এস এম শাহনূর
➤দ্বিতীয় পর্ব:
বিংশ শতকের প্রথম দিকে উপমহাদেশের রাজনীতি, সংস্কৃতি ও ধর্মচর্চার অবাধ কেন্দ্র হিসেবে গড়ে উঠেছিল কুমিল্লার মহেশাঙ্গন।শিক্ষা বিষয়ে মহেশ চন্দ্রের নিজস্ব দর্শন ছিল। তিনি মনে করতেন, একমাত্র শিক্ষাই মানুষকে মুক্তি দিতে পারে, করে তুলতে পারে আত্মনির্ভর। ” মহেশ চন্দ্র ‘স্বাবলম্বন’ কথাটিকে অন্তরের স্বাধীন ভাব হিসেবেই বুঝতেন এবং সেই স্বাধীন ভাব অর্জনের পরম উপায় হিসেবে শিক্ষালাভ করা ও জ্ঞানচর্চা অব্যাহত রাখাকে অবিকল্প মানতেন।”
বৈষয়িক উন্নতির চেয়ে জ্ঞানচর্চার উন্নতিকেই তিনি মানুষের মুক্তির প্রকৃত উপায় হিসেবে চিহ্নিত করতে পেরেছিলেন। তাই নিজের আয়ের অর্ধেক নিয়মিতভাবে তিনি দান করে গেছেন প্রজন্মের শিক্ষাবিস্তারের পেছনে। এমনকি তাঁর কুমিল্লার কোটি কোটি টাকার সম্পত্তি, ব্যবসা—সবই দান করে গেছেন শিক্ষাজ্ঞানচর্চা অব্যাহত রাখতে।
নিজের এই ঔদার্যের কথা তিনি কাউকে জানতে দিতে চাননি। নিজের চিন্তাদর্শন প্রকাশ করাও তাঁর কাছে অহংকার প্রচারের শামিল ছিল। কাজের মধ্য দিয়েই প্রকাশ করেছেন নিজেকে।সে কারণেই হয়তো আজও বাংলাদেশের মানুষ তাঁর সম্পর্কে অবগত নয়। অথচ ভারতে ও কুমিল্লাসহ নূরনগর পরগনার মানুষের জন্য সেই আমলে তিনি যা করেছেন, অন্তত তাঁর মৃত্যুর পর সে তথ্য প্রচারণার প্রয়োজন ছিল।রূপকথার কল্পের মত তাঁর মহৎ কর্ম নিয়ে আলোচনা বাঙালি জাতিকে এগিয়ে যাওয়ার অনুপ্রেরণা যোগাবে বলে আমার দৃঢ় বিশ্বাস।মহেশ চন্দ্র ভট্টাচার্যের জীবন ও কর্ম নিয়ে প্রচুর লেখালেখি ও বিস্তর গবেষণা প্রয়োজন।তাতে মহেশ চন্দ্রের মতো একজন মহান শিক্ষানুরাগীর প্রতি জাতির ঋণ সামান্য হলেও লাঘব হবে।
➤জন্ম ও বংশ পরিচয়:
এই পুণ্যলোক মহাপুরুষ ১২৬৫ বঙ্গাব্দের ১৭ অগ্রহায়ণ(জন্ম ১৮৫৮ – মৃত্যু ১০ ফেব্রুয়ারী ১৯৪৪) তদানীন্তন ত্রিপুরা (কুমিল্লা)জিলার ব্রাহ্মণবাড়ীয়া মহকুমার (অধুনা ব্রাহ্মণবাড়িয়া জেলার) নূরনগর পরগনার নবীনগর থানাধীন বিটঘর গ্রামে জন্মগ্রহন করেন। তার পিতা ঈশ্বরদাস তর্কসিদ্ধান্ত সুপণ্ডিত ছিলেন এবং মাতা রামমালা দেবী দেব দ্বিজে ভক্তিপরায়ণ সাধ্বী নারী ছিলেন।
দানবীর মহেশ চন্দ্র ভট্টাচার্যের পিতৃদেব ঈশ্বর দাস তর্কসিদ্ধান্ত শৈশবাস্থায় পিতৃহীন হলে বাল্যকালে তার পিতার মামারবাড়ি হাবলা উচ্চ গ্রামে গিয়ে বাস করেন। তারপর তিনি তদানীন্তন ত্রিপুরা জেলার অন্তর্গত বিটঘর নিবাসী পাপড়াশী বংশীয় প্রাণকৃষ্ণ শিরোমনির একমাত্র
কন্যা রামমালা দেবীকে(মহেশচন্দ্রের মা) বিয়ে করেন। মহেশচন্দ্রের মাতৃদেবী রামমালা দেবী ও পিতা ঈশ্বরদাস তর্কসিদ্ধান্ত মহাশয় প্রতিভাশালী পন্ডিত ছিলেন। তিনি বিটঘর গ্রামস্থ নিজ বাড়ীতে টোল খোলেন। টোলে আন্দাজ ৪৫ জন শিক্ষার্থী ছিলেন।তন্মধ্যে আনুমানিক ১৫ জনকে নিজ গৃহে রাখতেন। তাঁর আর্থিক অবস্থা মোটেই সচ্ছল ছিলনা,তথাপি তিনি বিদ্যার্থীকে অন্ন ও বিদ্যাদানের ব্রত হতে কখনও বিরত হননি। তিনি সৎ ও কড়ালোক ছিলেন। তাঁর আন্তরিক আকাঙ্খা ছিল তিনি যেন অধ্যাপনায় সতত নিমগ্ন থাকেন। বাস্তবিকই তিনদিনের জ্বরে সকল পড়ুয়া বাড়ীতে রেখে তিনি ৪২ বৎসর বয়সে পরলোক গমন করেন। তখন মহেশচন্দ্রের বয়স মাত্র ৬ বৎসর। এ অকাল মৃত্যু মহেশচন্দ্রের পরিবারকে অথৈ দুঃখ
কষ্টে ফেলে দেয়। মাতা রামমালা দেবী লিখতে বা পড়তে জানতেন না, কিন্তু বহু সংস্কৃত শ্লোক ও বচন তাঁর
কণ্ঠস্থ ছিল।রামমালা দেবী অত্যন্ত কড়া প্রকৃতির ছিলেন।মহেশচন্দ্রের ৩৫ বছর বয়সে তাঁর মাতা রামমালা দেবীও দেহত্যাগ করেন । পিতা-মাতার সত্য ও ন্যায়ের আদর্শ তাঁর জীবনে প্রভাব বিস্তার করেছে সবচেয়ে বেশী।চলমান…….
@➤তথ্য ঋণ:
➤ইন্দু কুমার সিংহের কর্মযোগী মহেশ চন্দ্র ও কুমিল্লা মহেশাঙ্গন গ্রন্থ
➤শান্ত নূরুননবীর মহেশাঙ্গন ও রামমালা পাঠাগার নিবন্ধ।
দৈনিক প্রথম আলো
প্রকাশ ১৭ মার্চ ২০১৪ ইং
➤’ইমরান মাহফুজের ‘অজানা ইতিহাস নিয়ে দাঁড়িয়ে আছে ‘রামমালা গ্রন্থাগার’ নিবন্ধ।
The Daily Star Bangla
অক্টোবর ১৮, ২০২০
💻লেখক: এস এম শাহনূর
কবি ও আঞ্চলিক ইতিহাস গবেষক
Leave a Reply