শনিবার, ২৭ Jul ২০২৪, ১০:৫৬ পূর্বাহ্ন

শিরোনাম :
ব্রাহ্মণবাড়িয়া-৪ (কসবা-আখাউড়া) আসনে আইন মন্ত্রী আনিসুল হক বে-সরকারি ভাবে নির্বাচিত কসবায় ভোট দিয়ে বাড়ি ফেরার পথে সড়ক দুর্ঘটনায় নিহত ১ আহত-৪ কসবায় এলজিইডি’র শ্রেষ্ঠ কর্মকর্তা-কর্মচারীদের মাঝে পুরস্কার বিতরণ অনুষ্ঠান আগরতলায় স্রোত আয়োজিত লোকসংস্কৃতি উৎসব কসবা প্রেসক্লাব সভাপতি’র উপর হামলার প্রতিবাদে মানবন্ধন ও প্রতিবাদ সভা কসবায় চকচন্দ্রপুর হাফেজিয়া মাদ্রাসার বার্ষিক ফলাফল ঘোষণা, পুরস্কার বিতরণ ও ছবক প্রদান শ্রী অরবিন্দ কলেজের প্রথম নবীনবরণ অনুষ্ঠান আজ বছরের দীর্ঘতম রাত, আকাশে থাকবে চাঁদ বিএনপি-জামাত বিদেশীদের সাথে আঁতাত করেছে-কসবায় আইনমন্ত্রী আনিসুল হক ১৩ দিনের জন্য ভোটের মাঠে নামছে সশস্ত্র বাহিনী
দুবলহাটি রাজবাড়ি, নওগাঁ সদর, নওগাঁ

দুবলহাটি রাজবাড়ি, নওগাঁ সদর, নওগাঁ

ড. মোহাম্মদ শামসুল আলম
জেলা শহর থেকে দক্ষিণ-পশ্চিম দিকে যুবলি-দিঘলি বিলের মধ্য দিয়ে তালতলি হয়ে যে রাস্তাটি এগিয়েছে সে রাস্তা দিয়ে অগ্রসর হলে ৭ কি. মি. দূরত্বে রাজবাড়ির অবস্থান। নওগাঁ -নওহাটা মহাসড়কের হাপানিয়া বাজার থেকে আট কিঃ দক্ষিণপূর্ব দিকে এটি অবস্থিত। হাপানিয়া বাজার থেকে পাকা সড়ক যোগে যে কোনো যানবাহনে নিয়ে সহজেই এই রাজবাড়িতে পৌঁছা যায়। আবার রাজশাহী-নওগাঁ মহাসড়কের জলছত্র মোড় থেকে পাকা রাস্তা দিয়ে হাসাইগাড়ি হয়েও আসা যায়। প্রাচীন এই রাজবাড়িকে কেন্দ্র করে স্থানটিতে গড়ে উঠেছে একটি বাজার। ইন্দো-ইউরোপীয় রীতিতে নির্মিত রাজবাড়ির গঠনশৈলীতে ক্লাসিক্যাল নির্মাণরীতির নান্দনিক বৈশিষ্ট্য লক্ষণীয়। জেলার অপরাপর রাজবাড়িগুলোর মধ্যে দুবলহাটি প্রাচীন। ঐতিহাসিক সূত্রে জানা যায় পাল শাসনামলে (৭৫০-১১৫০) এর উদ্ভব ঘটেছে। জগৎরাম রায় নামক জনৈক ব্যক্তি ছিলেন জমিদারির প্রতিষ্ঠাতা। তিনি ছিলেন লবণ ব্যবসায়ী। ব্যবসা-বাণিজ্য উপলক্ষে ভারতের মুর্শিদাবাদ জেলার অন্তর্গত যজ্ঞেশ্বরপুর গ্রাম থেকে এখানে আসেন। এরপর দুবলহাটি বাজার থেকে আনুমানিক ৩.৫ কি. উত্তরে কশবা গ্রামে বসতবাড়ি স্থাপন করেন। পরবর্তীতে মোগল শাসনামলে বাদশাহী সনদমূলে এই জমিদারির প্রতিষ্ঠা ঘটে।

দুবলহাটি জমিদারি বার্বাকপুর পরগনা নিয়ে গড়ে উঠে। রাজবংশের আদি পুরুষ জগৎরাম যখন এখানে আসেন তখন এই অঞ্চলটি ছিল নিম্নাঞ্চল, পতিত ও জঙ্গলাকীর্ণ। এখানে এসে তিনি প্রচুর ধনসম্পত্তির মালিক হন। জমিদারিতে ৫৪ জন উত্তরসূরি রাজ্য পরিচালনা করেন। জানা যায় মুক্তারাম রায় চৌধুরীর মৃত্যুর পর তাঁর পুত্রদ্বয় কৃষ্ণরাম রায়চৌধুরী ও রঘুরাম রায়চৌধুরীর মধ্যে জমিদারি দুটি অংশে ভাগ হয়। কৃষ্ণরাম পায় জমিদারির নয় আনা অংশ এবং রঘুরাম পায় সাত আনার অংশ। উত্তরাধিকার বন্টনের পর কৃষ্ণরাম কশবা গ্রাম চলে আসেন নিকটবর্তী মৈনম গ্রামে। আর রঘুরাম বসবাস করেন দুবলহাটিতে। জমিদার কৃষ্ণরাম ছিলেন নিঃসন্তান। তাঁর মৃত্যুর পর বিধবা স্ত্রী এই জমিদারির সম্পূর্ণ অংশ বলিহার ও দামনাশের জমিদারের নিকট বিক্রয় করেন। ফলে জমিদারির নয় আনা অংশীদারিত্বের বিলুপ্তি ঘটে। অপর ৭ আনা জমিদারির উত্তরাধিকার রঘুরামের বংশধরগণ দুবলহাটিতে তাঁদের জমিদারিকে টিকে রাখেন। মূলত সাত আনার বংশধরগণই দুবলহাটির প্রকৃত জমিদার।

ইস্টইন্ডিয়া কোম্পানির শাসনামলে ১৭৯৩ খ্রিষ্টাব্দে চিরস্থায়ী বন্দোবস্তের সময়ে দুবলহাটির জমিদার ছিলেন শিবনাথের পুত্র কৃষ্ণনাথ। তিনি ছিলেন রাজা হরনাথের পিতামহ। কৃষ্ণনাথের পুত্রের নাম আনন্দ নাথ। তাঁর কোনো পুত্র সন্তান ছিল না। আনন্দ নাথের মৃত্যুর পর তাঁর পত্নী রূপমঞ্জরী দুবলহাটি জমিদারির দায়িত্ব গ্রহণ করে হরনাথকে দত্তকপুত্র হিসেবে গ্রহণ করেন। পরবর্তীতে। জমিদারি দায়িত্ব পালন সংক্রান্ত বিষয় নিয়ে রূপমঞ্জরী ও হরনাথের মধ্যে রাজশাহী জজ আদালত ও কলকাতা হাইকোর্টে মামলা হয়। মামলা মোকদ্দমার পর একপর্যায়ে আপোষ-মীমাংসা হয়। আপোষ-মীমাংসার মাধ্যমে হরনাথ রায় মাতার কাছ থেকে ১৮৫৩ খ্রিষ্টাব্দে রাজ্যভার গ্রহণ করেন। জমিদারির দায়িত্বভার গ্রহণের অল্পদিন পরেই তাঁর মাতা রূপমঞ্জরী পরলোক গমন করেন। এই বংশের জমিদারদের মধ্যে কর্মকাণ্ডের জন্য খ্যাতি লাভ করেন রাজা হরনাথ রায়চৌধুরী। তিনি তাঁর জমিদারিকে ৫টি জেলায় সম্প্রসারিত করেন।

জমিদার হরনাথ প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষায় শিক্ষিত ছিলেন না। এর পরেও ছিলেন একজন শিক্ষানুরাগী মানুষ। শিক্ষার উন্নয়ন ও বিস্তার ঘটানোর জন্য প্রচুর অর্থ ব্যয় করতেন। ১৮৬৪ খ্রিষ্টাব্দে দুবলহাটিতে তিনি অবৈতনিক স্কুল প্রতিষ্ঠা করেন। এর পর ১৮৭৩ খ্রিষ্টাব্দে ‘রাজশাহী কলেজ’ প্রতিষ্ঠার জন্য অর্থ দান করেন। একজন অতিথি পরায়ণ মানুষ হিসেবেও তাঁর খ্যাতি ছিল। তারই ফল স্বরূপ দুবলহাটিতে তিনি একটি অতিথিশালা স্থাপন করেছিলেন। ১৮৭৪ খ্রিষ্টাব্দে দেশব্যাপী দুর্ভিক্ষ চলাকালে দুর্ভিক্ষ লাঘবের জন্য কল্যাণকর কাজও করে ক্ষুধার্ত ও তৃষ্ণার্তদের প্রাণে বাঁচিয়েছেন। এমন কাজের স্বীকৃতি স্বরূপ ১৮৭৫ খ্রিষ্টাব্দে ব্রিটিশ সরকার তাঁকে রাজা এবং ১৮৭৭ খ্রিষ্টাব্দে রাজাবাহাদুর উপাধিতে ভূষিত করেন। সে কারণে এই জমিদারবংশ রাজবংশ হিসেবে পরিচিতি লাভ করে। হরনাথের সময়কাল থেকেই এই রাজবংশের গৌরব বৃদ্ধি পায়। তাই তাঁকে একজন উন্নয়নকর্মী জমিদার হিসেবেও পাওয়া যায়। রাজ্যভার গ্রহণ করার পর রাজা হরনাথ সৎকর্মের জন্য নিয়মিত অর্থ দান করতেন। সে সময় তাঁর তুলনীয় দানবীর ব্যক্তি তখনকার দিনে এ অঞ্চলে আর কেউ ছিলেন না।

এতকিছুর পরেও এই জমিদারিতে ১৮৮৩ খ্রিষ্টাব্দে হাসাইগাড়ি আস্তান মোল্লা মৌলবীর নেতৃত্বে বাংলা ১২৯১ বঙ্গাব্দে প্রায় ৫০ হাজার প্রজা বিদ্রোহী হয়ে উঠেন। প্রজারা ৭ বছর যাবৎ খাজনা দেয়া বন্ধ করে দেন। প্রজা বিদ্রোহের কারণ হিসেবে পাওয়া যায় স্বেচ্ছাচারিতা, জুলম-নির্যাতন এবং মুসলিম বিদ্বেষ। এই নিয়ে প্রায় সাতবছর চলে নানা ধরনের মামলা-মোকদ্দমা। পরিস্থিতির সমাধান কল্পে তাঁর পত্নীদ্বয় রানী শ্যামাসুন্দরী ও উমাসুন্দরী বিদ্রোহী প্রজাদের নিকট আকুল আবেদনের মাধ্যমে ক্ষমা প্রার্থনা করেন। এই বিদ্রোহকালীন সময়ে প্রজাদের সাথে মধ্যস্থতা করার দায়িত্ব পালন করেন রাজার সেটেলমেন্ট অফিসার শশীভূষণ রায়। অপর দিকে আস্তান মোল্লার প্রধান সহকারী নারু মোল্লার সহায়তায় বিষয়টির নিষ্পত্তি হয়। সমাধান হিসেবে খাজনা বৃদ্ধির সিদ্ধান্ত পরিত্যাগ করা হয়। আলোচনার মাধ্যমে মীমাংসায় উপনীত হবার ফলে বিদ্রোহের অবসান ঘটে। এমন প্রজাবিদ্রোহ কেবল দুবলহাটিতেই নয়, রবং সমগ্র বাংলায় আলোড়ন সৃষ্টি করেছিল। তিনি ১৮৫৩ হতে ১৮৯১ পর্যন্ত রাজত্ব করে ১৮৯১ খ্রিষ্টাব্দে মৃত্যুবরণ করেন। মারা যাবার অব্যবহিত পূর্বে একটি উইল করেছিলেন। উইল রেজিস্ট্রেশন হবার পর দুজন পুত্র ও দুজন কন্যা রেখে পরলোকে গমন করেন। উইল অনুসারে জ্যেষ্ঠ পুত্র কুমার ঘনদানাথ রায়চৌধুরী দুবলহাটি রাজ্যের ।/০ এবং কনিষ্ঠ পুত্র কুমার ক্রীস্কারীনাথ রায়চৌধুরী ।৯০ আনা অংশ পান। পুত্রদ্বয় প্রাপ্ত বয়স্ক না হওয়া পর্যন্ত তাদের মাতা দুবলহাটির রাষ্ট্রীয় কাজ পরিচালনা করতেন। ১৯৫০ খ্রিষ্টাব্দে জমিদারি প্রথা বিলুপ্তির সময়কালে অমরেন্দ্রনাথ রায় চৌধুরী ছিলেন এখানকার শেষ জমিদার।
ড. মোহাম্মদ শামসুল আলম
গবেষক, প্রাবন্ধিক, ইতিহাসজ্ঞ
সহযোগী অধ্যাপক ও বিভাগীয় প্রধান বাংলা বিভাগ, নওগাঁ সরকারি কলেজ, নওগাঁ

এই সংবাদটি শেয়ার করুনঃ

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *




raytahost-demo
© All rights reserved © 2019
ডিজাইন ও কারিগরি সহযোগিতায়: Jp Host BD