জবা চৌধুরী
আগরতলা, ত্রিপুরা।
সকাল ন’টা । দিনের সবচে’ ব্যস্ত সময় এটা বলাকা’র । কাজে যাবার আগে রুগ্না মা’কে চান করিয়ে, খাইয়ে — তবে তার নিজের তৈরী হওয়া । নিভা মাসি বাজারটা, রান্নাটা, করে দিয়ে যায় বলে মায়ের পাশে বসে তবুও একটু কথা বলার সময় মেলে বলাকার । সকালের ব্রেকফাস্ট আর রাতের খাবারটা মায়ের সাথে বসেই করে সে । সহজ ছকে বেঁধে নিয়েছে তার জীবনকে । সকালে নিউজপেপার পড়া হয়ে যেতেই ফোনে বন্ধুদের সাথে একটু ‘হাই’,’হ্যালো’ বলে নিজেকে তরতাজা করে নিয়েই শুরু হয় তার দৌড় । মায়ের সব খুঁটিনাটি খুশিগুলোর কথাও মনে রাখার চেষ্টা করে বলাকা । সে জানে গান খুব প্রিয় ছিলো মায়ের । যদিও এখন আর সেসব নিয়ে কথা বলেন না মোটেই । তবুও রোজ সকালে বাথরুমের দরজার পাশে পুরোনো ট্রানজিস্টারটা চালিয়ে দিয়ে তবেই সে মা’কে চানের ঘরে নিয়ে যায় ।
বাবার মৃত্যুর একটা দুঃখ তো ছিলোই । অসময়ে চলে যাওয়া । বলাকা তখন ক্লাস টুয়েলভের ফাইনালের জন্য তৈরী হচ্ছে। এমনি একদিন অফিস থেকে বাড়ি ফেরার পথে এক দুর্ঘটনায় —। তিনজনের পরিবারে তখন থেকে দু’জন । একটা শূন্যতাকে সাথী করে চলা । বাইরে পড়তে যাবার প্ল্যান ছিলো । কিন্তু মা’কে একা ফেলে যাওয়া হলো না। ক্লাস সেভেন থেকে বন্ধুত্ব শুভর সাথে বলাকার । বড় হবার সাথে সাথে ভালোবাসার সদর্প বিচরণ ছিলো ওই সম্পর্কে । অন্য কোনো স্টেট-এ দু’জনে গিয়ে একসাথে কলেজে পড়বে সেভাবেই ওরা ভেবে রেখেছিলো । হলো না । শুভ ভুল বুঝলো । ভাঙচুরে ভরে গেলো জীবনটা । লোক্যাল কলেজেই যেতে হলো বলাকাকে । কলেজের দিনগুলো চলছিলো ঠিকঠাক, কিন্তু তখন একদিন ছাদের সিঁড়ি থেকে গড়িয়ে পড়ে গিয়ে মায়ের স্পাইনাল কর্ডে চোট লাগে । সেই থেকে উনি শয্যাশায়ী ।
নিজেদের বাড়ির একটা অংশ ছোট্ট একটা পরিবারকে ভাড়া দিয়েছিলো ওরা । সেই ভাড়ার টাকা দিয়েই কোনোমতে মা-মেয়ের দু’জনের সংসার চলছিলো । বাবার জমানো টাকা যা ছিল বলাকার বিয়ের কথা ভেবে ওর মা সেই টাকাটায় হাত দিতে চান নি । কিন্তু যখন থেকে তিনি শয্যাশায়ী হলেন চিকিৎসার জন্য সেই টাকাটা ব্যবহার করতে হলো । টাকা জমাতে জীবন কেটে যায় কিন্তু খরচ করা যায় নিমেষে । দুটো সার্জারি, ডাক্তার দেখানো আর ওষুধের খরচ দিতেই বলাকা দেখলো ওর বাবার রাখা সঞ্চয়ের পাত্র হালকা হয়ে এসেছে । শুরু করলো চাকরির জন্য চেষ্টা । BSc পাশ করে কী ই বা চাকরি পাওয়া যায় আজকাল? বিভিন্ন জায়গায় দরখাস্ত পাঠিয়ে সে ক্লান্ত । বছর খানেক ধরে বাড়ির খুব কাছেই একটা কম্পিউটার ইনস্টিটিউট এ চাকরি নিয়েছে। সকাল দশটা থেকে বিকেল পাঁচটা। গোটা দশ-পনেরো ছাত্র-ছাত্রী । বেতনও যত্সামান্য । তবুও আপাতত বেঁচে থাকার সহায় ।
কলেজের পড়ার সাথে সাথে সফটওয়্যার ডেভেলপমেন্টের -এর একটা কোর্স করেছিল বলাকা। সেই সুবাদেই একটা ভালো চাকরির জন্য ইন্টারভিউ’র ডাক এসেছে ক’দিন হলো । এই ইন্টারভিউর ওপর ওর অনেক আশা । আর মাত্র ক’দিন পরই ইন্টারভিউ । দিন-রাত খেটে সব-রকম রিভিউ স্টাডি করে নিজেকে তৈরী করতে লাগলো বলাকা।
সেদিনটা ছিল সোমবার । বেলা এগারোটায় বলাকার ইন্টারভিউ । ট্রাফিক জ্যাম এর কথা ভেবে একটু আগে থাকতেই পৌঁছে গেছিলো বলাকা অফিসের দোতলায় । ওয়েটিংরুমে তখন জনা-চারেক চাকুরিপ্রার্থী, কখন ওয়ালে সেট করা স্পিকারে বাজবে ওদের নাম, সেই অপেক্ষায় বসে । ওয়েটিংরুম থেকে বেরিয়ে ডানদিকের দ্বিতীয় রুমটিতে ইন্টারভিউ নেওয়া হচ্ছিলো । বলাকা আগে থেকেই সব খবর নিয়ে রেখেছিলো । কোনো কাজে শেষ মিনিটে ছোটাছুটি ওর পছন্দ নয় ।
ঘড়ির কাঁটা এগারোটা ছুঁই ছুঁই , এমনি সময়ে স্পিকারে বেজে উঠলো বলাকার নাম । রুমে ঢুকে প্রাথমিক ফরম্যালিটি শেষ করে চেয়ারে বসতে গিয়ে হঠাৎ মিঃ মোহিত ব্যানার্জিকে আরও দু’জনের সাথে ইন্টারভিউ প্যানেলে দেখে চমকে উঠেছিল বলাকা। বছর চার’এক আগে শেষবারের মতো দেখেছিলো সে মোহিত ব্যানার্জিকে —ওর বাবার মৃত্যুর মাত্র কয়েকমাস আগে। এই চার বছরে হয়তো বলাকার চেহারায় পরিবর্তন এসেছে অনেক। তাই মোহিত ব্যানার্জি ওকে দেখে চিনতে পারেননি মোটেই। কিন্তু ইন্টারভিউ শুরু করার ঠিক আগে ওর ফাইলটার পাতা ওল্টাতেই ওর বাবার নামের আগে ‘Late’ কথাটি লেখা দেখে উনি হঠাৎ উঠে দাঁড়িয়ে পড়লেন। চোখে-মুখে ফুটে উঠলো দুঃখ মেশানো এক আকুলতা। বলাকা ঠিক বুঝে গেছিলো — মোহিত আঙ্কেল ঠিক চিনে ফেলেছেন ওকে।
বলাকার বাবা বিজন রায় আর মোহিত ব্যানার্জি – দু’জনে ছেলেবেলার বন্ধু। উচ্চ-মাধ্যমিক অব্দি একসাথে একই স্কুলে এঁদের পড়াশোনা। বড় হবার পথের প্রচুর ভালো-মন্দের সাক্ষী ছিলেন ওরা একে অন্যের। কলেজ এবং এর পরবর্তী দিনগুলো ওদের ভিন্ন শহরে কেটেছে বলে সেই যুগের সেসব দিনের স্বাভাবিক নিয়মে যোগাযোগটা শিথিল হতে হতে একসময় ছিন্ন- প্রায় হয়ে যায়। বছরে দু’বছরে একবার দেখা হতো। কিন্তু বন্ধুত্বের সেই উচ্ছ্বাসটা আর ছিল না। পরিণত জীবনে ভালো চাকরি দুই বন্ধুই করলেও, উচ্চাকাঙ্খী মোহিত ব্যানার্জি এগিয়ে যান অনেক দূর। উন্নতির হাত ধরে তিনি আজ এক মাল্টিন্যাশনাল কোম্পানীর CEO.
ইন্টারভিউ শেষ হলে অফিসের বিল্ডিং থেকে বেরিয়ে যাবার মেইন দরজায় নেপালী দারোয়ান বলাকার হাতে একটা নোট ধরিয়ে দিলো। ওতে লিখা, “বাইরে গিয়ে আমার জন্য অপেক্ষা করো — মোহিতকাকু।”
কয়েক মিনিটের মধ্যেই মোহিত ব্যানার্জি বাইরে এলেন। সাদা শার্টের ওপর নেভি-ব্লু রঙের স্যুট, সাথে হালকা লাল স্ট্রাইপের টাই। ষাটের কাছাকাছি বয়সের একটা আভিজাত্য তাঁর চেহারায়। বলাকার পাশে গিয়ে শুধু বললেন, “এসো”। বলেই হাঁটতে শুরু করলেন। কিছু না বলে বলাকা চলতে লাগলো ওনার পেছন পেছন। অফিসপাড়ার লাঞ্চ আওয়ারের ভিড় পেরিয়ে ওরা ঢুকলো একটি রেস্টুরেন্টে। এক কোণের একটা দু’জনের টেবিলে উনি বলাকাকে বসতে বলে নিজেও বসলেন। মোহিত ব্যানার্জির চোখ দুটো তখন কান্না-চাপা লাল।
সেদিনই সন্ধ্যার পর মোহিত ব্যানার্জি তাঁর স্ত্রীকে সাথে নিয়ে দেখা করে গেলেন বলাকার মায়ের সাথে । বলাকার মায়ের সাথে ওদের আগে থেকে পরিচয় থাকলেও সেভাবে মেলামেশা হয়নি কখনো । তাই একটা চাপা অনুভূতির বিচরণ অনুভব করতে পারছিলো বলাকা দু’তরফেরই । তবুও বাবার বন্ধু এসেছেন —সেটাই যেন একটা বড় পাওনা ।
মাস-খানেক পর একটা রেজিস্টার্ড মেইলে এপয়েন্টমেন্ট লেটার এলো । চাকরিটা হয়ে গেছে ! দৌড়ে গিয়ে বলাকা চিঠিটা মায়ের হাতে দিলো । আনন্দাশ্রুর বন্যা বয়ে গেলো মা-মেয়ের খুশি আর চোখের জলে ।
গোটা কয়েক ট্রেনিং শেষ করে চাকরিতে উন্নতি করতে বছর তিন’এক লেগে গেলো । ততদিনে সে মোহিত ব্যানার্জির একমাত্র ছেলের বৌ । নিভামাসি এখন ওর মায়ের সম্পূর্ণ দেখাশোনার দায়িত্ব নিয়ে ওর মায়ের সাথেই থাকে দিনরাত । অফিস থেকে ফেরার পথে মা’কে রোজই একবার দেখে যায় বলাকা।
মোহিত ব্যানার্জির বাড়িতে সকলের সে প্রিয় আজ । শশুরবাড়ি বলে কোনো ব্যাপার নেই l তার সুন্দর, মিষ্টি ব্যবহারে সকলের মন জয় করে ফেলেছে । দু’বাড়িতেই মেয়ের আদরে সে দাপিয়ে বেড়ায় । মাঝে মাঝেই বাবার কথা খুব মনে পড়ে বলাকার । তখন চোখ বন্ধ করে ওর মাথায় বাবার আশীর্বাদের হাতটি যেন আজও সে অনুভব করে।
Leave a Reply