নাহার ফরিদ খান
প্রায় ত্রিশবছর পরে দেখা অসীমের সাথে শিউলির । ত্রিশ বছর কম সময় নয় ।জীবনের বাঁক বদলের জন্য অনেকটা সময় । গত সাতটি দিন ভীষন মানসিক চাপের ভেতর ছিল শিউলি । আজ নিরিবিলি স্টিমারের ডেকে বসে বুঝতে পারলো । ঢাকা বরিশাল, বরিশাল ঢাকা সপ্তাহে প্রতিদিনই লঞ্চ চলে কিন্ত সপ্তাহে দুদিন মাত্র স্টিমার চলে । স্টিমারভ্রমণ দারুণ উপভোগ্য । ছোটবেলায় কয়েকবার স্টিমারে ভ্রমণ করেছে । সে সব স্মৃতি খুব মনে পড়ে । স্টিমারের ডাইনিং এ বসে খাওয়া বেশ উপভোগ্য ছিল । প্রায় পনের বছর পরে আবার স্টিমারে ঢাকা ফিরে যাচ্ছে শিউলি । ঘন্টা দুয়েক হয় স্টিমার ছেড়েছে । এতোক্ষণ ডেকে বেশ লোকজনের ভীড় ছিল । কেউ সিগারেট খাচ্ছিল ,কেউ নদীর ঝিরিঝিরি বাতাসে আড্ডা মারছিল কেউ বা সন্ধ্যায় ঘাটে ভেড়া লঞ্চগুলো থেকে আলোর বিচ্ছুরণ উপভোগ করছিল ।এখন ডেকটা একেবারেই ফাঁকা । তাই শিউলি এসে রিলাক্স করে প্লাটিকের চেয়ার টেনে রেলিং ঘেষে বসলো। বড় আপার হ্যাজব্যান্ড মানে শিউলির দুলাভাই আজ আটদিন হয় মারা গেছেন ।খবরটা শোনার সংগে সংগে ঢাকা থেকে সন্ধ্যার লঞ্চে রওয়ানা হয় শিউলি । সন্ধ্যায় রওয়ানা হলে পরেরদিন খুব ভোরে এসে বরিশাল পৌছে ।বড় ভাইয়ের ফ্যামিলির সংগেই শিউলি আসে ।শিউলির মেয়ের এ লেভেল,স পরীক্ষা চলছিল তাই মেয়েকে একা রেখে ওর স্বামীও আসতে পারেনি । তাই নোমানই বললো —” শিউলি তুমি বরং একাই যাও। আপাকে সামলাতে তোমাকেই প্রয়োজন বেশি । আমি আর সোনালী থাকি । তুমি কোন চিন্তা করো না “ ।বড় দুলাভাই ছয়মাস ধরে ক্যান্সারে ভুগছিলেন । ব্যাংককে ট্রিটমেন্ট করিয়েছেন কিন্ত লাষ্টষ্টেজে করার কিছু নেই ।ডাক্তার জবাব দিয়ে দিয়েছেন । দুই মাস সময়সীমা বেঁধে দিয়েছিলেন । কিন্ত তিনমাস বেঁচে ছিলেন । আসার আগে আপাকে দেখে মনে হয়েছে আপা মোটামুটি শোক সামলে নিয়েছেন ।এমনিতে বেশ বাস্তববাদী, শক্তমনের মানুষ আপা। যে কোন সিদ্ধান্ত নিতে বেশ কঠোর এবং অবিচল । শিউলির আপার শ্বশুর বাড়ি বরিশালে বেশ নাম ডাকওয়ালা বাড়ি শহরে সবাই চেনে “চৌধুরী মহল “ । স্টিমার র্সাচলাইট ফেলে এগিয়ে চলেছে । ঝিরঝিরে আবেশমাখা বাতাস গায়ে যেন মখমলি প্রলেপ বুলিয়ে দিচ্ছে শিউলির শরীরে । দুরে পিদিম জ্বালা নৌকাগুলো জলের ওপর ভাসছে। কাজরী ভেসে আসছে ।আকাশে রুপোর থালার মতো চাঁদ। অপরূপ আলো ছড়িয়েছে পৃথিবীর বুকে । নদীতে চাঁদের আলোর প্লাবন ।চাঁদটা নদীতে নেমে বিগলিত হাসি ছড়িয়েছে ঢেউগুলোর মাখামাখিতে । অপরূপ সে দৃশ্য শিউলির হৃদয়ে ঢেউয়ের মতো কাঁপন তুলেছে । দুরে তীরের নারকেল ,সুপারির বনে চাঁদের আলো যেন পাতায় পাতায় পিছলে পড়ছে । শিউলি নদীর সাথে জোছনার এই সখ্য দেখে আহ্লাদে দিশেহারা ।ওর কবি কবি মনটা আজ যেন কোন তেপান্তরে ছুটে যেতে চায় । ছাত্রজীবনে একটু আধটু কবিতা লিখতো বৈকি ।আজকের জোছনা যেন মোমের আলোর মতো গলে গলে পড়ছে প্রকৃতিতে । শিউলির বয়স এখন পঞ্চাশ কিন্ত আজ যেন কুড়ি বছরের তরুণীর মতো উচ্ছসিত হয়ে উঠলো জোছনা আবেশে ।গুনগুনিয়ে গেয়ে উঠলো –” এই মোম জোছনায় অঙ্গ ভিজিয়ে এসো না গল্প করি “ “ একা একা গল্প জমে নাকি ? “চমকে ফিরে দেখে অসীম রেলিং ধরে দাঁড়িয়ে । হয়তো অনেকক্ষণ ধরেই শিউলিকে লক্ষ্য করছিল । একটু অপ্রস্তত হয়ে জিজ্ঞেস করলো -” অসীমদা কখন এলে ! খেয়াল করিনি তো । “” তুমিতো জোছনার প্রেমেই মগ্ন ছিলে “ । চেয়ার টেনে মুখোমুখি বসলো দুজন । অসীম একটু হেসে “ ত্রিশবছর পরে দেখা , তাই না ? “” তাই তো । ও বাড়িতে তো কথা বলার তেমন পরিবেশ ছিলো না । তাই তোমার সাথে তেমনভাবে কথা হলো না । কবে এসেছো ইংল্যান্ড থেকে ! ঢাকায় কোথায় উঠেছো ? “ “ এসেছি দিন পনেরো হয় । ঢাকায় নেমেই সরাসরি বরিশাল চলে এলাম । বুঝেছিলাম ভাইয়ার অবস্থা একেবারেই ভালো নয়। “ “ বউ বাচ্চা নিয়ে এলে না কেন । ওদেরও তো দেশে আসা হয় না ।” “ মেয়েটার স্কুল খোলা আর ডরোথি হাসপাতাল থেকে ছুটি পায়নি। অল্প সময়ের জন্য এলাম । পরশু চলে যাচ্ছি “ “ শিউলি তোমার নিজের দিকে একটু খেয়াল রেখো ।” “ কেন বলো তো “ “ বেশ মুটিয়ে গেছো দেখছি্। ডাক্তার মানুষ তো তাই চোখে পড়লো । বললাম । কিছু মনে করো না যেন “” আমি কি মনে করলাম তাতে কার বা কি আসে যায় ! “ “ রোগী দেখে দেখে চোখটা পেকে গেছে ।তাই একটু সাবধান করা “ বলেই হেসে উঠলো নিজের রসিকতায় । শিউলির মনে হলো আকাশে চাঁদের হাসিটি যেন অসীমের মুখে । মনেমনে ভাবলো মানুষটা অনেক বদলে গেছে কিন্ত হাসিটি বদলায়নি একটুও । সেই বত্রিশ বছর আগের তারুণ্যদীপ্ত হাসিটি রয়ে গেছে অবিকল । “ শুনেছি বেশ বড়ো ডাক্তার তুমি তোমার বউও তো ডাক্তার । প্রেমের বিয়ে নাকি অসীমদা “ । “ না তেমন প্রেমের নয় তবে চলতে চলতে হঠাৎ সিন্ধান্ত নিলাম আমরা একে অন্যকে ভালো বুঝি যখন ,তখন বিয়ে করা উচিত করে ফেললাম “ “ ভালো করেছো “ “ তোমার মতো চুটিয়ে প্রেম করে বিয়ে নয় “ “ আমি চুটিয়ে প্রেম করে বিয়ে করেছি কে বললো তোমাকে “ “ কেন ভাবী মানে তোমার বোন “ “ তাই বুঝি আপা বলেছে ! “ “ তা আপা তো আমাকে বলেছিলো , তুমি বাংলাদেশে নীলা নামে একটি মেয়েকে ভালবাসতে ।তাকে বিয়ে করলে না কেন ? “ “ কি বলছো ! নীলা আবার কে ! যাকে ভালবেসেছিলাম তাকে তো বলতেই পারলাম না “ “ কেন “ “ সেতো তখন অন্য একজনকে মন দিয়ে বসেছিলো “। অসীম কিছুক্ষণ চুপ করে কি যেন ভাবলো । শিউলিকে হঠাৎ জিজ্ঞেস করলো “ সত্যি বলতো এটা কি তোমার পছন্দের বিয়ে নাকি পরিবারের পছন্দের বিয়ে ? “ এতোদিন পরে এসব প্রশ্নের কোন মানে নেই “ “ আমি জানতে চাই । উত্তর দাও প্লীজ “ “ আমার কোন প্রেম ছিল না । পারিবারিক পছন্দের বিয়ে ।” অসীম আবার কিছুক্ষণ চুপ । কি যেন ভাবলো তারপর বললো “ শিউলি দুয়ে দুয়ে চার হয় বুঝলে “ । শিউলি মাথা নাড়লো । কিছুই বোঝেনি । “ বুঝলে না তোমার আপা মানে আমার ভাবী মধ্যবর্ত্তিনীর ভূমিকা পালন করেছে । আমাদের দুজনকে মিথ্যে তথ্য দিয়ে দুজনকে যোজন যোজন দুরে ঠেলে দিয়েছে ।দুরত্ব তৈরী করে দিয়েছে “। শিউলি সব বুঝলো । মৃদু হাসিতে বলে উঠলো -” ভালোই হলো ।আমরা দুজন দুটি নতুন সঙ্গী পেলাম । চাঁদের দিকে তাকিয়ে বললো” ” জীবনতো এমনই । কখনো পূর্ণিমা কখনো অমাবশ্যা । সবকিছু মেনে নিতে হয় “ । “ মেনে তো নিয়েছি সবকিছু । অভিযোগ তো করিনি । আজ সব প্রশ্নের উত্তর পেলাম । “
” মানে “ “ তোমার বত্রিশ বছর আগের চোখের ভাষা মিথ্যে ছিলো না । আমার বোঝাটাও মিথ্যে ছিলো না “ । অসীম গভীর চোখে শিউলির দুচোখে চোখ রাখলো । শিউলি একবার তাকিয়ে উঠে দাড়ালো । মৃদুকন্ঠে বললো শিউলি “ রাত অনেক হলো “ কেবিনে যাবার জন্য পা বাড়ালো ।মধ্যবয়সে মধ্যরাতের গল্প বিষন্নতা ছড়িয়ে দিচ্ছিল। তবু জোছনাস্নানে নদীর মখমলি হাওয়া শরীরটা জুড়িয়ে দিলো ।
Leave a Reply