নির্জনতম কবি হিসেবে।
অন্নদাশংকার রায় তাকে শুদ্ধতম কবি হিসেবে আখ্যায়িত করেছেন।গ্রাম বাংলার ঐতিহ্যময় নিসর্গশোভা, মানবপ্রেম, বিষন্নতা আর বিপন্ন মানবতার বেদনা ও হতাশাবোধ প্রকাশিত হয়েছে জীবনানন্দের কবিতায়। পরিবর্তমান কাল, অতীত আর বর্তমান ইতিহাসের রূপকাশ্রয়ী, বিষাদময় প্রকাশও তাঁর কবিতার বৈশিষ্ট্য। আধুনিক শহর-নগর এসেছে গ্রামের আবহে। তাঁর কবিতা চেতনাকে এমনভাবে হরণ করে নেয় যে, জীবনের কোলাহল মুখরতা মুহূর্তেই যেন স্তব্ধ হয়ে যায়। সব মিলিয়ে জীবনানন্দ দাশ প্রেম, সৌন্দর্য ও বিষন্নতার কবি। আর এর প্রকাশ স্নিগ্ধ কোমল চেতনায় মূর্ত। ১৯৫৪ সালের ২২শে অক্টোবর কবি প্রয়াত হন।নিভৃতচারী, চুপচাপ নিঃসঙ্গ এই মানুষটি বেঁচে থাকতে খ্যাতির চেয়ে বেশি সয়েছেন অবহেলা, বিদ্রুপ। কেউ কেউ তাকে নিয়ে নিয়মিত বিদ্রুপ করে লিখে যেতো বিভিন্ন কাগজে।অসাধারণ একজন কবি হয়েও জীবদ্দশায় জীবনানন্দ দাশ কোনো খ্যাতি পাননি। তার খ্যাতি, সুনাম, জনপ্রিয়তা শুরু হয় মৃত্যুর পর। কবিতা তাকে দিয়েছে অমরত্ব।মৃত্যুর অনেক বছর পর তার কবিতা ইংরেজি ও ফরাসিসহ ইউরোপের অনেকগুলো ভাষায় অনূদিত হয়। তার জীবন ও কর্মের ওপর অনেক লেখকরা লিখছেন, গবেষণাও করছেন।মৃত্যুর অনেক পর তিনি বাংলা ভাষার অন্যতম শ্রেষ্ঠ কবি হিসেবে খ্যাতি লাভ করেন। মৃত্যুর পর জীবনানন্দ দাশের শ্রেষ্ঠ কবিতা বইয়ের জন্য দেওয়া হয় সাহিত্য আকাদেমি পুরস্কার।রূপসী বাংলার কবি জীবনানন্দ দাশ তার কবিতার মতো আজও হাজার বছর ধরে পথ হেঁটে চলেছেন।না থেকেও তিনি যেন ধানসিঁড়িটির তীরে বার বার ফিরে আসেন কবিতা দিয়ে আপামর কবিতাপ্রেমী বাঙালি পাঠকের মননে।মৃত্যুর পরও জীবনানন্দ দাশ যেন এতটুকু পুরনো হননি। তাঁর কবিতা যুগের সাথে তাল মিলিয়ে আজও দিয়ে চলেছে পাঠকের মনের খোরাক। কবিতার মাধ্যমে মহাত্মা হয়েছেন ‘মহাত্মা’র এ স্রষ্টা। বেঁচে থাকতে কোন মূল্যায়ন না পেলেও কবির যেন এতটুকু ক্ষোভ ছিল না। তিনি জানতেন, ঠিক একদিন মানুষের দ্বারাই তিনি পূজিত হবেন। কিন্তু হায়, সেদিন তাঁর সেই পূজা গ্রহণ করার কোন সামর্থ থাকবে না। তিনি পৃথিবীতে এসেছেন, আবার চলেও যাবেন। এটাই সত্য, এটাই চিরন্তন।তিনি চির অনন্য। তাঁর জন্মদিনে তাই আমাদের বিনম্র নমস্কার এই ক্ষণজন্মা কবির প্রতি। কারণ তাঁর মতো আর নেই, এবং এই বাংলা তাঁকে ভুললেও চিরবহমানতায় তিনি অমর বাংলা সাহিত্যের আকাশে।
পাভেল আমান- হরিহর পাড়া, মুর্শিদাবাদ
Leave a Reply