ড. মোহাম্মদ শামসুল আলম
হযরত মোহাম্মদ (সা.) এর দৌহিত্র ইমাম হাসান-হোসেনের নির্মম মৃত্যুর কারণে শোক ও শোকের নিদর্শন স্বরূপ তাজিয়াখানা বা শোকাগার নামক স্তম্ভটি স্থাপন করা হয়। মহররম উপলক্ষে শোভাযাত্রা করা শিয়া সম্প্রদায়ই সর্বপ্রথম প্রবর্তন করেন। ইরাকের শিয়াদের আদর্শেই এই উপমহাদেশে তার প্রবর্তন ও বিবর্তন ঘটে। ৬১ হিজরি সনের ১০ মহররম তারিখে ইমাম হোসেন কারবালার রণাঙ্গণে শহীদ হলে তাঁর নৃশংশ হত্যাকাণ্ড উপলক্ষে সমগ্র মুসলিম জগৎ শোকে-দুঃখে কাতর হয়ে মাতম বা বিলাপ করতে থাকে। ফলশ্রুতিতে মাতমের আবেদন থেকেই শোকচিহ্ন ধারণ করা ও বিলাপের রীতি প্রচলিত হয়ে আসছে। ইসলাম ধর্মভুক্ত মুসলমান শ্রেণির মধ্যে শিয়া সম্প্রদায় ইমাম হাসান ও হোসেনের বিষাদময় স্মৃতিচিহ্ন স্বরূপ প্রতি বছর আনুষ্ঠানিকভাবে মহররম উৎসব পালন করেন। শিয়া অনুসারীদের মতে ইমাম হোসেন বীর পুরুষ। তারা তাঁকে শহীদ হিসেবে জানেন। হোসেন হত্যার জন্য যারা মূলত দায়ী তাদের কার্যকলাপের নিন্দাবাদ না করার জন্য শিয়াগণ সমস্ত মুসলিম (সুন্নি) সমাজকে অবজ্ঞা করে থাকে। মহররম পর্বানুষ্ঠান পালনের জন্য নির্দিষ্ট একটি কক্ষ বা স্থান থাকে। এই নিদিষ্ট কক্ষকে ইমামবাড়া, তাজিয়াখানা বা আশুরাখানা নামে অভিহিত করা হয়।
গৃহস্থ শিয়াদের মধ্যে অবস্থা সম্পন্ন ও সচ্ছল হিসেবে যারা সমাজে সুপ্রতিষ্ঠিত তাদের বাড়ির অঙ্গনে তাজিয়াখানার জন্য একটি নির্দিষ্ট স্থান সংরক্ষিত থাকে। এই সংরক্ষিত স্থানটিতে অন্য কোনো কাজ করা হয় না। তাজিয়া শব্দটি আরবি ভাষা থেকে বাংলা ভাষায় অনুপ্রবেশ করেছে। বাংলা ভাষায় এই শব্দটির অনুপ্রবেশ ঘটেছে মোগল আমলে। তাজিয়া বলতে বোঝায় ইমাম হাসান ও হোসেনের মাযারের (কোনো কবরের উপরিভাগে নির্মিত গম্বুজ বিশিষ্ট ঘর মাজার নামে কথিত হয়) অনুরূপ আকৃতি বিশিষ্ট স্তম্ভ। অন্যভাবে বলা যায় হাসান-হোসেনের সমাধির প্রতিকৃতি তৈরি করে শিয়াগণ মহররম অনুষ্ঠানে তাজিয়াখানা স্থাপন করে যে শোভাযাত্রায় বের করে সেটিকে তাজিয়া মাতমা বলা হয়।
নওগাঁ জেলায় অসংখ্য তাজিয়া স্থাপনার নিদর্শন আজও অক্ষত রয়েছে। জেলার বিভিন্ন গ্রামে যেসব তাজিয়া স্থাপনার নিদর্শন আছে সেগুলোর তুলনায় বাঁকা গ্রামের অন্তর্গত মৃধাপাড়ার তাজিয়া দুটির গঠন-বৈশিষ্ট্য জেলার অপরাপর তাজিয়া থেকে সম্পূর্ণ পৃথক। এই স্থাপনাটি আত্রাই উপজেলার আহসানগঞ্জ রেলস্টেশন হতে পূর্ব-উত্তর কর্ণারে পাঁচ কিলোমিটার দূরত্বে অবস্থিত। আত্রাই-কালিগঞ্জ সড়কের বাঁকা গ্রামের মোড়ে নেমে এক কিলোমিটার দক্ষিণে মৃধাপাড়াটির অবস্থান। গ্রামটি আত্রাই উপজেলার দুই নম্বর ভোঁপাড়া ইউনিয়নের পাঁচ নম্বর ওয়ার্ডে অবস্থিত। আবার রানীনগর উপজেলার আবাদপুকুর বাজার থেকে পতিসর রোডে পৌঁছার পূর্বে পশ্চিমে আত্রাই উপজেলার দিকে যে রাস্তাটি অতিবাহিত হয়েছে সে রাস্তা দিয়ে এগিয়ে গেলেই হাতের বামে পড়ে বাঁকা গ্রামের মৃধাপাড়াটি। এই গ্রামটি জেলার অপরাপর গ্রামের তুলনায় যেমন ঐতিহ্যবাহী তেমনি প্রাচীন ও সমৃদ্ধ। এই মৃধাপাড়াতেই আছে দুটি তাজিয়া স্থাপনা। বাংলা ১২৯২ ও ১৩০৪ বঙ্গাব্দের ভয়াবহ ভূমিকম্পেও স্থাপনাটির কোনো ক্ষতিসাধন হয়নি। তবে কালের পরিক্রমায় এটির নিচের তলায় পূর্ব-পশ্চিম দিকের কারুকার্য ভেঙে গেছে। উত্তর-দক্ষিণ দিকে তেমন কোনো ক্ষতি সাধিত হয় নি। স্থাপনাটির উত্তর দিক হতে ফটো তুলতে পারলে প্রকৃত রূপ, আকার ও সৌন্দর্য প্রস্ফুটিত হয়ে ওঠে। এটির উচ্চতা ভূমি হতে প্রায় ৩৫’ ফিট। নিচের তলার পূর্ব ও পশ্চিম ধারের আয়তন প্রায় ১২’ ফিট এবং উত্তর-দক্ষিণ দিকের আয়তন ১০’ ফিট। ভিতরের ফুকারের আয়তন ৬’-৪” বিশিষ্ট।
তাজিয়া দুটি তিনতলা বিশিষ্ট। একটি তাজিয়ার অবস্থান পাড়ার মধ্যমস্থলে মৃধা পরিবারের বসতবাড়ির সাথে লাগোয়া। এটির নান্দনিক সৌন্দর্য সহজেই সর্বসাধারণে দৃষ্টি করে। স্থাপনাটির নির্মাণ শৈলীর কারুকার্য অতীতের নান্দনিকতা ও সভ্যতার নিদর্শনকে উপস্থাপিত করে। মসজিদের মিনারের মতো অবয়ব নিয়ে নির্মিত তাজিয়াটি মুসলিম সভ্যতার নিদর্শন হিসেবে স্থানীয় ইতিহাসের চিহ্ন নিয়ে মানুষের ঐতিহ্যের অতীতকে জানান দিয়েছে। আর অপরটি পাড়ার দক্ষিণাংশে উন্মুক্ত স্থানে অবস্থিত। তাজিয়ার গাত্রদেহে আরবি হরফে কালেমা তাইয়্যেবা ‘লাইলাহা ইল্লালাহু মোহাম্মাদুর রাসুলুল্লাহ’ কথাটি লেখা ছিল। এছাড়াও লেখা ছিল তাজিয়ার গায়ে আরবি লিপি। বর্তমানে এখন আর নেই, আরবি লেখাগুলো সম্পূর্ণ বিলিন হয়েছে। গ্রামের ৭৫ বছর বয়সী প্রবীণ শিক্ষক মীর্জা মো: আজহারুল ইসলাম জানান, তিনি ছোটোকাল থেকে দেখে এসেছেন ঐতিহ্যবাহী তাজিয়া স্থাপনার নিদর্শনাবলি।
এটির নির্মাণকাল প্রসঙ্গে যা জানা যায় তা এমন, মৃধাপাড়ার প্রয়াত ৯০ বছর বয়সী ব্যক্তি নকিমুল্যা মৃধা জানিয়েছেন-‘মাদারি মৃধার বাড়ির পূর্বদিকে পুকুর খনন করে পুকুরের উত্তর-পশ্চিম কোণে তাজিয়া ও একটি মসজিদ নির্মাণ করা হয়। নির্মাণকালীন সময়কালে ক্ষমতায় অধিষ্ঠিত ছিলেন বাংলার সুবাদার নবাব মুর্শিদকুলি খাঁ। তাজিয়া ও মসজিদ নির্মাণ করার পর নবাব সরকারের নিকট থেকে অনুগ্রহ লাভের জন্য দরখাস্ত করা হয়। দরখাস্তটি করেছিলেন মৃধাবংশের প্রয়াত মান্যবর ব্যক্তি মাদারী মৃধা। দরখাস্ত পাবার পর দরখাস্তের বিষয়াদি পর্যালোচনা করে দেখার পর নবাব সরকার সন্তুষ্ট হন এবং দশবিঘা জমি লাখেরাজ ও তিন বিঘা ধানিজমি দান করেন। নবাব সরকারের এমন অনুগ্রহটি প্রদত্ত সনদনামা হিসেবে স্বীকৃত ছিল।’ এই বংশের পূর্বপুরুষ মাহমুদ মৃধার প্রপিতামহ ছিলেন মাদারী মৃধা। মাদারী মৃধার প্রচেষ্টার কারণে সনদটি পাওয়া সম্ভব হয়েছিল। এই সনদনামাটি নকিমুল্যার জীবদ্দশায় অগ্নিকাণ্ডে পুড়ে ভস্ম হয়ে যায়। তাই এটির নির্মাণকাল বাংলার নবাব মুর্শিদকুলীর খাঁর সময়ে নির্মিত হয়েছে এমন কথা বলা যায়। নবাব মুর্শিদকুলি খাঁ ১৭১৭ হতে ১৭৪২ পর্যন্ত বাংলার সুবাদার ছিলেন। সেকারণে এটির নির্মাণকাল উক্ত সময়ের মধ্যে হয়েছে মর্মে ধরে নেয়া যুক্তিযুক্ত। তবে মাদরী মৃধা মনে করেন এটি ১৭১৭ খ্রিস্টাব্দের পূর্বেই নির্মিত হয়েছে।
ড. মোহাম্মদ শামসুল আলম
গবেষক, প্রাবন্ধিক, ইতিহাসজ্ঞ
সহযোগী অধ্যাপক ও বিভাগীয় প্রধান বাংলা বিভাগ, নওগাঁ সরকারি কলেজ, নওগাঁ
Leave a Reply