ড. মোহাম্মদ শামসুল আলম
নওগাঁর প্রাচীন এক সমবায় সমিতির নাম ‘গাঁজা সোসাইটি’। এই সোসাইটির প্রকৃত নাম ‘নওগাঁ গাঁজা উৎপাদনকারী সমবায় সমিতি লিমিটেড’। নওগাঁ জেলায় কোন সময় থেকে প্রথম গাঁজা চাষের সূত্রপাত ঘটেছিল তার উত্তরে পাওয়া যায় যে, ১৮৭৭ খ্রিষ্টাব্দে নওগাঁ মহকুমার সৃষ্টি হয়। মহকুমা সৃষ্টি হওয়ার পূর্বে ১৭২২ খ্রিষ্টাব্দে নওগাঁর উত্তরে মুরাদপুর ও বালুভরা নামক স্থানে প্রথম গাঁজার উৎপাদন শুরু করা হয়। কৃষি ও কৃষিজাত উৎপাদিত ফসলের তুলনায় গাঁজার চাষ লাভজনক হওয়ায় ক্রমান্বয়ে এই চাষ নওগাঁ সদর উপজেলাসহ মহাদেবপুর, বদলগাছী এবং নিকটস্থ বগুড়া জেলার আদমদীঘি উপজেলায় বিস্তার লাভ করে। নওগাঁ সদর উপজেলার তিলকপুর, বোয়ালিয়া, বক্তারপুর, কীর্ত্তিপুর, নওগাঁ, হাপানিয়া, বর্ষাইল, দুবলহাটি, বদলগাছী উপজেলার বালুভরা এবং মহাদেবপুর উপজেলার ধনজইল ও ভীমপুর এলাকায় এর চাষ হতো। গাঁজা চাষ সম্বলিত এই স্থানগুলোকে তখন বলা হতো ‘গাঁজামহল’। এই চাষকে সমৃদ্ধ করার জন্য ১৮৭৬ খ্রিষ্টাব্দে প্রথম গাঁজা উৎপাদনের লক্ষ্যে লাইসেন্স প্রথার প্রবর্তন করা হয়। কারণ তখন গাঁজা চাষিরা ইচ্ছামত গাঁজা চাষ আরম্ভ করেছিলেন। কত হেক্টর জমিতে গাঁজার চাষ করা হতো তারও কোন সঠিক পরিসংখ্যান তখন ছিল না। সে কারণেই এই লাইসেন্স প্রথা চালু করা হয়। এই নিয়ম প্রবর্তিত হওয়ার ফলে কোন কৃষক তার ইচ্ছেমত কোনো গাঁজার উৎপাদন করতে পারতেন না। শেষ পর্যন্ত এই বিধান প্রবর্তিত ছিল ১৯৮৭ খ্রি. পর্যন্ত। ১৯১৭ খ্রিষ্টাব্দে গাঁজা কাল্টিভেটর কো-অপারেটিভ সোসাইটি লিমিটেড নামে তা নিবন্ধিত হয়। নিবন্ধিত হওয়ার পর প্রকৃত স্থান হিসেবে গাঁজা চাষের জন্য কীর্ত্তিপুর, মুরাদপুর ও গোবিন্দপুর নামক তিনটি স্থান নির্ধারিত হয়। প্রতি বছর এ তিনটি স্থানের বিভিন্ন ভূখণ্ডে এর চাষ করা হতো। এই তিনটি এলাকার উৎপাদিত গাঁজা সংরক্ষণের জন্য তিনটি গোডাউন নির্মাণ করা হয়। ১৯৪৭ সালের দেশ বিভক্তির পরও এই স্থান তিনটিতে এই চাষের ধারা অব্যাহত ছিল। গাঁজার চাষ অন্যান্য কৃষি দ্রব্যের ব্যয়ভারের চেয়ে অধিক ব্যয়বহুল ছিল। এটি চাষের জন্য অপেক্ষাকৃত উঁচু ভূমির প্রয়োজন হয়। বছরের সবসময় এর চাষ হয় না। মূলত শীতকালে এর চাষ হতো। তাই এর চাষের প্রকৃত সময়হলো শীতকাল। এটি বপনের জন্য সাধারণত জুন-জুলাই মাসে জমিতে লাঙ্গল চাষ করা হয়। চাষের জন্য প্রস্তুতকৃত জমিতে অধিক হারে সার ও পানি ব্যবহার করতে হতো। জমিকে চাষের উপযুক্ত করার পর সেপ্টেম্বর মাসের দিকে এর চারা তুলে ৯/১০ ইঞ্চি দূরত্বে সারিবদ্ধভাবে তা রোপন করতে হয়। গাছ লাগানোর জন্য প্রায় ১ ফুট উঁচু করে আইল তৈরি করে সেখানে চারাগুলো রোপন করা হয়। যেন সেখানে বৃষ্টির পানি জমতে না পারে। গাছের গোড়ায় যেন পানি জমতে না পারে সে জন্য এমন প্রস্তুতি নিতে হয়। গাছগুলো বড় হলে গাছের নিচের অংশের পাতা ও ডালগুলো ঝুড়ে ফেলা হয়। স্ত্রী গাছগুলো গাঁজা চাষের অন্যতম অন্তরায়। তাই স্ত্রী গাছগুলোকে আগাছা ভেবে তুলে ফেলা হতো। তা-না হলে স্ত্রী গাছগুলো দিয়ে গাঁজা তৈরির পরিবর্তে শুধু মাত্র বীজ তৈরি হবে। তবে কোনটি স্ত্রী বা পুরুষ জাতীয় গাছ তা নির্ধারণের জন্য নির্ধারণকারী ব্যক্তিদেরকে ‘পোদ্দার’ বা ‘পরখদার’ বলা হতো। সাধারণ চাষিরা সহজে বুঝতে পারতেন না কোনটি পুরুষ বা কোনটি স্ত্রী গাছ। কেবল খেতাবপ্রাপ্ত ব্যক্তিগণই তা অভিজ্ঞতার আলোকে বোঝতে পারতেন কোনটি স্ত্রী বা পুরুষ গাছ। গাঁজা ফসল ওঠার পর এর প্রণয়ন ও প্রক্রিয়াকরণ পদ্ধতি সম্পর্কে যা জানা যায় তা এমন, নওগাঁ গাঁজাগোলা সংলগ্ন নদীর ধারে একটি চুল্লি আছে যা প্রায় ২৫ ফুট উঁচু। পূর্বে উদ্বৃত্ত গাঁজা এ চুল্লিতে নিয়ে এসে পোড়ানো হতো। পোড়ানোর কাজ চলতো সপ্তাহ ধরে। তখন পোড়ানো গাঁজার গন্ধ বাতাসে ভর করে ছড়িয়ে পড়তো শহরময়। গাঁজা সেবনকারীরা যে কলকি ব্যবহার করে সেই কলকি এ চুল্লির অনুকরণে তৈরি। পার্থক্য শুধু গাঁজাগোলার চুল্লিতে গাঁজা নিচে রেখে পোড়ানো হতো। আর ধুয়া যেত ওপর দিকে। সেবনকারীরা ছোটো কলকির ওপর গাঁজা রেখে আগুন ধরিয়ে একদমে টেনে নিয়ে সেই ধোঁয়া গলধঃকরণ করে।
একসময় গাঁজার চাষ ছিল এ জেলার অন্যতম অর্থকরী উৎপাদিত ফসল। জনশ্রুতি আছে যে, ইস্টইন্ডিয়া কোম্পানির সময়কালে যশোহর জেলা হতে সর্ব প্রথম গাঁজার বীজ এনে নওগাঁ ও পাঁচুপুর থানায় এর চাষ করা হতো। গাঁজার ল্যাটিন নাম ‘canabis Indica’। সংস্কৃত শাস্ত্রে গাঁজাকে ‘গঞ্জিকা’ বলা হয়। আবার এটিকে অনেকে ‘সিদ্ধি’ও বলে থাকেন। গাঁজার গাছ পরিপক্ক হলে ফেব্রুয়ারি মাসের দিকে তা কর্তন করা হতো। গাছগুলো কাটার পর নিজ নিজ তত্ত্বাবধানে একটি নির্দিষ্ট স্থানে আনা হতো। এরপর রোদ দ্বারা শুকিয়ে স্তুপ আকারে জমাটবদ্ধভাবে সাজিয়ে দুই/তিন দিন রাখার পর পুনরায় রোদ্র দ্বারা শুকানো হতো। রোদে শুকানোর পর পায়ের চাপ দিয়ে মাড়াই করে এর জটাগুলো পৃথক করা হতো। অর্থাৎ যে স্থানে গাঁজা প্রক্রিয়াজাত করানো হতো সে স্থানকে ক্যাম্প বলা হতো। পুলিশ পাহারায় তা বস্তাবন্দি করে শহরে অবস্থিত গাঁজা সোসাইটির গুদাম ঘরে এনে গুদামজাত করা হতো। গাঁজার গাছগুলোর বয়স যখন তিন থেকে সাড়ে তিন মাস হয়; তখন তা রক্ষণাবেক্ষণের জন্য সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তা, কর্মচারী, পুলিশ ও আনসারদের কড়া নজরদারির মাধ্যমে পাহারা দিতে হতো। তখন ক্ষেতের পরিমাণ ও মাত্রানুযায়ী পুলিশ ক্যাম্প স্থাপন করা হতো। প্রতিটি ক্যাম্পে একজন পুলিশ অফিসার ও দুজন সিপাহী দায়িত্ব পালন করতেন। এ ছাড়া দায়িত্ব পালন করতেন একজন তত্ত্বাবধায়ক, একজন সার্কেল অফিসার ও দুজন কর্মকর্তা। গাঁজা চাষের সময়কালে ক্যাম্পগুলোতে সবসময় লোকসজ্জা থাকতো। এরপরও সার্বিকভাবে সমস্ত কাজের দায়িত্ব নওগাঁ গাঁজা উৎপাদনকারী সমবায় সমিতিকে বহন করতে হতো। গাঁজা রোপনের সময় এর সাথে সংশ্লিষ্ট কৃষক ও জমির মালিকদের মধ্যে এক ধরনের আনন্দ-ফুর্তি দেখা যেত।
গাঁজা সোসাইটির সার্বিক তদারকির জন্য মহুকুমা প্রশাসক পালন করতেন প্রশাসনিক দায়িত্ব। পদাধিকার বলে তিনি গাঁজা মহলের ডেপুটি সুপারিনটেনডেন্ট-এর দায়িত্ব পালন করতেন। এ জন্য সোসাইটি তাঁর বেতনভাতা বহন করতেন। তাঁর অধীনে ছিল একজন ম্যানেজার, তিনিও ছিলেন বেতনভুক্ত। গাঁজা সোসাইটির প্রশাসনিক কাঠামো নিয়ন্ত্রণের জন্য ছিল একজন পরিদর্শক,
তিনজন উপ-পরিদর্শক এবং একজন সুপারভাইজার তত্ত্বাবধায়ক। পরবর্তীতে একজন শুল্ক ও আবগারী কর্মকর্তার পদ সৃষ্টি হলে সমস্ত কাজের দায়িত্ব আবগারি কর্মকর্তার উপর ন্যস্ত হয়। বলা সংগত যে রাজশাহীর ডেপুটি কমিশনার ছিলেন এই সোসাইটির চেয়ারম্যান।গাঁজা সোসাইটির আদ্যোপান্ত হিসেবে জানা যায় যে প্রথমদিকে গাঁজা চাষিরা উৎপাদিত গাঁজা দালালের মাধ্যমে বিক্রয় করতেন। সরাসরি গাজা বিক্রয়ের কোনো সুযোগ ছিল না। তাই প্রাপ্য মূল্য থেকে কৃষকরা বঞ্চিত হতেন। আর এর প্রকৃত মুনাফা ভোগ করতেন মধ্যস্বত্বভোগী দালালরা। কৃষকরা যেন তাদের উৎপাদিত পণ্যের প্রকৃত মূল্য পায় সেজন্য কতিপয় উদার ও সমাজ চিন্তার অধিকারী ব্যক্তিদের নিরলস প্রচেষ্টায় ১৯১৭ খ্রিষ্টাব্দে নওগাঁ গাঁজা কালটিভেটরস সমবায় সমিতি লিমিটেডের নামের এই প্রতিষ্ঠানটি গড়ে ওঠে।জানা যায় সমিতির সূচনালগ্নে সদস্য সংখ্যা ছিল ১৮জন। পরবর্তীতে সমিতির নতুন আইন প্রণয়ন করে এর কার্যকরী কমিটির সদস্য সংখ্যা ১২জন নির্ধারিত হয়। সেইসাথে সমিতির নাম সংশোধন করে ‘গাঁজা উৎপাদনকারী সমবায় সমিতি’ নামকরণ করা হয়।সমিতি রেজিস্ট্রি করার সময় এই সমিতিকে তিনটি সার্কেলে বিভক্ত করা হয়েছিল। সার্কেল তিনটি হলো কীর্তিপুর সার্কেল, গোবিন্দপুর সার্কেল এবং মুরাদপুর সার্কেল।
ড. মোহাম্মদ শামসুল আলম
গবেষক, প্রাবন্ধিক, ইতিহাসজ্ঞ
সহযোগী অধ্যাপক ও বিভাগীয় প্রধান
বাংলা বিভাগ, নওগাঁ সরকারি কলেজ, নওগাঁ
Leave a Reply