দীপক সাহা
এক সময় দেবতাদের স্বর্গলোক থেকে বিতাড়িত করলেন মহিষাসুর। লাভ করলেন স্বর্গরাজ্য। বিপন্ন অনন্যোপায় দেবতারা শরণাপন্ন হলেন ব্রহ্মার। ব্রহ্মা দেখলেন তাঁর কিছু করার নেই। কারণ, মহিষাসুর পুরুষের অবধ্য হয়েছেন ব্রহ্মারই বরে। ব্রহ্মা তখন শিব ও দেবতাদের সঙ্গে নিয়ে গেলেন ভগবান বিষ্ণুর কাছে। আনুপূর্বিক সমস্ত দুর্দশার কথা জানালেন। বিগলিত হৃদয়ে বিষ্ণুকে অনুরোধ করলেন তাঁদের রক্ষা করতে।
সমস্ত কথা শুনে বিষ্ণু বললেন, পুরুষের অবধ্য এই অসুরকে বধ করতে হলে স্ব স্ব তেজের কাছে প্রার্থনা করতে হবে যে, এই সমবেত তেজ থেকে যেন কোনও নারীমূর্তি আবির্ভূতা হন। সেই নারীই পারবেন মহিষাসুরকে বিনাশ করতে।
এ কথা শুনে ব্রহ্মা, বিষ্ণু, শিব, ইন্দ্র এবং অন্যান্য দেবতাদের দেহ থেকে নির্গত হল তেজ। সেই সমবেত তেজোরাশি থেকে আবির্ভূতা হলেন এক পরমা সুন্দরী নারী। মহাদেবের তেজ থেকে মুখমণ্ডল, বিষ্ণুর তেজ থেকে শরীর, আর ব্রহ্মার তেজ থেকে পদযুগল। উপস্থিত দেবতাদের সমবেত তেজও এই দেবীশরীরে যুক্ত হল – ইনিই দশভুজা দেবী দুর্গা, মহশক্তির প্রতীক, ইনি অজেয় ।
এদিকে নারীরূপী দেবীর রূপে আকর্ষিত হলেন মহিষাসুর। বিবাহের প্রস্তাব প্রত্যাখ্যাত হল। এবার ক্রুদ্ধ অসুরের সঙ্গে ঘোরতর যুদ্ধ হল দেবীর। নিহত হলেন মহিষাসুর। দেবতারা স্বর্গরাজ্য ফিরে পেলেন।
পুরাকালে রাজা সুরথ তাঁর হৃত রাজ্য পুনরুদ্ধারের জন্য বসন্তকালে দেবী দুর্গার আরাধনা শুরু করেন। কিন্তু রামচন্দ্র রাবণকে বধ করে সীতা উদ্ধারের জন্য যুদ্ধযাত্রার আগে শরৎকালে দেবীর অর্চনা শুরু করেন। এইজন্য শরৎকালের পূজাকে অকালবোধন বলা হয়। বাংলায় এই শরৎকালের অকালবোধন পূজাই অনুষ্ঠিত হয় ।
বাঙালির সবথেকে বড় এবং জনপ্রিয় উৎসব দুর্গোৎসব হাজির। করোনার অতিমারির প্রকোপে অভাব-অভিযোগ সত্ত্বেও পাহাড় থেকে সমুদ্র, মানুষ উৎসবে মেতে আছেন। কিন্তু এই উৎসবের আলোতেও অন্ধকারে থাকবে বাংলার কয়েকটি অঞ্চল। একপ্রকার দুর্গা ঠাকুরের ওপর রাগ করেই নিজেদের এই উৎসব থেকে সরিয়ে রাখেন এই অঞ্চলের লোকেরা। যাঁরা বিশ্বাস করেন, ছলনার সাহায্যে দুর্গা অন্যায়ভাবে হত্যা করেছিলেন তাঁদেরই পূর্বপুরুষ মহিষাসুরকে। তাই, সেই অন্যায়ের প্রতিবাদেই দুর্গোৎসব থেকে নিজেদেরকে সরিয়ে রাখেন তাঁরা।
প্রচলিত খলনায়কই নায়ক। বিনাশের বদলে তিনিই পূজা পান। প্রথা ভেঙে বাংলা তথা ভারতের কিছু কিছু জায়গায় আজও পূজিত হন ‘রাক্ষস’ মহিষাসুর। এসব শুনলে চমকে উঠবেন অনেক মানুষই। কিন্তু এ ধরনেরই ব্যতিক্রমী পূজা দেখা যায় পশ্চিমবঙ্গ ছাড়াও ভারতের উড়িষ্যা, আসাম এবং ছত্তিশগড়সহ আরও কয়েকটি জায়গায়। এই সব অঞ্চলের জনগোষ্ঠীরা দুর্গাপূজার সময় দুর্গার পরিবর্তে মহিষাসুরকে পূজা করেন।
এই জনগোষ্ঠীরা মনে করেন, দেবী দুর্গার হাতে মহিষাসুর বধ আসলে ষড়যন্ত্র। বহিরাগত আর্যরা তাঁদের ভূমি দখল করতে এসে পূর্বপুরুষ মহিষাসুরের হাতে বারবার পরাস্ত হয়ে শেষকালে এক মহিলাকে পাঠায় মহিষাসুরকে হত্যা করতে কারণ তারা জানত মহিষাসুর মহিলাদের সঙ্গে যুদ্ধ করতেন না। তাই মহিষাসুর একরকম বিনাযুদ্ধেই দুর্গার হাতে নিহত হলেন।
লোকমুখে প্রচলিত অসুর জাতির রাজা হুদুড়দুর্গা, আদিবাসী অনার্য রাজা, সেই রাজাকে অন্যায়ভাবে হত্যা করেই আর্যরা নারী দুর্গার মাহাত্ম্য প্রচার করে। আসলে মহিষাসুর বধ হচ্ছে আদিবাসীদের প্রিয় রাজা হুদুড় দুর্গার হত্যা। আর্যদের দ্বারা সহজ সরল অনার্যদের পরাজয়ের ও আদিবাসী রাজা হুদুড় দুর্গার হত্যালীলার কাহিনি এক প্রজন্ম থেকে পরের প্রজন্মে চলে আসছে।
আদিবাসী খেড়ওয়াল জনজাতির প্রধানত অসুর, সাঁওতাল, মাহালী, মুন্ডা,কোল,কুর্মি আদিবাসীরা বাংলার বহু স্থানে অসুর পূজা করে থাকেন। তারমধ্যে দুই দিনাজপুর, জলপাইগুড়ি,কোচবিহার, পুরুলিয়া, বাঁকুড়া, ঝাড়গ্রাম উল্লেখ্য। প্রচলিত বিশ্বাস, হুদুড় দুর্গা তথা মহিষাসুরকে কোনও প্রকৃত যুদ্ধের মাধ্যমে পরাস্ত করা হয়নি। নীতিহীন যুদ্ধে পরাস্ত করে তাঁর প্রতি বিশ্বাসঘাতকতা করা হয়েছিল। তাই তাঁরা আজও মহিষাসুরকেই দেবতা বলে মানেন। যাঁর হাতে মহিষাসুর বধ হয়েছিলেন, সেই দুর্গাকে তাঁরা আজও ‘বিদেশি’ বলেই মানেন। প্রসঙ্গত উল্লেখ্য ভারতে খেড়ওয়াল জাতির মধ্যে এখানো অসুর পদবী দেখা যায়।
পূজা ও স্মরণসভা উপলক্ষে মহিষাসুরের মূর্তি বানানো হয়। ওই মূর্তির সামনেই ইতিহাস তুলে ধরেন আদিবাসী সমাজের কর্তাব্যক্তিরা। তাঁরা আজও মনে করেন, আদিবাসীদের আদি পুরুষ অনার্য সম্প্রদায়ের হুদুড় দুর্গা তথা মহিষাসুর এক বিদেশি আর্য রমণীর দ্বারা অন্যায়ভাবে নিধনের ফলে ভারতের ভূমিপুত্র আদিবাসী খেরওয়ালরা দেশের রাষ্ট্রীয় ক্ষমতা হারিয়েছিল।
অনেকের মতে মহিষাসুরকে নীতিহীন যুদ্ধে পরাস্ত করে আর্যাবর্ত নামে আর্য সাম্রাজ্য প্রতিষ্ঠার মাধ্যমে আর্যপক্ষ যখন বিজয় উৎসবে মেতে উঠেছিল, সেই সময় সাঁওতাল, মুণ্ডা, কোল, কুর্মি, মাহালি, কোড়াসহ খেরওয়াল গোষ্ঠীর আদিবাসীরা তাদের বশ্যতা স্বীকার করেনি। নিজেদের মান বাঁচানোর উদ্দেশ্যে নারীর ছদ্মবেশে দাঁশাই নাচ ও কাঠিনাচের মাধ্যমে অন্তরের দুঃখ নিয়ে তাঁরা আনন্দের অভিনয় করতে করতে সিন্ধুপাড় ছেড়ে আসাম, ঝাড়খণ্ড, উড়িষ্যা ও দক্ষিণ ভারতের বনে-জঙ্গলে আশ্রয় নেন। সেই মহান রাজার নিধন ও দেশ হারার বেদনা বুকে নিয়ে সেই থেকেই আদিবাসীরা তাঁদের পিতৃপুরুষ মহিষাসুরের স্মরণে ‘হায় রে হায় রে’ শব্দযোগে আজও দাঁশাই নাচ ও কাঠিনাচ করে চলেছেন।
তাঁদের কাছে দুর্গা অশুভ প্রতীক। তাই তাঁরা দুর্গার বদলে মহিষাসুরকেই আসল দেবতা মনে করে সপ্তমীর দিন তাঁকে স্মরণ করে ‘শহিদ দিবস’ পালন করে থাকেন। সাঁওতালি দাঁশাইয়ের বিধি অনুযায়ী, ওইসময় চারদিন দেবী দুর্গার মুখ দর্শন বন্ধ ছিল। এখনও অনেক আদিবাসী জনগোষ্ঠী শোকপালন করতে গিয়ে ওই দিনগুলিতে বাড়ি থেকে বের হন না। তাঁরা মনে করেন, দুর্গোৎসবের প্রকৃত ইতিহাস চাপা দেওয়ার চেষ্টায় উচ্চবর্ণীয় পণ্ডিতরা ধর্মের রং মিশিয়ে মহিষাসুরকে অশুভ শক্তি হিসাবে মিথ্যা প্রচার করেন।
শরতের এই সময় যখন সমস্ত জায়গা আলোয় ভরে ওঠে, তখন এই আদিবাসী সম্প্রদায়ের ঘরে ঘিরে থাকে অন্ধকার। তাঁদের বক্তব্য, শুধুমাত্র অধিকার কায়েম করার জন্যই তাঁদের ‘পূর্বপুরুষ’ মহিষাসুরকে অন্যায়ভাবে মারা হয়। কিন্তু তাঁরাই তো এখানকার প্রকৃত ভূমিপুত্র ছিলেন।সেখানে অন্যায্যভাবে সেই অধিকার থেকে বঞ্চিত করা হয়। তাই তাঁদের কাছে দুর্গা কোনও ভগবান নয়, বরং রাগের কারণ, অপমানের কারণ। অন্যান্য সমস্ত পূজায় অংশ নিলেও, এই পূজা অনুষ্ঠানে তাঁরা আসেন না। অর্থাৎ, এই পূজায় যখন আনন্দে মেতে ওঠে সারা বাংলা, সেখানেই নিজেদের দূরে সরিয়ে রাখেন কিছু পরিবার,তাঁদের বক্তব্য আলাদা, তাঁদের পরিচয়ে বাঁচতে, তাঁদের পরিচয়কে সম্মান করতে দৃঢ় তাঁরা। তাঁদের মতে দুর্গাপূজা ব্রাহ্মণ্যবাদের তৈরি স্বকীয় অনুষ্ঠান, যার আড়ালে রয়েছে অনার্যদের পরাজয়ের করুণ কাহিনি ও ব্রাহ্মণ্যবাদ প্রচারের কার্যকলাপ এবং আর্য ও অনার্য সংঘাতের স্মৃতি।
ঋণী স্বীকার – সুমন্ত মাহালী হেমব্রম
ছবি – আন্তর্জাল
প্রেরক – দীপক সাহা (প্রাবন্ধিক ও গল্পকার) নদিয়া, পশ্চিমবঙ্গ
Leave a Reply