ফরিদ আহমদ দুলাল
পথিকের যখন যাত্রা শুরু, তখন প্রায় মধ্য-গগনে পূর্ণিমা চাঁদ, চন্দ্রসভা করে আসর জমিয়েছে। শহর থেকে গাঁয়ে যাবে পথিক। এই রাতে না গেলেই চলতো, কিন্তু সকালে তার ঘুম ভাঙার সংকট, ঘুম ভাঙার চেয়ে শয্যাত্যাগের সংকটটাই বড়। অন্যদিকে যার সাথে কাজ এবং সাক্ষাতের তারিখ পূর্ব নির্ধারিত, তিনি বড্ড কট্টরস্বভাব। কমিটমেন্ট ভঙ্গের জন্য চুক্তি বাতিল অসম্ভব কিছু নয় তাঁর কাছে। অগত্যা জোছনায় ভিজে পথিক যাত্রা করলো শহর থেকে। কালির বাজার যাবার রিক্সা নেই একটাও; শেষ-মেষ একটা টেম্পো পাওয়া গেল, সেটা ভাবখালি বাজার পর্যন্ত যাবে। অগত্যা তাতেই উঠে বসলো চালকের পাশের সিটে। শহরের আকাশে চাঁদটাকে ততো উজ্জ্বল মনে হয়নি; চারপাশে পথের আলো, দোকানপাটের আলো, তার উপর ডিসেম্বরের দশ থেকে ষোল তারিখ শহরে বিজয়োৎসবের বর্ণিল আলোকসজ্জা; সব মিলিয়ে যেনো দেয়ালির উৎসব; জ্যোৎস্নার আলো সেখানে অনেকটাই মলিন; কিন্তু শহর থেকে বেরুবার সাথে সাথে পথিক অবাক হয়ে দেখলো, চন্দ্রালোকের মহিমা। পথের দু’পাশে গাছে-গাছে শিশির ভেজা পাতায়-পাতায় ছড়িয়ে আছে জ্যোৎস্নার মায়াবী যাদু। আঁধারের চাদরে চাঁদ যেনো বুনন করে চলেছে রূপালি আলোর কারুকাজ। পথিক অবাক হয়ে ভাবলো, ’ওগো চাঁদ, তুমি পৃথিবীর আকাশে জ্বেলেছো ভালোবাসার হাসি। তোমার ঐ রূপের বিভা পান করে আবেগী মানুষ প্রেমমগ্ন হয়; আমি দেখি নিরন্ন মানুষের ক্ষুধার্ত শরীরে অনিচ্ছায়ও লেগে আছে তোমার জ্যোৎস্নালোক; যাতে তার ক্ষুধা নিবৃত্ত হয় না কখনো। ক্ষমা করো রূপবতী চাঁদ, তোমার জ্যোৎস্নায় আমি চন্দ্রাহত হতে চাই না। পথের জ্যোৎস্নাকে পথে রেখে পেঁৗছাতে চাই ভিন্ন রজনীর আঁচলতলে অনন্য জ্যোৎস্নায়।’
পৌষের এখনো ক’দিন বাকি, কিন্তু শীত বেশ জেকে বসেছে। শহরের বাইরে শীতের প্রকোপটা বেশি। পথিকের মনে হলো শৈত্যপ্রবাহ চলছে। রাস্তার দু’পাশে শস্যশূন্য মাঠের উপর সমাবেশ করে ভাসছে কুয়াশার মেঘখÊ; যেনো জ্যোৎস্না উদযাপনে জড়ো হয়েছে তারা আজ। শীতের তাড়া খেয়ে ঘুমিয়েছে গ্রাম অনেক আগে। পথিকের ভাবনায় চন্দ্রালোক সরিয়ে হাজী সাহেবের মুখ ভেসে ওঠে বারবার।
দু’সপ্তাহ আগেই হাজী সাহেবের সাথে সবকিছু চূড়ান্ত করে এসেছে পথিক। মৎস্য চাষে পথিকের সঙ্গী হবে হাজী সাহেবের বড় ছেলে, তার বন্ধু নূরুল আমিন এবং মোতালেব খান, আলোচনায় সবাই ছিলো। তিন বছরের চুক্তি হাজী সাহেবের সাথে। হাজী সাহেবের বহির্বাটিতে দুই একর জমির বিশাল পুকুর। এ এলাকায় মৎস্যচাষ কার্যক্রম এখনো বিকশিত হয়নি বলেই পুকুরের কদর বাড়েনি; হয়তো সে কারণেই হাজী সাহেব তিন বছরের জন্য পুকুরটা দিচ্ছেন মাত্র বিশ হাজার টাকায়; তবে দশ হাজার টাকা অগ্রীম দিতে হবে। ডিসেম্বরের ১২ তারিখের মধ্যে অগ্রীমের টাকাটা দিতে হবে এবং চুক্তিনামায় স্বাক্ষর করতে হবে; অন্যথায় চুক্তি বাতিল। ইতোমধ্যেই দেড়শ টাকা মূল্যের স্ট্যাম্প কিনে পৌঁছানো হয়েছে হাজী সাহেবের কাছে। যা-কিছু লেখার প্রয়োজন, হাজী সাহেব নিজেই লিখে রাখবেন। ১১ তারিখের মধ্যে টাকা জোগাড় করতে পারেনি পথিক। আজই সন্ধ্যায় জোগাড় হলো টাকা।
কালির বাজারের আগেই রিক্সাচালক থামিয়ে দিলো চলা, এখানেই তাঁর বাড়ি। “সামনে আর যাইবো না সাইব। এইহানত্যে আপনের হাইটাই যাইতে অইবো বারইগাঁও পর্যন্ত। সামনে রাস্তায় কাম চলতাছে। আমি আপনেরে একটা বুদ্ধি দিতে পারি; মাডির রাস্তা ছাইড়া আপনে রেললাইন ধইরা হাইটা যাইতে পারেন। আপনের লাইগ্যা অইডাই বুদ্ধিমানের কাম অইবো।” চলে গেলো রিক্সাচালক। সামান্য হাঁটার পর কয়েকজন চন্দ্রভুক মানুষের সাথে দেখা হলো পথিকের। রাস্তার পাশে আগুন জ্বালিয়ে তারা নিজেদের উত্তপ্ত রাখতে চেষ্টা করছে। পথিককে একা হাঁটতে দেখে একজন প্রশ্ন করলো, “আপনি যাইবেন কই ম্যাভাই?” পথিক সহজভাবে আগুনের কুন্ডলির পাশে বসে গেলো। নিজের হাত দু’টি আগুনে সেঁকে নিয়ে বললো, “বারইগঁাও হাজী সাহেবের বাড়ি যাবো।” অন্য এক চন্দ্রভুক বললো, “রাইত বেশি না হইলেও শীতের রাইত তো, কমও না। সামনে রাস্তা খুবই খারাপ, জ্যোৎস্না থাকলেও গাছগাছড়ার লাইগ্যা রাস্তাডা আন্ধার।” পথিক তাদের সাথে স্বজনের মতোই বললো, “অন্ধকার হলেও আমার যেতে হবে!” অপেক্ষাকৃত বয়েসী লোকটা সিগারেটে লম্বা একটা টান দিয়ে বললো, “আপনে একটা কাম করতে পারেন, এই গুপাট দিয়া রেললাইনে উইঠা পরেন, তারপর রেললাইন দিয়া হাইটা যান! আপনের লাইগ্যা সেইটাই ভালো অইবো।” পথিক কোনো প্রশ্ন না তুলে রেললাইনে উঠে গেলো। পকেটে তার বেশকিছু টাকা। নিজেই নিজেকে প্রশ্ন করলো, “এদের কাছে কী খবর এসেছে কোনো? আমার পকেটে যে এতোগুলো টাকা সে খবর কী এরা পেয়ে গেছে?” একা একাই হাসলো পথিক, অতঃপর রেললাইন ধরে হঁাটতে শুরু করলো নিজের ছায়াকে সঙ্গী করে। মাইলখানেক পথ হাঁটতে হবে তাকে। এখানে রেললাইন সোজা চলে গেছে দক্ষিণ-পূর্ব দিকে। পূর্ণিমার আলোয় অনেক দূর দেখা যাচ্ছে।
যেখানে তার দৃষ্টি থামলো, সেখানে একটা দীর্ঘ ছায়ামূর্তি দু’দিকে দু’হাত প্রসারিত করে ঈগলের মতো ডানা নাড়ছে, একবার সোজা হয়ে দঁাড়াচ্ছে, আবার উবু হয়ে রেললাইনে মাথা নোয়াচ্ছে। দৃষ্টিভ্রম বুঝে পথিক হঁাটলো সামনে, এসময় পিছনে পদশব্দ শুনতে পেলো সে; ঘাড় ঘুরিয়ে একবার পিছনে দেখতে চেয়েও থেমে গেলো। মুহূর্তে তার চিন্তায় ছোট বেলায় শোনা অসংখ্য ভূতের গল্প এসে ভীড় করলো। পথিকের যদিও ভূত-প্রেতে সামান্য বিশ্বাসও নেই, কিন্তু জ্যোৎস্নালোকে সে পিছনে দেখার সাহস পেলো না। এমন পরিস্থিতিতে পিছনে দেখতে গেলেই না-কি বিপর্যয়! পথিক হঁাটছে, আর মনের সংশয় কাটাতে গুনগুন করে গান গাইছে। দূরের ছায়াটা এখনো দু’হাত নাড়ছে, আরও একবার রেললাইনে মাথা নুয়ালো। পথিক এবার দ্র“ত পা চালায়, ছায়ামূর্তির কাছাকাছি আসতেই দেখলো উল্টো দিক থেকে রেললাইন ধরে আরও একটি ছায়া এগিয়ে আসছে তার দিকে; এবার জ্যোৎস্নার মহিমায় সে চিন্তিত হলো; দিব্বি সে বুঝতে পারছে তার মনে ভয় সংক্রমিত হচ্ছে। ভয়ের বিভিন্ন আলামত টের পাচ্ছে সে; জিভ শুকিয়ে যাচ্ছে, পা দু’টি আড়ষ্ট হয়ে পড়ছে, দু’চোখে ক্লান্তি নেমে আসছে; যেনো হঁাটতে হঁাটতেই ঘুমিয়ে পড়বে পথিক। নিজেকেই মনে মনে প্রশ্ন করলো, “কোথায় যাচ্ছো চন্দ্রাহত পথিক এই জ্যোৎস্না প্লাবিত রাতে?”
ছায়ামূর্তির কাছাকাছি চলে আসে পথিক, উল্টো দিক থেকে আসা ছায়াটিও কাছাকাছি। পেছনের পদশব্দ হঠাৎ থেমে গেছে। পথিক ডানদিকের ছায়ামূর্তির দিকে তাকাচ্ছে না। উল্টোদিক থেকে আসা ছায়াটি এবার কথা বলে উঠলো “পথিক ভাই! আমি তো আপনেরে আগ্গাইয়া নিতেই আইলাম!” পথিক অবাক, জ্যোৎস্নালোক যেনো মুহূর্তে মহিমান্বিত হয়ে উঠলো আবার। “অবাক কান্ড খাঁ সাহেব! আমি আসছি এ খবর কে আপনাকে বললো?” খান হো হো করে হেসে উঠলো। দু’জন এবার পাশাপাশি হাঁটছে, পিছনের ছায়ামূর্তি পিছনেই পড়ে থাকলো। খান বললো, “আজ কত তারিখ আপনের মনে নাই? বারো তারিখ, আইজ তো আপনের আউনেরই কথা। একজন আমারে কইলো আপনেরে ভাবখালি বাজারে নামতে দেখছে টেম্পুত্তে, তাই আমি আইলাম। চিন্তা করলাম টেকা নিয়া আইবেন।” খানের কথায় আশ্বস্ত পথিক। লেখাপড়া না-জানা মানুষটার মেধা আছে বটে! অন্যদিন এ সময় শুয়ে পড়েন হাজী সাহেব; কিন্তু আজকের মায়াময় জ্যোৎস্না আর পথিকের কমিটমেন্ট জাগিয়ে রেখেছে তাঁকে। কেনো যেনো পথিককে তঁার ভিন্ন এক জ্যোৎস্না মনে হয়েছিলো। পথিক কথা দিয়েছিলো ১২ তারিখ টাকা নিয়ে আসবে। রাত যত বাড়ছে হাজী সাহেবের মন ততই খারাপ হয়ে যাচ্ছে। অগত্যা একটু সময় নারকেলের চিরল পাতার ফঁাকে আকাশে চন্দ্রসভা দেখে ছেলেকে ডেকে বললেন, “পথিক তো এলো না, তোমাদের সাথে আমার চুক্তিটা মনে হয় বাঁচলো না!” অজু করতে গেলেন। তাহাজ্জতের নামাজে দঁাড়ালেন জায়নামাজে। এ সময় দরোজায় কড়া নাড়ার শব্দ। দরোজায় পথিক দঁাড়িয়ে, সাথে তিন সৌখিন মৎস্যচাষী। পথিক সালাম দিয়ে বললো, “আপনি না-কি চুক্তি বাতিল করতে চাইছেন?” হাজী সাহেব হেসে বললেন, “আমার কাছে তো বিকল্প নেই। আপনি যখন কমিটমেন্ট ফেল করলেন, আমার তো চুক্তি বাতিল করতেই হয়।” পথিক একপলক চুপ থেকে বললো, “আমি আপনাকে কথা দিয়েছিলাম, ১২ তারিখের মধ্যে দশহাজার টাকা অগ্রীম দিয়ে চুক্তিপত্রে স্বাক্ষর করবো। ঘড়ি দেখে বলুন ক’টা বাজে?” হাজী সাহেব ঘড়ি দেখলেন, এগারোটা পঞ্চাশ। একবার লজ্জার হাসি হাসলেন, বললেন, “ও ঘরে গিয়ে বসুন, চা-টা খান, আমি নামাজটা পড়ে আসছি, তারপর চুক্তিপত্রে স্বাক্ষর হবে।” মনে প্রশান্তি নিয়ে জায়নামাজে দঁাড়ালেন হাজী সাহেব। বিশাল বাড়ির প্রকান্ড উঠোন ভরা তখন জ্যোৎস্না খেলা করছে; পথিক সবাইকে নিয়ে উঠোন পেরিয়ে বৈঠকখানার দিকে হেঁটে গেলো। দক্ষিণ পাশের ঘরে কপাটের আড়ালে তখন মুগ্ধ রজনীর অপেক্ষা, ভিন্ন এক জ্যোৎস্নার বাটি হাতে।
Leave a Reply