বুধবার, ১৩ নভেম্বর ২০২৪, ০৪:৪৫ পূর্বাহ্ন

ব্রাহ্মণবাড়িয়া জাদুঘর: একটি স্বপ্নের বাস্তবায়ন

ব্রাহ্মণবাড়িয়া জাদুঘর: একটি স্বপ্নের বাস্তবায়ন

এস এম শাহনূর

শীতের মাঝরাতে হঠাৎ পশমী কম্বলে মোড়ানো আদুরে ঘুম ভেঙ্গে গেল। বিড়াল ছানার মত চোঁখ মেলে দেখলাম তাঁর আগমন। তুমিতো রাতজাগা ভোরের পাখী ঘুমিয়েছ? এ কথা বলে টেবিল ল্যাম্পটি জ্বালিয়ে দিলো সে। মুহুর্তে আমার লেখার ঘরটি সোনালী আলোয় ভরে গেল। ‘আধো আলো,আধো ছায়া’ যেন জাদুঘরের সুনশান নির্বতা। আমার দিকে তাঁর তীক্ষ্ণ ও সুক্ষদৃষ্টি দেখে বললাম,এমন করে কী দেখছো? আমার স্ত্রী বললেন,”জাদুঘরের মানুষটিকে”। আরো বলল, “ইদানীং দেখছি লেখার ফাঁকে ব্রাহ্মণবাড়িয়া জাদুঘর নিয়েই সারাক্ষণ ভাব, লোকজনের কাছে জাদুঘরের জন্য এটাসেটা চাও। জাদুঘরের শেষ খবরাখবর কী ? ”

ব্রাহ্মণবাড়িয়ার স্বনামধন্য জেলা প্রশাসক জনাব হায়াত-উদ-দৌলা’ খাঁনের আন্তরিকতা ও অনুমোদনক্রমে শহরের দক্ষিণ মোড়াইলের এ গফুর রোডের পশ্চিম প্রান্তে (সহকারী কমিশনার সদর) সাবেক ভূমি অফিসটিকে ব্রাহ্মণবাড়িয়া জাদুঘরের স্থান হিসাবে নির্ধারণ করা হয়েছে। ৬৫ শতক জমির উপর প্রাথমিকভাবে ৫ কক্ষ বিশিষ্ট কাচারী অফিসটিকে জাদুঘরে রূপ দেওয়ার জন্য জেলা প্রশাসনের সার্বিক তত্বাবধানে জাদুঘর বিষয়ে বিশেষজ্ঞ টিমের দিকনির্দেশনায় ফার্নিশিং ও ডেকোরেশনের কাজ চলছে। ব্রাহ্মণবাড়িয়া জাদুঘরের স্বপ্নদ্রষ্টা শিক্ষার কারিগর, লেখক ও লোকজ সংস্কৃতির গবেষক জহিরুল ইসলাম স্বপনের অগ্রণী প্রচেষ্টায় কিছু শিল্প সংস্কৃতিমনা মানুষের সহযোগিতায় জাদুঘরের জন্য আহরিত হচ্ছে মুক্তিযুদ্ধ ও লোকজ ইতিহাস ঐতিহ্য নির্ভর নানান মূল্যবান উপকরণ। শো কেসে কিংবা ঘরের কোণে পড়ে থাকা মুক্তিযুদ্ধের নিদর্শন,লোকজ উপকরণ এবং ঐতিহাসিক মূল্য রয়েছে এরকম উপকরণ জাদুঘরে দান করে যে কেউ অবদান রাখতে পারবে।

“জাদুঘর” কথাটি আরবি “আজায়ব্ [ঘর/খানা]” শব্দটির সঙ্গে তুলনীয়। বাংলায় “জাদুঘর” কথাটির অর্থ হল, “যে গৃহে অদ্ভুত অদ্ভুত পদার্থসমূহের সংগ্রহ আছে এবং যা দেখিয়া মন্ত্রমুগ্ধবৎ হ’তে হয়।”
“জাদুঘর” শব্দের অর্থ এও হয়, “যে-ঘরে নানা অত্যাশ্চর্য জিনিস বা প্রাচীন জিনিস সংরক্ষিত থাকে।”
ব্রাহ্মণবাড়িয়া জাদুঘর এমনই এক জাদুঘরে রূপান্তরিত হবে বলে আমার বিশ্বাস।

ততক্ষণে একটি বালিশ কোলে নিয়ে আমার কাছাকাছি বসল সে। আমি বললাম।তুমিও তো ব্রাহ্মণবাড়িয়ারই মেয়ে, জাদুঘরের পরিবেশ ও গ্যালারিতে তুমি কী কী দেখতে চাও?
সে দুচোঁখ বন্ধ করে বলতে লাগলো,জাদুঘরে ঢুকার পথে থাকবে একটি চমৎকার টিকেট কাউন্টার। নিরাপত্তা চেকিং শেষে জাদুঘরের সুসজ্জিত গেট দিয়ে ভিতরে ঢুকেই অভিভূত হবে দর্শনার্থী। মূল ভবনের সামনে ফটোসেশনের জন্য সাজানো থাকবে মনোরম ফুলের বাগান ও ঝর্ণা। থাকবে একটি সামরিক ট্যাঙ্ক। সভা সেমিনার,নাটক ও সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানের জন্য একটি সুদৃশ্য মঞ্চ।

আমি তাঁর কথা শুনতে শুনতে আধো শুয়া থেকে উঠে বসলাম। ভাবছি সবই ঠিক আছে। কিন্তু সামরিক ট্যাঙ্ক?
বিজয়ের সমরসম্ভার ব্রাহ্মণবাড়িয়ায় বিধ্বস্ত ট্যাঙ্কটি এখন সামরিক জাদুঘরে। ১৯৮৩ সালের ১৩ই এপ্রিল কুমিল্লা সেনানিবাসে স্থানান্তরের আগ পর্যন্ত পাকিস্তানি বাহিনীর একটি বিধ্বস্ত ট্যাঙ্ক শহরের ফারুকি পার্কে শোভা পেত।যুদ্ধ চলাকালে বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের চূড়ান্ত পর্যায়ে ১৯৭১ সালের ডিসেম্বরে ব্রাহ্মণবাড়িয়ায় ট্যাঙ্কটি বিধ্বস্ত হয়।স্বাধীনতার পর ব্রাহ্মণবাড়িয়ার মুক্তিযোদ্ধারা ট্যাঙ্কটি শহরের ফারুকি পার্কে মুক্তিযুদ্ধের প্রতীক হিসেবে স্থাপন করেন । রাজধানী ঢাকার বিজয় সরণিতে সামরিক জাদুঘর প্রতিষ্ঠার পর মুক্তিযুদ্ধের স্মৃতিবিজড়িত পিটি-৭৬ মডেলের ট্যাঙ্কটি কুমিল্লা থেকে সেখানে স্থানান্তর করা হয়।বিজয়ের সমরসম্ভার ট্যাঙ্কটি যদি ফিরিয়ে আনা সম্ভব না হয়,সেটির আদলে একটি মডেল ট্যাঙ্ক তৈয়ার করে জাদুঘরের সামনে স্থাপন করা যেতে পারে।

আমার হাতে তাঁর এক হাত রেখে বলে চললো, “দর্শনার্থী প্রথম যে রুমে ঢুকবে সেখানে থাকবে বাংলাদেশের বিরাট এক মানচিত্র। মানচিত্রের পাশেই থাকবে ব্রাহ্মণবাড়িয়া জেলার মানচিত্র। এরপর মানচিত্র রুমের পর থেকে শুরু হবে গ্যালারি পরিদর্শন। একের পর এক গ্যালারিতে সাজানো বাংলাদেশের বিভিন্ন ফুল, ফল, পাখি, পশু, নৌকা, মাছ, গাছ, খাদ্যশস্য প্রভৃতির নমুনা দেখে চোখে যেন পুরো বাংলাদেশের প্রকৃতির একটি চিত্র ফুটে উঠবে।”

এরপর দেখবে বাংলাদেশের গৌরবময় ঘটনা ভাষা আন্দোলন ও মুক্তিযুদ্ধের বিভিন্ন স্মৃতিচিহ্ন। এই গ্যালারিতে ঢুকতেই চোঁখে পড়বে বঙ্গবন্ধুর ঐতিহাসিক ৭ই মার্চের ভাষণের আলোকচিত্র। উদ্বাস্তু হয়ে পড়া বাঙালিদের শরণার্থী হিসেবে কসবা আখাউড়া সীমান্ত পথে ভারতে যাত্রা, সেখানে আশ্রয়, জীবন যাপনের ঘটনাবলীর সকল স্মৃতি। ভাষা শহীদদের রক্তে ভেজা পোশাক, মুক্তিযোদ্ধাদের ব্যবহৃত অস্ত্রের ভাঙ্গা টুকরা, বোমা, নাম না জানা শহীদদের মাথার খুলি, তৎকালীন দৈনিক পত্রিকার পাতা। এত কিছু দেখে ভাষা আন্দোলন ও মুক্তিযুদ্ধ সম্পর্কে যে ধারণা পাওয়া যাবে তা বইয়ের পাতার বর্ণনার চেয়েও অনেক বেশি নির্মম ও সাহসিকতার মনে হবে।

একটি গ্যালারির পুরোটা জুড়ে সাজানো থাকবে ঘাঘুটিয়া পদ্ম বিলের প্রাকৃতিক দৃশ্যের নমুনা।তিতাস নদীর নৌকা বাইচের নমুনা। ব্রাহ্মবাড়িয়ার প্রতিটি জমিদার বাড়ির সারিসারি ছবি।দেখতে দেখতে মনে হবে দর্শক যেন সত্যিই সেখানে পৌঁছে গেছে।

এছাড়া অন্যান্য গ্যালারিতে সাজানো থাকবে এতদ অঞ্চলের মানুষের নিজ হাতে তৈরি পোশাক, মসলিন কাপড়,অলংকার ও গৃহস্থালী সামগ্রী। । আরও দেখবে মাটি, সিরামিক ও কাচের তৈরি জিনিস, জামদানি, নকশীকাঁথা, হাতপাখা, মোরগের লড়াই, কাকাইলে ও ঢেঁকিতে ধান ভানার দৃশ্য, বিপিন পালের পুতুল নাচের পুতুল ও স্থানীয়ভাবে তৈরী বিভিন্ন বাদ্যযন্ত্রের সংগ্রহ।

থাকবে ব্রিটিশ বিরোধী আন্দোলনের সূতিকাগার ব্রাহ্মণবাড়িয়া জেলার সকল স্বদেশী ও বিপ্লবীদের ছবি ও তাদের দুর্দান্ত কর্মকাণ্ডের প্রতিকৃতি।
প্রাচীনকালের মানুষদের ব্যবহৃত পালঙ্ক, পালকি, সিন্দুক, দরজা ও সিঁড়ির অংশ, হাতির দাঁতের তৈরি অলংকার, পাটি, শো-পিস, দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময় সিঙ্গারবিলে অবস্থানরত সেনাদের ব্যবহৃত তৈজসপত্র ইত্যাদি দেখতে দেখতে হারিয়ে যাবে সেই সময়ের বাংলায়। এসব জিনিসে খোদাই করা নিখুঁত কারুকাজ দেখে বুঝতে পারবে সেই কালের মানুষের রুচি ও শিল্পবোধও ছিল অনন্য।

আরো থাকবে দর্শনার্থীদের জন্য বিশ্রামকক্ষ, নামাজের কক্ষ, বিনামূল্যে নিরাপদ পানির ব্যবস্থা, পরিষ্কার-পরিচ্ছন্ন টয়লেট, শিশুদের জন্য খাবার ও টয়লেটের বিশেষ ব্যবস্থা প্রভৃতি।”

আমিও স্বপ্নদেখি, একাত্তরের স্মৃতিবিজড়িত সেই নিদর্শন সহ বাঙালির গৌরবের অনন্য সব স্মৃতির সম্ভারে সাজবে রাহ্মণবাড়িয়া জাদুঘর। আধুনিক স্থাপত্যশৈলীর নবনির্মিত সুদৃশ্য ভবন গড়ে উঠবে একদিন। তখন নতুন প্রজন্মকে লোকজ সংস্কৃতির ইতিহাস ঐতিহ্য ও মুক্তিযুদ্ধের নানা বিষয় জানাতে জাদুঘরে থাকবে ইন্টার অ্যাকটিভ স্পেস ও ওপেন এয়ার থিয়েটার। সেমিনার হল ও অডিটরিয়াম। তাতে নাটক, চলচ্চিত্র, প্রামাণ্যচিত্র ও অন্যান্য পারফর্মিং আর্ট প্রদর্শন করার ব্যবস্থা থাকবে।
মুক্তিযুদ্ধের গবেষণার জন্য লাইব্রেরি, রিসার্চ অ্যান্ড আর্কাইভের স্থানও রাখা হবে। স্বাধীনতা উৎসব,বিজয় উৎসব, বইমেলা,চিত্র প্রদর্শনী,বঙ্গবন্ধুর শাহাদৎ দিবস,বঙ্গবন্ধুর জন্ম দিবস,ব্রাহ্মণনাড়িয়া মুক্ত দিবস,শিক্ষক সম্মেলন, গণঅভ্যুত্থান দিবস,বিশ্ব মানবাধিকার দিবস,বিশ্ব জাদুঘর দিবস ইত্যাদি অনুষ্ঠানের আয়োজন হবে একদিন এখানেই।

লেখক: এস এম শাহনূর
কবি ও আঞ্চলিক ইতিহাস গবেষক

এই সংবাদটি শেয়ার করুনঃ

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *




raytahost-demo
© All rights reserved © 2019
ডিজাইন ও কারিগরি সহযোগিতায়: Jp Host BD