দীপক সাহা,
পশ্চিমবঙ্গ
কয়েক সপ্তাহ ধরে উত্তাল বাংলাদেশ । ঢাকার দক্ষিণে ধোলাইপাড়ে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের একটি ভাস্কর্যকে ‘মূর্তি’ আখ্যা দিয়ে তা অপসারণের দাবি করছে ধর্মীয় কিছু গোষ্ঠী৷ এরই মধ্যে কুষ্টিয়ায় বঙ্গবন্ধুর নির্মাণাধীন ভাস্কর্য ভাঙ্গা নিয়ে উত্তেজনার পারদ ঊর্ধ্বগামী। বঙ্গবন্ধুর ভাস্কর্য প্রতিষ্ঠা নিয়ে ব্যাপক তর্কযুদ্ধ চলছে৷ কোথাও কোথাও পুলিশের সঙ্গে বিরোধীদের সংঘর্ষের খবরও পাওয়া যাচ্ছে। বুড়িগঙ্গার জলে বঙ্গবন্ধুর ভাস্কর্য নিক্ষেপ করা হবে বলে হুঁশিয়ারিও দেওয়া হয়েছে। পরিস্থিতি যথেষ্ট উদ্বেগজনক। একপক্ষ বলছে, ভাস্কর্য ইসলামে হারাম। অপরপক্ষের মত, ভাস্কর্য কেবল ধর্মের বিষয় না, বরং ইতিহাস, সংস্কৃতির ও শিল্পের সঙ্গেও যুগ যুগ ধরে জড়িয়ে আছে ভাস্কর্য৷ ভাস্কর্য ও মূর্তি এক নয়। আওয়ামী লীগ সরকার এবং কিছু গোড়া ইসলামপন্থী সংগঠন ক্রমশ মুখোমুখি অবস্থানের দিকে যাচ্ছে বলে মনে হচ্ছে।
বাংলাদেশে স্বাধীনতার পর থেকে নানা সময়ে, নানা সরকারের আমলে ভাস্কর্য স্থাপন করা নিয়ে বিতর্ক হয়েছে৷ ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে মুক্তিযুদ্ধের প্রতীক অপরাজেয় বাংলা নির্মাণের সময়ও কট্টরপন্থীদের পক্ষ থেকে তীব্র আপত্তি উঠেছিল, সেটির নির্মাণকাজ থেমেও গিয়েছিল৷ পরে জিয়াউর রহমানের শাসনকালে সেটির নির্মাণকাজ শেষ হয়৷ এরপর মতিঝিলের বলাকা ভাস্কর্যে হামলা চালিয়ে সেটি ক্ষতিগ্রস্ত করা, জিপিওর সামনে থেকে বর্শা নিক্ষেপের ভাস্কর্য রাতের অন্ধকারে সরিয়ে ফেলা, কট্টরপন্থীদের হুমকিধামকিতে বিমানবন্দরের সামনে ধর্মনিরপেক্ষতার প্রতীক বাউল ভাস্কর্য, হাই কোর্টের সামনের বিচারের প্রতীক লেডি জাস্টিস ভাস্কর্য সরিয়ে ফেলা, বরাবরই এসব হুমকিতে সরকার ছাড় দিয়ে এসেছে৷ সব পেরিয়ে বিতর্ক এখন স্বয়ং বঙ্গবন্ধুর ভাস্কর্যে এসে ঠেকেছে৷
পুজো বা উপাসনার জন্য না হলেও যে কোনো ভাস্কর্য নির্মাণ ও স্থাপন ইসলাম সম্মত নয় বলে দাবি করেছেন বাংলাদেশের আলেমরা। দেশের অনেক শীর্ষস্থানীয় উলামা, মাশায়েখ ও মুফতিরা দিন কয়েক আগে এক যৌথ সংবাদ সম্মেলনে বলেছেন, মানুষ বা অন্য যে কোনো প্রাণীর ভাস্কর্য অথবা মূর্তি নির্মাণ, স্থাপন ও সংরক্ষণ পুজোর উদ্দেশ্যে না হলেও সন্দেহাতীতভাবে নাজায়েজ, স্পষ্ট হারাম এবং কঠোরতম আজাবযোগ্য গুনাহ। এ ধরনের শরিয়তবিরোধী কাজ মুসলমানদের জন্য অনুসরণযোগ্য নয়। তাঁদের মতে,যাঁরা বলছেন মূর্তি ও ভাস্কর্য এক নয়,তাঁরা সত্যকে গোপন করছেন। এটি কোরান ও সুন্নাহকে অমান্য করা। তাঁদের আরও বক্তব্য, বঙ্গবন্ধুর মূর্তি স্থাপন বঙ্গবন্ধুর আত্মার সঙ্গে গাদ্দারি করার শামিল৷
মানব সভ্যতার ইতিহাসে শিল্পের সঙ্গে বিভিন্ন ধর্মের ধর্মীয় কারবারিদের সংঘাত আবহমানকাল ধরে। সাহিত্য,সংস্কৃতি,শিল্প, বিজ্ঞানের উৎকর্ষের পথে বারেবারে সেই সমস্ত ধর্মের ব্যবসায়ীরা অন্তরায় হয়ে দাঁড়িয়েছে। মুষ্টিমেয় কিছু মৌলবাদী সংগঠন সমাজের রন্ধ্রে রন্ধ্রে বিষবাষ্প ছড়িয়ে চলছে যুগ যুগ ধরে। ধর্মের ঠিকাদারিদের সে সব বিতর্কিত অপকাহিনি আমরা কম বেশি সবাই জানি। সেই বিতর্কের ভূত এখনও আমাদের তাড়া করে বেড়াচ্ছে।
বিশ্ব সভ্যতার ক্রমবিকাশে বিজ্ঞান, ধর্ম ও শিল্প-কলা- প্রত্যেকেই নিজ নিজ জায়গা থেকে গুরুত্বপূর্ণ অবদান রেখে চলেছে। বিজ্ঞান যখন মানুষের দৈনন্দিন জীবনের সমস্যা সমূহের সমাধানে নিরন্তর কাজ করে যাচ্ছে, ধর্ম তার নৈতিক সত্ত্বাকে বিচ্যুতির হাত থেকে রক্ষায় রয়েছে সদা ব্যাপৃত। আর, শিল্প-কলা? আনন্দ-পিপাসু মানুষের চিত্তবিনোদনের অফুরন্ত উৎস হিসেবে কাজ করে গেছে। শুধুই কি তাই? ধর্মের যেমন রয়েছে অতুলনীয় উজ্জীবনী শক্তি, শিল্প-কলাও বিনোদনের পাশাপাশি জনমানস গঠনে রাখতে পারে অনন্য সাধারণ ভূমিকা। এখানে ভাস্কর্যের অবস্থান কোথায়? একটি চিত্রকর্ম দ্বিমাত্রিকভাবে অনেক কথাই বলতে পারে, তবে এটাকে বড় জোর কোথাও ঝুলিয়ে রাখতে পারবেন। কিন্তু, ভাস্কর্য নামের ত্রিমাত্রিক শিল্পকর্ম যদি দৃষ্টি-নন্দন হয়, পাবলিক প্লেসে স্থাপন করেন, এটি অগণিত মানুষের জন্য দর্শনীয় স্থানে পরিণত হতে পারে। মানুষ এটা দেখবে, এর নির্মাণ-শৈলী আর শিল্পগুণে বিমোহিত হবে, আর এটি যে বার্তা দিতে চায় তা সাথে করে নিয়ে ঘরে ফিরে যাবে। কাজেই, ক্ষেত্রভেদে একটি ভাস্কর্য হতে পারে একটি চলমান ইতিহাস, একটি জাতির অহংকার, গৌরব ও বীরত্বের জয়গাঁথা, একটি সমাজের কোনো স্মরণীয় মুহূর্তের প্রতিবিম্ব, একটি দেশের কোনো মহান নেতার স্মৃতিফলক। একটি ভাস্কর্য তার নান্দনিকতা ও দর্শনীয়তা গুণে জনসধারণ্যে বিশেষ বার্তা পৌঁছে দেওয়ার শক্তিশালী মাধ্যম হতে পারে। ভাস্কর্যগুলো যেমন নগরীর সৌন্দর্য বর্ধন করে ঠিক তেমনই তাদের ইতিহাস ও ঐতিহ্যের কথা, অহংকারের কথা মনে করিয়ে দেয়।
এবার একটু দেখা যাক, মুসলিম বিশ্বে ভাস্কর্যের ব্যাপৃতি কেমন? পৃথিবীর অনেক মুসলিম দেশেই প্রয়াত জাতীয় নেতা ও বিশিষ্ট ব্যক্তিদের ভাস্কর্য রয়েছে। এদের মধ্যে তুরস্কের কামাল আতাতুর্ক, পাকিস্তানের কায়েদে আজম মোহাম্মদ আলী জিন্নাহ, মিশরের জামাল আব্দুল নাসের, ইরাকের সাদ্দাম হোসেনের নাম বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য। ইরাকে মার্কিন অভিযানের পর সাদ্দাম হোসেনের ভাস্কর্যগুলো সরিয়ে ফেলা হয়। বিশিষ্ট ব্যক্তিদের মধ্যে রয়েছেন আল্লামা ইকবাল, শেখ সাদী, ফেরদৌসী, রুমী প্রমুখ। ইসলামিক রিপাবলিক অব ইরানে কবি ওমর খৈয়াম, মহাকবি ফেরদৌস, আল বেরুনি, জালাল উদ্দিন রুমি ও ইমাম খামেনীর ভাস্কর্য দেখতে পাওয়া যায়। আমরা যদি পাকিস্তানের দিকে তাকাই তাহলে দেখতে পাই যে, সেখানে পাকিস্তানের জাতির পিতা জিন্নাহ্ সহ নানা ভাস্কর্যে ঠাসা। আর ইসলামের সূতিকাগার সৌদি আরবেও অনেক ভাস্কর্য আছে। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের কলা ভবনের সামনে একটি ভাস্কর্য আছে যাকে আমরা অপরাজেয় বাংলা নামে চিনি ও জানি। এটি নির্মাণ করেন মুক্তিযোদ্ধা ভাস্কর সৈয়দ আব্দুল্লাহ খালিদ। অপরাজেয় বাংলা নামকরণটি করেছিলেন মুক্তিযোদ্ধা ও সাংবাদিক সালেহ চৌধুরী।
ইতিহাস বলে, ভাস্কর্য নিয়ে ভাঙা-গড়ার বিতর্ক তৈরি করাটা যতটা না ধর্ম বা নীতির জায়গা থেকে তৈরি করা হয়, তার চেয়ে বেশি থাকে নিজস্ব স্বার্থ হাসিলের ধান্দা৷ নানা পক্ষই এমন ধান্দা যুগ যুগ ধরে চালিয়ে আসছেন৷ ভাস্কর্য বিতর্কে ধর্মীয় অনুভূতির সাথে রাজনৈতিক আবেগের কোলাজ তৈরি করার অনেক উদাহরণ আমাদের দেশেও আছে। ২০০১ সালের মার্চ মাসে তালিবানদের হাতে বামিয়ামে বিশ্বের সবচেয়ে বড়ো বুদ্ধমূর্তির মাটির সাথে মিশিয়ে দেওয়া বা বাংলাদেশে ধর্মের সুড়সুড়ি দিয়ে জাতির জনকের ভাস্কর্য ভেঙে ফেলার হুমকি – কোনটিই সুস্থ গণতান্ত্রিক সংস্কৃতিকে মান্যতা দেয় না। বিপরীতমুখী ধ্বংসাত্মক উভয় দৃষ্টিভঙ্গীই দেশে অস্থিরতা তৈরি করে।
বাংলাদেশ ইসলামিক রাষ্ট্র না৷ বাংলাদেশের রাষ্ট্রধর্ম ইসলাম হলেও সংবিধান অনুসারে এটি ধর্মনিরপেক্ষ রাষ্ট্র। ধর্মনিরপেক্ষতা, বৈষম্য দূরীকরণ, মত প্রকাশের স্বাধীনতাসহ মুক্তিযুদ্ধের যে আকাঙ্খাগুলো ছিল তা বাস্তবায়ন করাই তো আসল লক্ষ্য হওয়া জরুরি। এগুলোর বাস্তবায়ন করার জন্য এই সমস্ত মৌলবাদীদের পথে নামতে দেখা যায় না। ঘুষ-দুর্নীতি-ধর্ষণ-বেকারত্ব-পরনিন্দা-পরচর্চাসহ যত অজাচার-অনাচার সমাজ ও রাষ্ট্রে রয়েছে, এর বিরুদ্ধে কখনও ধর্মের ধ্বজাধারীদের আন্দোলন করতে দেখা যায় না৷ সাধারণ মানুষের রুজি-রুটির প্রশ্নের উত্তর খোঁজার সময় ধর্মের ভেকধারীদের টিকিও দেখা যায় না। কারণ ধর্মের সূক্ষ্ম সুড়সুড়ি দিয়ে সেগুলোর বিরুদ্ধে মানুষকে ক্ষেপিয়ে তোলা সহজ নয়, অথচ এই বিষয়গুলোই মানুষদের বেঁচে থাকার রসদ। ধর্ম নিয়ে কিছুদিন পরপর বিতর্ক উসকে দেওয়া হয় কেবল নিজেদের ‘অন্য স্বার্থ’ হাসিলের জন্য। সাধারণ মানুষের চিন্তনে ধর্মের ঠুলি লাগিয়ে তাদের সরল সহজ ভাবাবেগকে সম্পদ করে কেবল বাংলাদেশেই নয়, ভারতবর্ষসহ আমাদের আশেপাশের নানা দেশেও সফলভাবে কাজে লাগাচ্ছেন ধর্মব্যবসায়ীরা৷ এখনও সময় আছে সচেতন ও সজাগ হওয়ার, না হলে বুড়িগঙ্গার জল কালো হয়ে যাবে।
দীপক সাহা ( প্রাবন্ধিক)পশ্চিমবঙ্গ
Leave a Reply