সংগৃহীত ছবি
২০২০ সাল নানা কারণেই আমাদের কাছে অবিস্মরণীয় হয়ে থাকবে। এক পঞ্জিকাবর্ষে এত ঘটন-অঘটন খুব কমই দেখেছে বিশ্ব। এ বছরই বৈশ্বিক মহামারী করোনাভাইরাস লণ্ডভণ্ড করে দিয়ে গেছে সব কিছু। পৃথিবী সৃষ্টির পর এমন ‘ধ্বংসযজ্ঞ’ সম্ভবত আর দেখা যায়নি। পৃথিবীর সব প্রান্তের মতো সর্বনাশা এই মহামারীর অভিশপ্ত ছোঁয়া বাংলাদেশেও এসে লেগেছে।
করোনায় আক্রান্ত হয়ে প্রাণ হারিয়েছেন লাখ লাখ লোক; যাদের মধ্যে রয়েছে পৃথিবীকে আলোর পথ দেখানো এবং মানবসভ্যতাকে এগিয়ে নেয়া অনেক মনীষীও। সারা পৃথিবীর মতোই এ বছর আমরাও হারিয়েছি আমাদের জাতির বেশ কয়েকজন সূর্যসন্তানকে। এ বছরই আমরা হারিয়েছে বেশ কয়েকজন আলোর ফেরিওয়ালাকে, যারা নিজ সৃজনশীলতা ও কর্ম দিয়ে জাতিকে সঠিক দিশা দিয়ে গেছে যুগের পর যুগ। এদের বেশিরভাগেরই মৃত্যু হয়েছে কোভিড ১৯-এ। কেউ কেউ বার্ধক্যজনিত কারণেও মৃত্যুবরণ করেছেন।
২০২০ সালে আমরা হারিয়েছি জাতীয় অধ্যাপক লেখক, কথাসাহিত্যিক ও বুদ্ধিজীবী ড. আনিসুজ্জামানকে। সাবেক মন্ত্রিপরিষদ সচিব ও বাংলাদেশ পাবলিক সার্ভিস কমিশনের চেয়ারম্যান ড. সা’দত হুসাইনের মতো দেশবরেণ্য ব্যক্তিত্ব আমাদের মাঝ থেকে বিদায় নিয়েছেন কিছু দিন আগে। করোনাভাইরাসে মৃত্যু হয়েছে ভাষাসংগ্রামী, মুক্তিযোদ্ধা, বরেণ্য সাংবাদিক ও সাংস্কৃতিক ব্যক্তিত্ব কামাল লোহানীর। দেশবরেণ্য শিক্ষাবিদ ও ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সাবেক উপাচার্য অধ্যাপক ড. এমাজউদ্দীন আহমদও এ বছরই আমাদের ছেড়ে চলে গেছেন। করোনা কেড়ে নিয়েছে বহু ভাষাবিদ ডক্টর মুহম্মদ শহীদুল্লাহর ছেলে চিত্রশিল্পী, লেখক ও গবেষক মুর্তাজা বশীর, বাংলা একাডেমির সাবেক মহাপরিচালক, কবি ও প্রাবন্ধিক মনজুরে মওলাকে। এরা একেকজন ছিলেন আমাদের জ্ঞান, সংস্কৃতি, শিক্ষা, বুদ্ধিবৃত্তিক চর্চার বাতিঘর। একবিংশ শতাব্দীর ২০ সালটিকে আমরা নক্ষত্র ঝরে পড়ার বছর হিসেবেই চিহ্নিত করতে পারি।
অধ্যাপক আনিসুজ্জামান
প্রথম পাতায় যার লেখা না হলে জাতীয় দৈনিকের বিশেষ সংখ্যা অপূর্ণ থেকে যেত তিনি অধ্যাপক আনিসুজ্জামান। ১৪ মে সবাইকে কাঁদিয়ে না ফেরার দেশে চলে গেছেন তিনি। তার বয়স হয়েছিল ৮৪ বছর।
তিনি হৃদরোগ, কিডনি ও ফুসফুসে জটিলতা, পারকিনসন্স ডিজিজ এবং প্রোস্টেটের সমস্যায় ভুগছিলেন। মৃত্যুর দিন নমুনা পরীক্ষায় তার শরীরে করোনা পজিটিভ পাওয়া যায়। তিনি স্ত্রী সিদ্দিকা জামান, দুই মেয়ে রুচিবা ও শুচিতা এবং ছেলে আনন্দ জামানসহ অসংখ্য গুণগ্রাহী রেখে গেছেন।
অধ্যাপক আনিসুজ্জামান সমাজহিতৈষী মনোভাব, গণতান্ত্রিক প্রগতিশীল চেতনা, সুশীল বুদ্ধিভিত্তিক চর্চা ও ব্যক্তিগত মনীষা দিয়ে নিজেকে পরিণত করেছিলেন দেশের অগ্রগণ্য পুরুষে। জাতির মনন গঠনে রেখেছেন অসামান্য ভূমিকা। শুধু তাই নয়, দেশের যে কোনো ক্রান্তিকালে দিয়েছেন সঠিক দিকনির্দেশনা। তার লেখায় উঠে এসেছে দেশ বিভাগ, ভাষা আন্দোলন ও মুক্তিযুদ্ধ।
অধ্যাপক আনিসুজ্জামান ১৯৩৭ সালের ১৮ ফেব্রুয়ারি পশ্চিমবঙ্গের চব্বিশ পরগনা জেলার বসিরহাট মহকুমার মোহাম্মদপুর গ্রামে তিনি জন্মগ্রহণ করেন। ১৯৫১ সালে নবাবপুর গভর্নমেন্ট হাইস্কুল থেকে প্রবেশিকা বা ম্যাট্রিক ও জগন্নাথ কলেজ থেকে ১৯৫৩ সালে আইএ পাস করে বাংলায় ভর্তি হন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে। ১৯৫৬ ও ১৯৫৭ সালে স্নাতক সম্মান এবং এমএতে প্রথম শ্রেণিতে প্রথম স্থান অধিকার করেন আনিসুজ্জামান। অনার্সে সর্বোচ্চ নম্বর পাওয়ার কৃতিত্বস্বরূপ ‘নীলকান্ত সরকার স্বর্ণপদক’ বৃত্তি লাভ করেন। পরে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে পিএইচডি করেন। ১৯৬৫ সালে শিকাগো বিশ্ববিদ্যালয় থেকে পোস্ট ডক্টরাল ডিগ্রি অর্জন করেন।
১৯৫৮ সালে বাংলা একাডেমি বৃত্তি পেয়েও তা ছেড়ে দিয়ে মাত্র ২২ বছর বয়সে আনিসুজ্জামান ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক হিসেবে এডহক ভিত্তিতে তিন মাসের জন্য যোগ দেন। ১৯৬৯ সালে তিনি চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ে যোগ দেন। যুদ্ধ শুরু হলে ভারতে গিয়ে শরণার্থী শিক্ষকদের সংগঠন ‘বাংলাদেশ শিক্ষক সমিতি’র সাধারণ সম্পাদকের দায়িত্ব পালন করেন।
এর পর বাংলাদেশ সরকারের পরিকল্পনা কমিশনের সদস্য হন। ১৯৭৪-৭৫ সালে কমনওয়েলথ একাডেমি স্টাফ ফেলো হিসেবে লন্ডন বিশ্ববিদ্যালয়ের স্কুল অব ওরিয়েন্টাল অ্যান্ড আফ্রিকান স্টাডিজে গবেষণা করেন। জাতিসংঘ বিশ্ববিদ্যালয়ের গবেষণা প্রকল্পে অংশ নেন ১৯৭৮ থেকে ১৯৮৩ পর্যন্ত। ১৯৮৫ সালে তিনি চট্টগ্রাম থেকে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে চলে আসেন। সেখান থেকে অবসর নেন ২০০৩ সালে। ২০১৮ সালের জুলাইয়ে সরকার তাকে জাতীয় অধ্যাপকে সম্মানিত করে।
আনিসুজ্জামান অধ্যাপনাকে পেশা হিসেবে বেছে নিয়েছেন বটে; কিন্তু তার নেশা ছিল লেখালেখি ও সাংগঠনিক কার্যক্রমে। তার রচিত ও সম্পাদিত বিভিন্ন গ্রন্থ আমাদের শিল্প-সংস্কৃতি ও ইতিহাসের বিবেচনায় খুবই গুরুত্বপূর্ণ। তার প্রবন্ধ-গবেষণা গ্রন্থের মধ্যে মুসলিম মানস ও বাংলা সাহিত্য, মুসলিম বাংলার সাময়িকপত্র, স্বরূপের সন্ধানে, আঠারো শতকের বাংলা চিঠি, আমার একাত্তর, মুক্তিযুদ্ধ এবং তার পর, পূর্বগামী, কাল নিরবধি, বিপুল পৃথিবী উল্লেখযোগ্য। বেশ কিছু উল্লেখযোগ্য বিদেশি সাহিত্য অনুবাদ এবং নানা বিষয়ে বই সম্পাদনা করেছেন তিনি।
শিক্ষা-শিল্প-সাহিত্য ক্ষেত্রে অসামান্য অবদানের স্বীকৃতি হিসেবে আনিসুজ্জামান বাংলা একাডেমি সাহিত্য পুরস্কার, অলক্ত পুরস্কার, একুশে পদক, আলাওল সাহিত্য পুরস্কার, বেগম জেবুন্নেসা ও কাজী মাহবুবউল্লাহ ট্রাস্ট পুরস্কার (১৯৯০), দেওয়ান গোলাম মোর্তাজা স্মৃতিপদক (১৯৯৩), অশোক কুমার স্মৃতি আনন্দ পুরস্কার (১৯৯৪) লাভ করেন। এ ছাড়া তিনি ভারত রাষ্ট্রের সম্মাননা ‘পদ্মভূষণ’ ও রবীন্দ্রভারতী বিশ্ববিদ্যালয়ের সম্মানসূচক ডি. লিট লাভ করেন।
অধ্যাপক এমাজউদ্দীন আহমদ
চলতি বছরই আমরা হারিয়েছে রাষ্ট্রবিজ্ঞানী ও শিক্ষাবিদ ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সাবেক ভিসি অধ্যাপক ড. এমাজউদ্দীন আহমদ। ১৭ জুলাই তিনি শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করেন। তার বয়স হয়েছিল ৮৭ বছর।
এমাজউদ্দীন আহমদ ১৯৩৩ সালের ১৫ ডিসেম্বর ভারতের পশ্চিমবঙ্গের মালদায় জন্মগ্রহণ করেন। তিনি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ভিসি ছিলেন। ছিলেন রাষ্ট্রবিজ্ঞান বিভাগের চেয়ারম্যান। প্রায় ৩০ বছর ধরে তুলনামূলক রাজনীতি, প্রশাসনব্যবস্থা বাংলাদেশের রাজনীতি, বাংলাদেশের পররাষ্ট্রনীতি, দক্ষিণ এশিয়ার সামরিক বাহিনী সম্পর্কে গবেষণা করেছেন।
বিভিন্ন বিষয়ের ওপর শতাধিক গ্রন্থ লিখেছেন। দেশ-বিদেশের জার্নালে তার প্রকাশিত গবেষণামূলক প্রবন্ধের সংখ্যা শতাধিক। শিক্ষাক্ষেত্রে অবদান এবং সৃজনশীল লেখার জন্য তিনি দেশে ও বিদেশে সম্মানিত হন। শিক্ষাক্ষেত্রে অবদানের জন্য ১৯৯২ সালে তিনি একুশে পদক পান।
কামাল লোহানী
করোনাভাইরাসে আক্রান্ত হয়ে ২০ মে মারা গেছেন ভাষাসংগ্রামী, মুক্তিযোদ্ধা, বরেণ্য সাংবাদিক ও সাংস্কৃতিক ব্যক্তিত্ব কামাল লোহানী। তার বয়স হয়েছিল ৮৭ বছর। তার মৃত্যুতে একটি বড় ধাক্কা খেল দেশের সাংস্কৃতিক অঙ্গন।
ভাষা আন্দোলন থেকে শুরু করে মুক্তিযুদ্ধ, গণতান্ত্রিক আন্দোলন থেকে শুরু করে যুদ্ধাপরাধীদের বিচারের আন্দোলন- সব জায়গায় তিনি অগ্রণী ভূমিকা পালন করেছেন। কামাল লোহানী সাংবাদিকতা দিয়ে পেশাজীবন শুরু করলেও নানা সাংস্কৃতিক কর্মকাণ্ডে নিজেকে যুক্ত রেখেছেন সবসময়। এ দেশের প্রতিটি রাজনৈতিক, সামাজিক ও সাংস্কৃতিক আন্দোলনে অগ্রণী ভূমিকা পালন করেছেন।
কামাল লোহানী হিসেবে পরিচিত হলেও তার পুরো নাম আবু নঈম মোহাম্মদ মোস্তফা কামাল খান লোহানী। ১৯৩৪ সালের ২৬ জুন সিরাজগঞ্জের উল্লাপাড়া থানার খান সোনতলা গ্রামে তার জন্ম। ১৯৫৩ সালে পাবনার তৎকালীন জিন্নাহ পার্কে (বর্তমান স্টেডিয়াম) মুসলিম লীগ কাউন্সিলে নুরুল আমিনের আগমনের প্রতিবাদ করায় প্রথম গ্রেফতার হন তিনি। ১৯৫৪ সালে যুক্তফ্রন্টের পক্ষে কাজ করায় আবারও গ্রেফতার হন। ১৯৫৫ সালের জুলাইয়ে জেল থেকে ছাড়া পাওয়ার পর পরিবারের সঙ্গে মতবিরোধ হওয়ায় ঢাকা চলে আসেন কামাল লোহানী। চাচাতো ভাই ফজলে লোহানীর সহযোগিতায় ওই বছরই দৈনিক মিল্লাত পত্রিকা দিয়ে কর্মজীবন শুরু করেন। একই বছর তিনি ন্যাপে যোগ দিয়ে জাতীয় রাজনীতিতে সক্রিয় হন। ১৯৫৮ সালে সামরিক আইন জারি হওয়ার পর আত্মগোপনে চলে যান তিনি।
ঢাকায় আসার পরই নাচের প্রতি আগ্রহ জন্মে কামাল লোহানীর। বুলবুল ললিতকলা একাডেমির হয়ে কামাল লোহানী তার নৃত্যগুরু জিএ মান্নানের ‘নকশিকাঁথার মাঠ’ প্রযোজনায় অংশ নেন। পাকিস্তান সাংস্কৃতিক দলের হয়ে মধ্যপ্রাচ্যসহ বেশ কয়েকটি দেশে যান তিনি। এরই ফাঁকে তিনি চাকরি করেন দৈনিক ‘আজাদ’, দৈনিক ‘সংবাদ’, ‘পূর্বদেশে’।
১৯৬০ সালে চাচাতো বোন সৈয়দা দীপ্তি লোহানীকে বিয়ে করেন কামাল লোহানী। ২০০৭ সালের ২৪ নভেম্বর তার দীর্ঘ সংগ্রামী জীবনের অনুপ্রেরণাদাত্রী স্ত্রী দীপ্তি লোহানীর প্রয়াণে নিঃসঙ্গ হয়ে পড়েন কামাল লোহানী। এ দম্পতির এক ছেলে; সাগর লোহানী। দুই মেয়ের নাম বন্যা লোহানী ও ঊর্মি লোহানী। ১৯৬১ সালে রবীন্দ্র জন্মশতবার্ষিকী পালনে সরকারি নিষেধাজ্ঞার বিরুদ্ধে তার ছিল দৃঢ় ভূমিকা। শতবর্ষ পালনের আয়োজনে ‘শ্যামা’ নৃত্যনাট্যে তিনি বজ সেনের ভূমিকায় অংশ নিয়ে প্রশংসিত হন। ১৯৬২ সালে স্বল্পকাল কারাবাসের পর কামাল লোহানী ‘ছায়ানট’-এর সাধারণ সম্পাদক হন। সাড়ে চার বছর এই দায়িত্ব পালন করার পর ১৯৬৭ সালে গড়ে তোলেন ‘ক্রান্তি’ নামে একটি সাংস্কৃতিক সংগঠন।
মুক্তিযুদ্ধের সময় কামাল লোহানী স্বাধীন বাংলা বেতারের সংবাদ বিভাগের দায়িত্বে ছিলেন। ১৯৭১ সালের ২৫ ডিসেম্বর তিনি দায়িত্ব নেন ঢাকা বেতারের। দায়িত্ব নেয়ার পর বিধ্বস্ত বেতারকে পুনর্গঠনে মনোযোগী হন। ১৯৭২ সালের ১০ জানুয়ারি বঙ্গবন্ধুর স্বদেশ প্রত্যাবর্তন উপলক্ষে ঢাকার তেজগাঁও বিমানবন্দর থেকে ধারাবিবরণী দিয়েছিলেন কামাল লোহানী।
১৯৭২ সালের ফেব্রুয়ারি বঙ্গবন্ধুর কলকাতা সফর উপলক্ষে দমদম বিমানবন্দরেও ধারাবিবরণী দিয়েছিলেন তিনি। দেশ স্বাধীন হলেও প্রশাসনে পরিবর্তন আসেনি বলে বেতারের চাকরি থেকে ইস্তফা দিয়ে ১৯৭৩ সালে সাংবাদিকতায় ফিরে এসে যোগ দেন ‘দৈনিক জনপদ’-এ।
১৯৮১ সালে তৎকালীন তথ্যমন্ত্রীর সঙ্গে মতবিরোধ হলে ‘দৈনিক বার্তা’ ছেড়ে প্রেস ইন্সটিটিউট বাংলাদেশে (পিআইবি) যোগ দেন। প্রকাশনা পরিচালক ও ‘ডেপথনিউজ বাংলাদেশ’-এর সম্পাদক হিসেবে দায়িত্ব গ্রহণ করার কয়েক মাস পরই তিনি সেখানকার সহযোগী সম্পাদক নিযুক্ত হন।
১৯৯১ সালে কামাল লোহানী প্রথম তত্ত্বাবধায়ক সরকারের আমলে শিল্পকলা একাডেমির মহাপরিচালক হিসেবে দায়িত্ব গ্রহণ করেন। ১৬ মাসের মাথায় বিএনপি সরকারের সংস্কৃতি প্রতিমন্ত্রীর সঙ্গে মতবিরোধ হওয়ায় তিনি পিআইবিতে ফিরে আসেন। ২০০৮ সালে দুই বছরের জন্য আবার শিল্পকলা একাডেমির মহাপরিচালকের দায়িত্ব পালন করেন। বাংলাদেশ উদীচী শিল্পীগোষ্ঠীর সভাপতি ছিলেন চার বছর।
বরেণ্য এই সাংবাদিক ঢাকা সাংবাদিক ইউনিয়নের সভাপতির দায়িত্বও পালন করেন। কামাল লোহানীর লেখা বইগুলোর মধ্যে রয়েছে– ‘আমরা হারবো না’, ‘সত্যি কথা বলতে কী’, ‘যেন ভুলে না যাই’, ‘মুক্তিসংগ্রামে স্বাধীন বাংলা বেতার’, ‘রাজনীতি মুক্তিযুদ্ধ স্বাধীন বাংলা বেতার’, ‘মুক্তিযুদ্ধ আমার অহংকার’, ‘এ দেশ আমার গর্ব’, ‘আমাদের সংস্কৃতি ও সংগ্রাম’, ‘লড়াইয়ের গান’, ‘সাংস্কৃতিক ঐতিহ্য ও নৃত্যশিল্পের বিস্তার’, ‘দ্রোহে প্রেমে কবিতার মত’ এবং কবিতার বই ‘শব্দের বিদ্রোহ’। কামাল লোহানী ২০১৫ সালে সাংবাদিকতায় একুশে পদক লাভ করেন।
সা’দত হুসাইন
দেশসেরা আমলাদের একজন সাবেক মন্ত্রিপরিষদ সচিব ও বাংলাদেশ সরকারি কর্ম কমিশনের (পিএসসি) সাবেক চেয়ারম্যান ড. সা’দত হুসাইনের মৃত্যু এ বছরের আলোচিত ঘটনা। ২৩ এপ্রিল তিনি নানা রোগে ভোগে মৃত্যুবরণ করেন। সা’দত হুসাইনের বয়স হয়েছিল ৭৩ বছর।
পিএসসির চেয়ারম্যান থাকাবস্থায় তিনি সর্বোচ্চ পেশাদারিত্বের পরিচয় দিয়ে অনন্য নজির সৃষ্টি করে গেছেন। তার সময়ে সরকারি নিয়োগে স্বচ্ছতা ছিল।
সা’দত হুসাইন ২০০২-০৫ সালে মন্ত্রিপরিষদ সচিবের দায়িত্বে ছিলেন। ২০০৭ থেকে ২০১১ সাল পর্যন্ত তিনি বাংলাদেশ সরকারি কর্ম কমিশনের (পিএসসি) চেয়ারম্যানের দায়িত্ব পালন করেন। তিনি শিক্ষা সচিবের দায়িত্বও পালন করেছেন।
সা’দত হুসাইন ১৯৪৬ সালের ২৪ নভেম্বর নোয়াখালীতে জন্মগ্রহণ করেন, পড়াশোনা করেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে অর্থনীতি বিষয়ে। ১৯৭০ সালে সিভিল সার্ভিস অব পাকিস্তানে (সিএসপি) যোগদান করেন। পরে বাংলাদেশ সৃষ্টির পর বিভিন্ন মন্ত্রণালয়ে গুরুত্বপূর্ণ দায়িত্ব পালন করেন।
মুর্তাজা বশীর
করোনাকালে আমরা যাদের হারিয়েছি তাদের মধ্যে বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য মুর্তাজা বশীর। ১৫ আগস্টে মারা যান। তিনি ছিলেন একাধারে চিত্রশিল্পী, লেখক ও গবেষক। ৮৮ বছর বয়সী এই চিত্রশিল্পীর ফুসফুস ও কিডনি জটিলতার পাশাপাশি হৃদরোগও ছিল।
বহু ভাষাবিদ ডক্টর মুহম্মদ শহীদুল্লাহর ছেলে মুর্তাজা বশীরের জন্ম ১৯৩২ সালের ১৭ আগস্ট। তিনি নবকুমার ইন্সটিটিউশনে, ঢাকা গভর্নমেন্ট ইন্সটিটিউট অব আর্টস (বর্তমানে চারুকলা ইন্সটিটিউট) এবং কলকাতার আশুতোষ মিউজিয়ামে পড়াশোনা করেন। ছিলেন ভাষা আন্দোলনের একজন সক্রিয় কর্মী।
১৯৭৩ সালে চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের চারুকলা বিভাগে সহকারী অধ্যাপক হিসেবে যোগ দেন। ১৯৯৮ সালে তিনি অধ্যাপক হিসেবে অবসর গ্রহণ করেন। একুশে পদক ও স্বাধীনতা পদকসহ অনেক পুরস্কার ও সম্মাননা পান।
বাংলাদেশের শিল্পকলার পরিসরে মুর্তাজা বশীর ছিলেন অপরিহার্য ও অন্যতম উল্লেখ্য এক নাম। দৃশ্যশিল্পের বিভিন্ন শাখায় যেমন বিচরণ করেছেন তিনি, তেমনি সৃজনকলার অন্য দুটি মাধ্যম সাহিত্য ও চলচ্চিত্রেও রেখেছেন সৃজন-প্রতিভার স্বাক্ষর।
মুর্তাজা বশীর একাধারে চিত্রশিল্পী, ভাষাসংগ্রামী, গবেষক ও ঔপন্যাসিক। তার গল্প, উপন্যাস, এমনকি তার কবিতাও মূলত আত্মজৈবনিক। মহান ভাষা আন্দোলনে তিনি সক্রিয় ভূমিকা রেখেছেন। ১৯৫২ সালের ২১ ফেব্রুয়ারি ছাত্রদের মিছিলে পুলিশের গুলিবর্ষণের পর রক্তাক্ত আবুল বরকতকে যারা হাসপাতালে নিয়ে যান, মুর্তাজা বশীরও তাদের মধ্যে ছিলেন।
চিত্রকলায় গুরুত্বপূর্ণ অবদানের জন্য ১৯৮০ সালে একুশে পদক পান মুর্তাজা বশীর। একই কাজে স্বাধীনতা পুরস্কার পান ২০১৯ সালে।
বাংলাদেশে বিমূর্ত ধারার চিত্রকলার অন্যতম পথিকৃৎ মুর্তাজা বশীরের ‘দেয়াল’, ‘শহীদ শিরোনাম’, ‘পাখা’, ‘রক্তাক্ত ২১ শে’ শিরোনামের চিত্রকর্মগুলো বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য। পেইন্টিং ছাড়াও ম্যুরাল, ছাপচিত্রসহ চিত্রকলার বিভিন্ন মাধ্যমে কাজ করেছেন তিনি। এ ছাড়া লিখেছেন বই এবং গবেষণা করেছেন মুদ্রা ও শিলালিপি নিয়েও। বেশ কিছু উল্লেখযোগ্য দেয়ালচিত্র করেছেন মুর্তাজা বশীর।
মনজুরে মওলা
করোনাভাইরাসে গুণীজনদের মধ্যে সবশেষ মারা যান বাংলা একাডেমির সাবেক মহাপরিচালক কবি ও প্রাবন্ধিক মনজুরে মওলা।
২০ ডিসেম্বর ৮০ বছর বয়সে মারা যান। মনজুরে মওলার নানাবিধ পরিচয়, যিনি জীবনের শেষ দিনগুলোতেও কর্মক্ষম ছিলেন, লিখে গেছেন বিচিত্র বিষয়ে। লেখালেখি, সম্পাদনা, গ্রন্থ পরিকল্পনা- নানা কাজে নিজেকে ব্যস্ত রেখেছিলেন। পেশাজীবনে বাংলাদেশের বিভিন্ন মন্ত্রণালয়ের সচিবের দায়িত্ব পালন করেছেন। তবে সব ছাপিয়ে বড় হয়ে উঠেছে বাংলা একাডেমির মহাপরিচালক পরিচয়টি। আশির দশকে প্রায় তিন বছর তিনি বাংলা একাডেমির মহাপরিচালকের দায়িত্ব পালন করেছিলেন। তার নামের সঙ্গে জড়িয়ে আছে অমর একুশে গ্রন্থমেলার ইতিহাস। ‘একুশ আমাদের পরিচয়’ প্রত্যয়ে সে সময়েই আনুষ্ঠানিকভাবে শুরু হয় অমর একুশে গ্রন্থমেলা, আজ যা বিশ্বের দীর্ঘ সময়ব্যাপী চলা বই উৎসব।
ঐতিহাসিক বর্ধমান ভবন সংস্কার, প্রথম জাতীয় ফোকলোর কর্মশালা আয়োজন, আরজ আলী মাতুব্বর বা খোদা বক্স সাঁইয়ের মতো লোকমনীষাকে ফেলোশিপ প্রদান, ‘বাংলা সাহিত্যের ইতিহাস’ বা ‘ডেভিডসনের চিকিৎসাবিজ্ঞান’-এর মতো বই প্রকাশে উদ্যোগী হয়েছেন তিনি।
বাংলা একাডেমিতে তার অসামান্য কীর্তি ‘ভাষাশহীদ গ্রন্থমালা’র ১০১টি বই। এমন অনেক বই এই সিরিজে প্রকাশিত হয়েছে, যা বিষয় হিসেবে ছিল নতুন। এমন অনেকে এই সিরিজে লিখেছেন– যারা পরে সে বিষয়ে অর্জন করেছেন বিশেষ পরিচিতি। প্রশাসক-গবেষক-সম্পাদক-অনুবাদক-কবি মনজুরে মওলা লিখেছেন দুটো কাব্যনাট্য- ‘আমি নই’ ও ‘জালিয়ানওয়ালাবাগ’।
তারই পরিকল্পনায় রবীন্দ্রসার্ধশতবর্ষে রবীন্দ্রবিষয়ক ১৫১টি বই প্রকাশ হয়।
Leave a Reply