ড. মোহাম্মদ শামসুল আলম
গবেষক, প্রাবন্ধিক, ইতিহাসজ্ঞ
আত্রাই উপজেলার এক নম্বর সাহাগোলা ইউপির অধীন ভবানীপুর বাজারে এই জমিদার বাড়ির অবস্থান। আত্রাই ও ছোটো যমুনা নদীর সঙ্গমস্থলে অবস্থিত এই জমিদার বাড়িটি। এটির সম্মুখভাগ ছিল পূর্বমুখী। এই এস্টেটের ভূসম্পত্তি পরিমাণ ছিল প্রায় ২৪/২৫ শত বিঘা। জেলা সদর নওগাঁ থেকে প্রায় ২৫ কিলোমিটার দক্ষিণে এবং আত্রাই উপজেলা সদর থেকে প্রায় ৬ কিলোমিটার উত্তরে আত্রাই-নওগাঁ সড়কের ভবানীপুর বাজারে এলেই নজরে পড়ে পরিত্যক্ত এই রাজরাড়িটি। এখানে বসবাস করতেন বঙ্গজ শ্রেণির কায়স্থ জমিদার। এঁদের পূর্বপুরুষ ছিল শূরবংশীয় কায়স্থ। তাঁরা ভুলুয়ার রাজা লক্ষ্মণ মাণিক্যের বংশধর হিসেবে পরিচয় দিতেন। রাজা লক্ষ্মণ মাণিক্য ছিলেন দ্বাদশ ভৌমিকের এক ভৌমিক। স্থানটিতে বাস করতেন জমিদার গীর্জা শঙ্কর চৌধুরী। এই গীর্জা শঙ্করের নামে উপজেলার ভবানীপুর মৌজায় একটি হাইস্কুল স্থাপিত হয়। স্কুলটির নাম ভবানীপুর জি. এস. উচ্চ বিদ্যালয়। স্কুলটি প্রতিষ্ঠিত হয় ১৯১০ খ্রিষ্টাব্দে। জমিদার কর্তৃক বিদ্যালয়টি স্থাপিত। গীর্জাশঙ্কর চৌধুরীর ছেলের নাম প্রিয়শঙ্কর চৌধুরী। প্রিয়শঙ্কর চৌধুরীর পাঁচজন ছেলে সন্তান ছিল। প্রথম পুত্র প্রণবশঙ্কর চৌধুরী, দ্বিতীয় পুত্র প্রদ্যুৎশঙ্কর চৌধুরী, তৃতীয় পুত্র প্রতাপশঙ্কর চৌধুরী, চতুর্থ পুত্র প্রবীরশঙ্কর চৌধুরী, পঞ্চম পুত্র প্রশান্ত শঙ্কর চৌধুরী। এঁদের মধ্যে প্রতাপশঙ্কর চৌধুরী ওরফে বাবলু এই জমিদারিতে বাস করতেন। অপর চারপুত্র কলকাতায় গমন করেন। কলকাতায় গমনকারী চারজনের মধ্যে বর্তমানে দুজন জীবিত আছেন। আর এই ভানীপুরে বাস করতেন প্রতাপশঙ্কর চৌধুরী। স্থানীয় লোকজন প্রতাপশঙ্কর চৌধুরীকে বাবলু নামে ডাকতেন। তিনি সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ে শিক্ষকতা করতেন। ২০০৫ খ্রিস্টাব্দের ১৪ ফেব্রুয়ারি তিনি মৃত্যুবরণ করেন। প্রতাপশঙ্কর চৌধুরীর পুত্র সন্তান একজন। পুত্রের নাম অভিজিৎ চৌধুরী। বর্তমানে অভিজিৎ চৌধুরী জরাজীর্ণ ও ভগ্নপ্রায় এই জমিদার বাড়িতে বাস করছেন। অভিজিৎ চৌধুরীর দুটি ছেলে সন্তান। স্থানীয় লোকজন এ জমিদার বাড়িকে ‘বাবু’র বাড়ি নামে জানেন।
জমিদার বাড়ির মূলভবন দ্বিতল। চুনসুরকির গাঁথুনি দিয়ে তৈরিকৃত। তবে ঘরের ছাদ নির্মিত হয়েছে লোহার বরগা দিয়ে। দ্বিতল এ ভবনটিতে ৮টি কক্ষ রয়েছে। এর মধ্যে দ্বিতলে তিনটি ও নিচতলায় ৫টি কক্ষ বিদ্যমান। বর্তমানে জমিদার বাড়িতে তিনটি মন্দির রয়েছে। এগুলো হলো দেবী দুর্গা, গোপীনাথ ও বাসন্তী দেবীর মন্দির। জমিদার বাড়ির একটি ভবনে বর্তমানে এক নম্বর সাহাগোলা ইউনিয়ন পরিষদের কার্যালয় অবস্থিত। ইউপির কার্যালয় হিসেবে ব্যবহৃত ভবনটি একতলা বিশিষ্ট। জমিদার আমলে এই ভবনটি কাছারি বাড়ি হিসেবে ব্যবহৃত হতো। অপর ভবনে ২০১০ খ্রিস্টাব্দে একটি কে.জি স্কুল প্রতিষ্ঠা করা হয়। বর্তমান পরিচালিত কে.জি স্কুলের ভবনটি পূর্বে ছিল জমিদার বাড়ির বৈঠকখানা। এই ভবনটি একতলা বিশিষ্ট। বহু পুরাতন এ জরাজীর্ণ এই স্থাপনাটি জমিদারের ঐতিহ্য আজও ধারণ করে আছে। বিশাল অবয়বের এই জমিদার বাড়ির কিছু জায়গাজমিতে বর্তমানে হাট বসে। তাই জমিদার বাড়ির অনেকাংশ এখন হাট-বাজার হিসেবে ব্যবহৃত হয়। ভবনগুলো প্রায় ধ্বংসস্তুপে পরিণত হয়েছে। তবে নিদর্শনগুলো ইতিহাস ও ঐতিহ্যের স্মৃতিচিহ্ন ধারণ করে আছে।
ড. মোহাম্মদ শামসুল আলম
গবেষক, প্রাবন্ধিক, ইতিহাসজ্ঞ
সহযোগী অধ্যাপক ও বিভাগীয় প্রধান,
বাংলা বিভাগ, নওগাঁ সরকারি কলেজ, নওগাঁ
Leave a Reply