উজান
প্রেক্ষাপট 1:
আমিনা, বয়স 22 বছর। মালদার এক পাউরুটি কারখানায় কাজ করে। স্বামী রিক্সা চালায়। এই সুযোগ কাজে লাগিয়ে, মানে তার স্বামীকে মদ গেলার টাকা যুগিয়ে প্রায় রাতে কারখানার মালিক আমিনার শরীরটা জোর করে ভোগ করে। আলিও সেই কারখানার কর্মী।বিবাহিত। গত সাত বছর ধরে তারা এই কারখানায় একস্ংগে কাজ করে ।আমিনা তার স—ব দুঃখের কথা আলীকে বলে। ঠিকমত খেতে পায় না আমিনা। আলি রোজ তার খাবার থেকে রুটি বা মুড়ির অর্ধেক আমিনাকে কতকটা জোর করেই খাইয়ে দেয়। আমিনা ফ্যালফ্যাল করে তাকিয়ে থাকে আলির দিকে — আলি তার শূণ্যদৃষ্টিতে, চুপ করে থেকে আমিনাকে অনেক কিছু বলে দেয় ।এ এক অন্য ভরসা আমিনার কাছে । একদিন হঠাৎ আমিনা আলিকে প্রশ্ন করে, “আমার শরীর তো মালিক জোর করে ভোগ করে, তুই জোর করিস না কেন ! তুই কি আমায় ঘেন্না করিস? ” আলি শান্ত গলায় উত্তর দেয়, “তোকে ঘেন্না করলে তোর দুঃখ ভাগ করে নিতাম কি করে ‘আমি’, কিন্ত আমি যেদিন তোর শরীরটা জোর করে ভোগ করব, তার পরদিন থেকে তুই তো আমায় ঘেন্না করবি ‘আমি ‘!! সে আমি সহ্য করতে পারবো না রে”। আমিনা চুপ করে আলির দিকে তাকিয়ে থাকে। তার দু’গাল বেয়ে জলের ধারা গড়িয়ে পরে। —এও এক পরকীয়া !!!
প্রেক্ষাপট 2:
কল্যাণীর Central Lake এর Park টায় অরূপ শেষবারের মতো অপেক্ষা করছে শিউলির জন্য। তাদের ছয় বছরের ভালবাসার সম্পর্ক আজ শেষ হতে চলেছে। শিউলির বিয়ের ঠিক হয়ে গেছে অন্য জায়গায়। কাল তার বিয়ে। তাই আজ সারাজীবনের জন্য বিদায় নিতে আসছে অরূপের থেকে। অরূপের বুক ফেটে যাচ্ছে, ঠিক এমন সময় শিউলি এসে পৌঁছায় সেখানে। নিজেকে সামলে নিয়ে অরুপ বলে, আজ শেষদিনে এই প্রথমবার আমি আগে পৌঁছেছি শিউলি। শিউলি কিছু না বলে অরূপের হাতটা চেপে ধরে। বলে, তোমার ভেতরটা তো ভেঙ্গে যাচ্ছে গো! ” চুপ করে থাকে অরুপ। কিছুক্ষন পর নিরবতা ভেঙে বলে, জানো শিউলি, ছোটবেলায় বাবা বলত “তুই তো চ্যাম্পিয়ন ! ” কিন্তু অন্যরা বলত আমি নাকি অকর্মণ্য। আজ বুঝলাম বাবা আমাকে চিনতে ভুল করেনি, আমি সত্যিই চ্যাম্পিয়ন। দু’জনের চোখেই জল। নীরবতা ভেঙে শিউলি বলে, চলি অরুপ, দেরি হয়ে যাচ্ছে। বলেই অরূপের দিকে না তাকিয়েই এগিয়ে যায়। অরুপ শূণ্যদৃষটিতে শিউলির চলে যাওয়ার পথে
চেয়ে থাকে।হঠাৎ একটা পানকৌড়ি Lake এর জল থেকে মাছ মুখে নিয়ে উড়ে যায়। সম্বিৎ ফিরে অরুপ অস্ফুটে বলে, “কাল থেকে তুমি অন্যের বউ শিউলি। তবুও তোমায় আমি সারাজীবন ভালবেসে যাব “। —- কাল থেকে এই প্রেমটাও পরকীয়া হয়ে যাবে !!!
প্রেক্ষাপট 3 :
সোনারপুর স্টেশনে 2নং প্ল্যটফরমের ওপর একটা চায়ের দোকান চালায় উমা। সবার বৌদি। 42 বছর বয়স , কিন্ত বিধবা। ডাগর চেহারা।হয়ত সেই টানেই খদ্দেরের সংখ্যা একটু বেশী -ই। চা খেতে খেতে বৌদির শরীরের বিভাজীকাগুলো দেখে নেবার লোভ অনেকেই সামলাতে পারে না। বৌদির চোখ এড়ায় না। কিন্তু তার মধ্যেও বছর পঞ্চাশের মধুদা কেমন যেন অন্যরকম। কোনোদিন লোলুপ দৃষ্টি নেই অন্যদের মত। মধুদা ট্রেনে মহিলাদের Cosmetics বিক্রি করে। অবিবাহিত। রোজ রাত দশটায় বাড়ী ফেরার আগে উমার হাতের এক কাপ চা খেতেই হবে তাকে, সাথে একটু সুখদুঃখের কথা। কখনো দোকানের প্লাস্টিক কেনা, Cylinder কেনা বা চা পাতা কেনা —–বহুবার মধুদা টাকা দিয়ে সাহায্য করেছে উমাকে। ফেরত দিতে গেলে বলে, চা খাইয়ে শোধ করে দিও । অথচ কোনোদিন এক কাপ চাও বাকিতে খায় না। সেদিন একটু তাড়াতাড়ি বাড়ি ফিরবে বলে মধুদা একটু তাড়াতাড়ি দোকানে চলে এসেছিল। অনেক কথার ফাঁকে হঠাৎ উমাকে জিগ্গেস করে, পূজো তো এসে গেল, কাপড় কিনেছ ? চুপ করে থাকে উমা। মধুদা আবার এক ই প্রশ্ন করায় বলে, মেয়ে দুটোকেই এখনো কিছু কিনে দিতে পারিনি। নিজে কি করে কিনি !! কিছু না বলে চলে যায় মধুদা। তারপর দুদিন কোনো দেখা নেই। উমার মনটা কেন যেন বলে, অসুস্থ হয়ে পড়ল না তো লোকটা ! বোঝে না মনটা কেন এমন হাকপাক করে ।তারও দুদিন পর রাতে মধুদা আসে দোকানে। বলে গত তিনদিন তার ধূম জ্বর ছিল। আজ কোনোমতে বেরিয়েছে। উমা বলে তুমি তাহলে বেশী রাত কোরো না । মধুদা বলে আর একটু থাকি। উমা বুঝতে পারছিল মধুদা তার ব্যাগ থেকে কিছু বার করার চেষ্টা করছিল বারবার। অথচ প্রতিবার খদ্দের চলে আসায় বার করতে পারছিল না। অবশেষে সেই সুযোগ আসে। ব্যাগ থেকে তিনটে প্যাকেট বার করে উমার হাতে দিয়ে বলে, এতে দু’টো সালোয়ার আর একটা শাড়ি আছে। আমার তো আপন বলে কেউ নেই, তুমি পোরো। চোখদুটো চিকচিক্ করে ওঠে উমার। অনেক কিছু বলতে চায় সে। কিনতু কোনো সুযোগ না দিয়েই চলে যায় মধুদা। উমা ভাবে কেউ একজন তো অন্তত তার কথা ভাবে। কিনতু এটা তো সমাজের চোখে পরকীয়া !!!
প্রেক্ষাপট 4 :
তুলিকা আর আদিত্য শিলিগুড়িতে একটি বেসরকারি প্রতিষ্ঠানের একই Dept. এ গত দশ বছর ধরে একসঙ্গে চাকরি করে। দুইজন ই চল্লিশের এদিক ওদিক হবে, বিবাহিত। তুলিকার Husband অসুস্থতার কারণে VR নিয়ে নিয়েছে। আর আদির Wife একটি Bank এর Zonal Manager । মাসে 20/22 দিন বাইরেই কাটায়। ভদ্রমহিলা সবসময় আদিত্যকে বলে, কি যে চাকরি কর! কয় টাকাই বা মাইনা পাও। আদি খুব দুঃখ পায়, কিনতু কিছু বলে না। সব সহ্য করে এসে তার দুঃখের জায়গাটা তুলির সাথে Share করে। তুলিও তার নানান ভালোলাগা মন্দলাগা গুলো মনখুলে আদিকে বলে। এভাবে Share করতে করতে কখন যেন দুটি মন একই পংতিতে বসে পরেছে, তারা টের পায়নি। এ নিয়ে অফিসে অনেক মুচমুচে কথা চালু আছে। বক্রোক্তিও মাঝে মাঝে শুনতে হয়। তারা কিছু বলে না। কিনতু নিজেদের মনের টানটা উপেক্ষাও করতে পারে না। অফিসের পরেও বা ছুটির দিনে Whatsapp এ তারা নিজেদের মধ্যে কথা বলে — খুনসুটি,ঝগড়া , ভাললাগা সবকিছু চলতে থাকে। কিনতু তারা নিজেদের সংসারের সব দায়িত্ব পালন করে। দুজনেই নিজের নিজের স্বামী /স্ত্রী কে খুব ভালবাসে। পাশাপাশি নিজেরাও যে ভীষণ ভাবে কাছে চলে এসেছে, সেটাও টের পায়। একজন অফিসে না এলে অন্যজনের মন খারাপ হয়ে যায়, একজন Lunch না করলে অন্যজনও Wait করে, একজনের শরীর খারাপ হলে অন্যজন হাকপাক করে, টেনশন করে। দুইজনেই দু’জনের কাজে সাহায্য করে। তারা বুঝতে পারে, একটা পরিপূর্ণ কিনতু না বলা সম্পর্ক তৈরী হয়েছে, যেখানে
Emotions, Feelings, Sharings সব একাকার হয়ে যায়। —-এও সমাজের চোখে পরকীয়া !!!
আসলে সমাজ দুটি শরীরকে একসাথে শোবার অনুমতি দিতে পারে। কিন্তু দুটো মনকে পরস্পরের ভরসা দেবার অনুমতি দেয় না, বা বলা ভাল দেবার ক্ষমতা নেই। সেই অক্ষমতাকেই পরকীয়া বলে চালিয়ে দেয়। অথচ এই পরকীয়াই যে কত মানুষের বেঁচে থাকার রসদ, সেই হদিস সমাজের কাছে থাকে না। তাই সমাজের কাছে পরকীয়া মানেই হয়ে দাঁড়িয়েছে শরীরী মিলন। এই সমাজ জানেই না যে, শরীরী দেওয়া -নেওয়া না করেও, শুধু মনের দেওয়া -নেওয়া নিয়েও অনেক সংসার টিকে আছে, অনেক মানুষ বাঁচার রসদ পাচ্ছে। এই পরকীয়া রোখার সাধ্য সমাজের নেই ——- এই পরকীয়া সূর্যদয়ের মতোই চিরকালীন ।।
Leave a Reply