সোলায়মান সুমন
জোছনার জাল ছিড়ে দাঁড়িয়ে থাকা পুরনো হোটেলটা যেন কোনো বেওয়ারিশ নারীর ভবঘুরে আত্মা । বিলাল এদিক ওদিক তাকিয়ে টুপ করে জোছনা ভেদ করে সেখানে ঢুকে পড়ে। গভীর এক অন্ধকার তাকে জাপটে ধরে।
ঢাকায় সামান্য বেতনের চাকরি করে বিলাল। বউকে ঢাকায় নিয়ে সংসার পাতার স্বপ্ন আজো তার স্বপ্নই রয়ে গেল।
বিয়ের আগে এক উড়নচণ্ডী বন্ধুর সাথে এই হোটেলে একবার এসেছিল বিলাল।
-কাকে চান?
-হালিম ভাই আছে?
-না, ভেতরে যান। বিলালের প্রশ্ন শুনে লোকটার চেহারার উৎকণ্ঠার চিহ্ন মিলিয়ে যায়। হাসান ভাই, এদিকে আসেন। লোকটা কাকে যেন ডাক দেয়। ভেতর থেকে লিকলিকে পাতলা গড়নের শ্যামলা একজন লোক বেরিয়ে আসে। ‘আপনি উনার সাথে যান। লোকটি বিলালের দিকে আশ্বস্তের দৃষ্টি রেখে বলে।
-হালিম ভাই নাই? বিলাল লোকটির সাথে অন্দর মহলের দিকে যেতে যেতে বলে।
-চাকরি ছেড়ে দিয়েছে। মাল আপনি চয়েস করবেন না আমি পাঠাব।
-আপনি পাঠান। তবে বয়সটা কাঁচা হতে হবে।
-এ্যাকেবারে আঙ্গুর দিব।
বিলাল একটা ফাঁকা রুমে গিয়ে বসে। বুকের ভেতরটা একটা ভালো লাগায় দুরদুর করে কাঁপছে। উত্তেজনায় মুখ শুকিয়ে কাঠ হয়ে গেছে। আজ হঠাৎ কোন ভূত যে চাপল তার মাথায়? কেন যে এ মুখো হল সে? গার্মেন্টস-এ এখন অনেক কাজের চাপ। শত চেষ্টা করেও এখন ছুটি মঞ্জুর করানো সম্ভব হবে না। তা না হলে গ্রামে গিয়ে বউয়ের মুখ দর্শন করে আসতে পারত। তাছাড়া যাওয়া আসায় হাজার টাকার উপর খরচ হয়ে যাবে। উত্তেজনায় বিলালের চিন্তাগুলো এলোমেলো হয়ে ছিন্ন-বিচ্ছিন্ন হয়ে যেতে থাকে। বউয়ের সুন্দর মুখটা তার চোখের সামনে বার বার ফুটে ওঠে; রান্না ঘরে বাটনা বাটে- কুটনা কাটে বউ। পুকুর ঘাটে জলের বুকে ঝাপটি মারে, সাঁতার কাটে বউ। জলের ছাট পাখি হয়ে এদিক ওদিক ওড়ে। আহ! বউটা তার পরাণ পাখি চুরি কইরা কোন অচেনা আকাশে উইড়্যা উইড়্যা বেড়ায়। মনটা তার বড়ই ছটফটায়। আহারে! বিলালের মনটা চাতক পাখির মতো এক ফোটা জলের আশায় ঠোঁট দুটো হা কইরা তাকায়্যা আছে আকাশ পানে। অস্থির বিলাল ছটফটিয়ে এদিক ওদিক পায়চারি করতে করতে জানালার পর্দাটা ভাল করে সরিয়ে দিয়ে আকাশের দিকে চায়। মেঘের পাতলা পার্দায় লাজুক চাঁদ আঁড়াল হয়ে থাকলেও তার রূপালি জোছনাকে সে লুকায়ে রাখতে পারেনি।
ওদের বাসর রাতে আকাশে রূপালি থালার মতো গোল চাঁদ উঠেছিল। আকাশ ভরা পূর্ণ জ্যোৎস্না চুয়ে চুয়ে পড়ছিল মাটির বুকে। খোলা জানালা দিয়ে সেদিকে তাকিয়ে বিলাল বসেছিল। রূপালি আলো জানালা দিয়ে ঘরে ঢুকে চারিদিকে ছড়িয়ে পড়ছে। সেই চকচকে গাঢ় আলোর প্লাবনে পুরো বিছানাটা যেন রূপালি নদী। বিলালের মন আজ অজানা আনন্দে বিভোর। দীর্ঘ ঘোমটা দেয়া নতুন বউটাকে ঘরে দিয়ে বিলালের বোন টুম্পা মুখে কৌতুকের হাসি চেপে ঘরের বাহির থেকে দরজাটা ভাল করে ভেজিয়ে দিল। নতুন বউ বিলালের কাছে এসে আড়ষ্ট হয়ে দাঁড়ায়। বউ তার পা ছুঁয়ে সালাম করে। বিলাল বউকে জড়িয়ে ধরে চুমু খায়। সদ্য ফোটা গোলাপের পাঁপড়ির মত থরথর করে কেঁপে ওঠে বধুয়ার ঠোঁট। তারপর দুটি মন, দুটি আত্মা, দুটি জীবন এক হয়ে যায়। তারাই যেন এই পৃথিবীর প্রথম মানব-মানবী আদম-হাওয়া। একটা বিশুদ্ধ অঙ্গিকারে আবদ্ধ হয় দুটি প্রাণ। তাদের সেদিনের হৃদয়ের পবিত্র মিলনের সাক্ষী হতে এসেছিল ঐ চাঁদ।
চাঁদের দিকে মুগ্ধ হয়ে তাকিয়ে ছিল বিলাল।
হঠাৎ দরজাটা নড়ে ওঠে। ঘরে ঢুকে এক অষ্টাদশী। এক হাতে তার সস্তা লেডিস ব্যাগ। অন্য হাতে এক খণ্ড সাবান আর কনডমের প্যাকেট। তরুণী বিলালের কোলে শরীরটা এগিয়ে দেয়। বিলাল তার গালটা আলতো করে ছুঁয়ে দিল মেয়েটির গালে। খোঁচা খোঁচা শশ্রুমণ্ডিত গালের খোঁচা খেয়ে মেয়েটি গোঙিয়ে ওঠে।
তারপর…অতঃপর…আরো একটু পরে…এবার…চুমুর চুম্বকে জড়াজড়ি দু’টি দেহ।
-তুই আমার পরান রে নাগর
-তুই আমার জান।
চাঁদটা মেঘের আঁড়াল থেকে বেরিয়ে জানালায় এসে বসে।
খিল খিল করে হেসে ওঠে মেয়েটি।
-জানোয়ারের মতো আদোর করছ কেন সোনা?
-করব না, পয়সা ওসুল করে ছাড়ব।
-পয়সা দেছো দ্যাককা মোরে মাইরা ফ্যালাইবা?
-রাগিস না রাগিস না, তুই তো আমার বউরে শালি।
এবার জ্যোৎস্না ভেজা চাঁদটা ঘরে ঢুকে কটমট চোখে বিলালের ঠিক মুখোমুখি এসে দাঁড়ায়।
Leave a Reply