সোমবার, ১৪ Jul ২০২৫, ০২:৩৬ অপরাহ্ন

শিরোনাম :
কসবায় রাউৎহাট-হাজীপুর সংযুক্ত সড়ক বেহাল: দুর্ভোগে পাঁচ হাজার মানুষ কসবায় স্ত্রীকে উপর্যুপরি ছুরিকাঘাত করে স্বামীর আত্মহত্যা, স্ত্রীর অবস্থা আশংকাজনক কসবায় ফলদ বনজ ও ওষধি গাছের চারা বিতরণ একটি চাকরি বড্ড জরুরি কসবায় ৩৫ জন মৎস্য খামারি ও ২৩০০ কৃষক পেলেন কৃষি প্রণোদনা ৫ আগষ্ট ছাত্র-জনতা মানুষের অধিকার ফিরিয়ে দিযেছে- আতাউর রহমান সরকার বিশ্ববাঙালি সংসদের পর্যটন বিষয়ক আলোচনা ও সম্মাননা আয়োজন কক্সবাজারে ।। কসবায় ‘জুলাই যোদ্ধা’দের মাঝে স্বাস্থ্য কার্ড বিতরণ তরুণ প্রজন্ম ৫৪ বছরের শাসনামল আবার ফিরে আসুক সেটা চায়না -আতাউর কসবা উপজেলা সাংবাদিক ফোরাম (KUSF) এর ঈদ পুনর্মিলনী অনুষ্ঠিত

বেতাল ঢাক

দীপক সাহা
কলকাতা।।

বাঘারাম কালিন্দী। এক ডাকেই পুরুলিয়ার অযোধ্যা পাহাড়ের চূড়াকে অতিক্রম করে জেলার বাইরে তার নাম। বয়স আশি ছুঁই ছুঁই। শরীরে আগের মতো তাকত নেই। অনেক কষ্টে কাঁধে ঢাক ঝোলাতে পারে। পায়ে আর সেই জোর নেই। পাঁ কাঁপতে থাকে। বছর কয়েক আগেও ঘন্টার পর ঘন্টা এক নাগাড়ে দু’কাঠির জাদু দেখাত। দর্শকরা তার শিল্পকলায় মন্ত্রমুগ্ধের মতো হা করে থাকত।

এখনও ঢাকের স্পর্শ পেলেই বাঘারামের শরীর ও মনে একটা শিহরণ ওঠে। বাঁ হাতের কাঠির টোকা ঢাকে পড়লেই তার তখন অন্য মূর্তি। এই তো পাঁচ বছর আগেও দুই কাঠির সাহায্যে একসঙ্গে তিন-চারটে ঢাককে বশ মানিয়ে রাখত। কখনও জোড়া পায়ে শূন্যে লাফিয়ে, কখনও হাঁটুর উপর ভর করে ঘুরে ঘুরে, কখনও মাথার উপর ঢাককে রেখে অবিরাম বাজিয়ে চলেছে বাঘারাম। বাজাতে বাজাতে তার চোখমুখের চেহারা বদলে যেত। পাগলের মতো বাজিয়ে চলে। একটার পর একটা ঢাকের বোল। যেন রঙ্গমঞ্চে কোন এক জাদুকর তার ভেলকিবাজিতে দর্শকদের বিমোহিত করে রেখেছে। ঘন পাখির পালকে সুসজ্জিত ঢাকে বাঘারামের হাতের স্পর্শে প্রাণ সঞ্চারিত হয়। দুর্গা মায়ের সন্ধ্যারতির সময় মায়ের সামনে বাঘারামের মাথাভর্তি ঝাকড়া ঘন লম্বা চুল যখন ঢাকের তালে তালে আন্দোলিত হয় তখন পূজামণ্ডপে একটা অদ্ভুত রোমাঞ্চকর পরিবেশ সৃষ্টি হয়। মনে হয় কৈলাশ থেকে স্বয়ং নটরাজ পূজামণ্ডপে নেমে এসেছেন। একসঙ্গে সব ঢাক যেন মন্ত্রমুগ্ধের মতো কথা বলছে। বাঘারামকে ঘিরে চারিদিকে কালো মাথা গিজগিজ করছে। সবাই স্তম্ভিত। বাঘারামের ঢাক মানেই আলাদা আকর্ষণ।

পুরুলিয়া শহর থেকে প্রায় তিরিশ কিলোমিটার দূরে রয়েছে পাঁড়াদ্দা গ্রাম। বলরামপুর ব্লকের এই গ্রামটি ঢাকিগ্রাম বলে পরিচিত। কালিন্দীরা প্রায় সকলেই ঢাক শিল্পী। এই গ্রামেরই বাসিন্দা বাঘারাম কালিন্দী।

বাবার কাছে সেই ছোটবেলায় বাঘারামের ঢাকে হাতে খড়ি।ছোট্ট বাঘারাম ঢাক দেখলেই বাজানোর জন্য বায়না ধরত। যতক্ষণ পর্যন্ত না তার হাতে ঢাকের কাঠি দেওয়া হত ততক্ষণ সে কোন কথাই শুনত না। এত ছোট ছিল, ভারী ঢাক তার পক্ষে সামলানই অসম্ভব। কিন্তু বাল্য বয়সেই দুটি কাঠি নিয়ে অদ্ভুত অদ্ভুত ঢাকের বোল বাজাত। তখন থেকেই তার ঢাকের সঙ্গে সখ্যতা। ঢাক আর বাঘারাম একাত্মা। কৈশোর পেরিয়ে যৌবনে পা রাখতেই বাঘারামের বাদনশৈলী কাহিনি জেলা ছাড়িয়ে রাজ্যের বিভিন্ন জায়গায় ছড়িয়ে পড়ে। যৌবনে পাকানো গোঁফের তাগড়াই চেহারার হাড়িরামের হাতে ঢাক কথা বলতো।পুজোই হোক বা একেবারেই অফ সিজনে ঢাককে ছেড়ে কোনও দিন দূরে থাকেনি বাঘারাম। তাই অবহেলে পুলিশের চাকরি ছেড়েছে। বলরামপুরের গালা কারখানার মালিকের ডাকও ফিরিয়ে দিয়েছে। ঢাকই তার প্রাণ, ঢাকই তার ধ্যান, জ্ঞান ও ভালোবাসার ধন।

তার ঢাকে আকৃষ্ট হয়নি এমন লোক নেই। সেই কত বছর আগের থেকে পুজো মানেই যেন বাঘারাম কালিন্দী। দেবীর আগমন হতেই পাড়ি দিয়েছেন দূর দূরান্তে। কলকাতা ছাড়াও এই শিল্পীর ঢোল বেজেছে মুম্বই,বেঙ্গালুরু,রাঁচি সহ বহু শহরে। একটাই মাত্র মানুষ। অথচ ডাক এসেছে বহু জায়গা থেকে। একবার তার বঙ্গসম্মেলনে আমেরিকা যাওয়ার সৌভাগ্য হয়েছিল ।

এই প্রথম বাঘারাম দেখল এক অন্য পুজোর ছবি। এই প্রথম কলকাতা শহরের পুজোর বায়না নেই। বাঘারাম কালিন্দীর ঢাকের ডাক আসেনি জেলায় এর থেকে বড় বিস্ময় হতে পারে না। এবার সেটাই হয়েছে। করোনা আবহ আমূল পালটে দিয়েছে পুজোর চিত্র। নিজের পুরোনো দিনের স্মৃতিচারণ করতে করতে দূরের অযোধ্যা পাহাড়ের দিকে কখন যেন উদাস হয়ে তাকিয়ে থাকে বাঘারাম। চোখের জ্যোতি কমে গেছে অনেকটাই। তবু দূরের পাহাড় তাকে যেন ভরসা যোগায়।

এবছর শুধু মেঠো পথের দিকে তাকিয়ে আছে শিল্পী। নিজে এখন আর খুব একটা বাজায় না। দলের ছেলেরাই এখন যায় মণ্ডপে। এবার যেন সব ওলটপালট হয়ে গেছে। যেচে ফোন করলেও শুনতে হচ্ছে বিগ বাজেটের পুজোগুলো এবার পার করছে নমো নমো করে। বহু মণ্ডপে মাত্র দুজন ঢাকি দিয়ে পার করে দেওয়া হচ্ছে। বেশিরভাগ জায়গাতেই বলা হচ্ছে পুজো শুধু নিয়মরক্ষার। মন ভালো নেই বাঘারামের।বাড়ির দাওয়ায় বসে নাতির সঙ্গে পুরনো দিনের গল্প করছে। হতাশা যাতে গ্রাস না করে তার চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছে প্রবীণ হাঁড়িরাম। মাঝে মাঝেই উৎসবের পোশাক পরছে। ডেকে নিচ্ছে সতীর্থদের। অনেক কষ্টে ঢাক বাঁ কাঁধে তুলে নিয়ে কম্পমান পায়ে ভর করে ঢাকে কাঠির টোকা মারতে মারতে বলছে, ওরে তোরা প্রাণ ভরে বাজা। মায়ের আসার সময় হয়ে এল যে।

এই সংবাদটি শেয়ার করুনঃ

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *




raytahost-demo
© All rights reserved © 2019
ডিজাইন ও কারিগরি সহযোগিতায়: Jp Host BD