নাহার আহমেদ।।
খৈ ফোটা জ্যোৎস্নার বিমুগ্ধতায়
সারাটা আকাশ আজ ঝলমলে,
কিন্তু মনের আকাশটাতে যেন
অমাবশ্যার বেষ্টনী দগ্ধতাকে কুরে
কুরে আরো উস্কে দিচ্ছে । যন্ত্রনার ধূপকাঠি জ্বেলে নিয়তির
নিষ্ঠুরতার থাবায় সব যেন কেমন
এলোমেলো হয়ে যাচ্ছে ।
জয়িতার বুকটা বারবার মোচড় দিয়ে উঠছে যন্ত্রনায়। পাশের রুমে
স্বপন পায়চারি করছে । সমস্ত
বাড়িটায় একটা থমথমে ভূতুরে পরিবেশ।
অসহ্য অন্ধকার যেন পুরো
বাড়িটাকে গিলে খাচ্ছে। বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক স্বপন শাহরিয়ার আমি,মানুষ গড়ার কারিগর। আজ নিজের কাছে যেন নিজেই
হেরে গেছি । অনবরত ফোন আসছে । শুধুমাত্র নিজেদের লোকজন ছাড়া কারো ফোন ই
রিসিভ করছি না ।সারাদিন
ধরে ঘনিষ্ট আত্মীয় স্বজনরা আসছে ।সান্তনা দিয়ে আমাকে
আর জয়িতাকে বোঝাচ্ছে । এই
যন্ত্রনার আগুনতো নিভবে না। একে নেভানো সম্ভবও না ।এক
বিষধর অজগরের হিংস্র ছোবলে
আমরা গোটা পরিবার আজ রক্তাক্ত , কলংকিত । জয়িতার
বুকফাটা কান্নায় সারাটা বাড়ি যেন ডুকরে ডুকরে উঠছে ।আমি
যেন বাকরুদ্ধ । চোখের জলগুলো
জমাট বেঁধে লজ্জা,ঘৃনা আর কষ্টে
আমাকে শুধু হুল ফোটাচ্ছে ।
,ভাগ্যিস মা আজ বেঁচে নেই ।আমি তার একমাত্র সন্তান।সাতরাজার ধন ।
আমার জীবনের এমন ট্রাজেডি মা হয়তো সইতে পারতো না ।
সকালে চায়ের কাপটা নিয়ে বেশ আরাম করে খাটের উপর বসি টিভির নিউজ দেখবে বলে দুএকটা চুমুক দেবার পরই খবর শুরু হলো হেড
লাইনটা দেখেই জয়িতা ! জয়িতা !বলে চিৎকার করে উঠি । চায়ের
কাপটা হাত থেকে পড়ে ভেঙে চুরমার হয়ে গেল । জয়িতা হন্তদন্ত
হয়ে ছুটে আসে নাস্তার টেবিল থেকে । কিছু বুঝে উঠতে পারে না
— দেখো ,দেখো নিউজটা দেখো
—কি ? কি ? কি দেখাচ্ছে ?
জয়িতা তোতলাতে থাকে
—আমাদের সর্বনাশ হয়ে গেছে !
সর্বনাশ !
—একি ! আমি কি ঠিক দেখছি । না ! না ! এ হতে পারে না স্বপন।
এ হতে পারে না ।আমরা ভুল
দেখছি ।ভুল !
চিৎকার করে আমাকে জড়িয়ে ধরে কান্নায় ভেঙে পড়ে জয়িতা ।স্বপনের গলা দিয়ে কোন স্বর বের হয়না
ঘন্টা খানিকের মধ্যে জয়িতার বড়
ভাইভাবী বড়আপা দুলাভাই, আমার চাচারা সবাই এসে হাজির
বাতাসেরও আগে যেন খবর ছড়িয়ে গেল সারা দেশে ।
বিয়ের দশবছর পর আমরা সন্তানের মুখ দেখেছিলাম ।কত স্বপ্নের কত আনন্দের বার্তা নিয়ে
আমাদের জীবনটাকে পূর্নতায় ভরে দিয়েছিল একমাত্র সন্তান দীপ্ত । মাই নামটা রেখেছিল। সেদিন যেন মনে হয়েছিল সারা পৃথিবীটা জ্যোৎস্নার আলোয় বুঝি ঝলমলিয়ে উঠেছিল ।পূর্নিমার ঐ
চাঁদটা যেন নেমে এসেছিল আমাদের ঘরে । কত কথা মনের কোণে বারবার উঁকি দিয়ে যাচ্ছে
মা তো আশাই ছেড়ে দিয়েছিল ,বংশের বাতি বোধহয় আর জ্বলবে
না । শেষের দিকেতো জয়িতাকে বেশ লাঞ্ছনা গঞ্জনা শুনতে হয়েছে
কখনো কখনো ছেলেকে একা পেলে মা দ্বিতীয় বিয়ের কথা ওবলতে ছাড়েনি । জয়িতা একদিন
সে কথা শুনেও ফেলেছিল ।কিন্তু নীরবতার মধ্যে দিয়ে সে যে যন্ত্রনা প্রকাশ করেছিল ,তা হজম করতে
আমাকে দ্বিগুন যন্ত্রনা পেতে হয়েছিল। মনে পড়ে আমি আর জয়িতা বেশ কবার আজমীর শরীফে ও
গিয়েছিলাম সন্তানের জন্য মানোত করে তা রক্ষা করার জন্য কোজাগরী স্বপ্নেরা হাজার নান্দনিকতা নিয়ে আমার জীবন-টাকে ভরিয়ে রেখেছিল । হাজার নক্ষত্রের ঝাড়বাতিতে আমাদের
সুখের ছোট্ট সংসারটা সাজানো ছিল ।এখন যেন এটা একটা অন্ধ
কূপ ।বুকটা ফেটে চৌচির হয়ে যাচ্ছে ।ড্রেসিং টেবিলের ড্রয়ারের উপরে দীপ্তর বাঁধানো ছবিটা যেন কত কথা বলতে চাইছে ।কত কথা মনে করিয়ে দিচ্ছে ।আমার দিকে চেয়ে যেন বলছে
— পাপা ! আমাকে তুমি মাফ করে দাও ।আমি তোমাদের এভাবে কষ্ট দিতে চাইনি ।তুমি বিশ্বাস করো পাপা ,আমি নিজেও জানিনা কেন
আমি এ পথে পা বাড়িয়েছি। ।
ওর পনেরো বছরের জন্মদিনের ছবি ।কি প্রজ্জলতায় ভরা চোখ
দুখানা।জয়িতার মতোই কাঁটা-কাঁটা চেহারা ।ধবধবে গায়ের রং ।যেন পূর্নিমার আলোয় ভরা একটা
নক্ষত্র ।আমাদের চোখের মনি
দুজনের কলিজার টুকরো এভাবে
পথভ্রষ্ট হলো আর আমরা একটুও
আভাস পেলাম না?একই বাড়ীতে
থেকে ? এর আগে যে আমার মৃত্যু
হওয়া দরকার ছিল ।কত যত্নে লালন করা সোনার ফসলটা বিনাশ হয়ে গেল বিষাক্ত থাবায়।
শকুনের লোলুপ দৃষ্টি কখন যে ওকে গ্রাস করলো ? কি বিভৎসতা
! সভ্যতার করিডোরে এ কোন
দানবের তান্ডবতা ।
S.S.C আর H.S.C তে ষ্টার মার্ক
পেয়ে দীপ্ত আমার বুয়েটে ভর্তি হলো ।দুচোখে একরাশ সোনালী
স্বপ্ন নিয়ে ।সেকেন্ড ইয়ারে উঠে হঠাৎ একদিন সন্ধ্যেবেলা আমার
ঘরে এসে বললো
— পাপা আমি B.B.A তে পড়তে
চাই ।
— কি বলছো কি ? মাথাটাথা কি
খারাপ হলো নাকি ?একটা বছর
নষ্ট হওয়া ! ছেলেখেলা নাকি ।কি
এমোন ঘটনা ঘটলো যে
ইন্জিনিয়ারিং পড়া ছেড়ে কমার্স এ
ভর্তি হবে ?
দীপ্ত বরাবরই শান্ত স্বভাবের।স্বভাব মতোই কোন উত্তর না দিয়ে
নিজের ঘরের দিকে পা বাড়ায় ।
রাতে জয়িতাকে কথাটা বলতেই
ওতো তেলে বেগুনে জ্বলে উঠে ,
ছেলের ঘরের দিকে যেতে চাইলে
আমিই বাঁধা দিলাম ।বললাম
— কোন লাভ হবে না
সেদিন যদি একটু গভীরে গিয়ে
কারণ খোঁজার চেষ্টা করতাম ।জানিনা কোন লাভ হতো কিনা ?
নিজেকে ধিক্কার দিতে ইচ্ছে হলো
সেদিন কেন আমাদের কারো টনক নড়ে উঠেনি ।আমার হৃদয়
আর্শিতে কেন কোনো অশুভ ছায়া
সেদিন পড়েনি ।আমার আত্মজা
সেদিন থেকেই কি অন্ধকারের মিছিলে যাত্রা শুরু করেছিল ?
গণিতের মানুষ হয়ে আমার এতো
বড় ভুল হলো সমীকরণে !
জানালায় চোখ পড়তেই দুচোখ
ঝাপ্ সা হয়ে উঠে ।বারান্দায় দীপ্তোর লাগানো গোলাপ গাছ
গুলোতে বেশ কতগুলো লাল লাল গোলাপ ফুটে আছে।আমার
সাথে বৃক্ষমেলায় গিয়ে গোলাপের
চারাগুলো কিনে লাগিয়েছিল ।যে
ছেলে ফুল ভালোবাসে সে কি করে
কাঁটা ভরা পথে পা বাড়ায় ? ওর
মনটাতো ফুলের মতোই ছিল ।এ
কোন আগুনের হাতছানিতে পুড়ে
ছারখার হলো ওর জীবনটা ।
সারাদিন বাড়িতে সাংবাদিক ,
মিডিয়ার লোকজন আর পুলিশের নানা রকম প্রশ্ন জিজ্ঞাসা
অতিষ্ট হয়ে যায় স্বপন ।জয়িতার
বড়ভাই ই এদেরকে সামাল দিয়েছে ।স্বপন জয়িতা কেউই ওদের সামনে যায়নি ।
গত দুদিন ধরে আকাশটা মেঘাচ্ছন্ন ছিল ।মাঝে মাঝে
টিপটিপানী বৃষ্টি।আজ আকাশ
টা বেশ পরিস্কার ।রোদও উঠেছে
মাসের শেষ ।ভাবছিলাম চা টা
খেয়ে একটু বাজারে যাবো,আগাম
কিছু সওদাপাতি করে আনি ।আমার দীপ্তের আবার খাসীর
মাংস খুব পছন্দ ।কিন্তু বৈরী
আবহাওয়াতে মনটা যেন কেমন
বিষন্ন হয়েছিল ।ঐ কালো মেঘই
বোধহয় আমার জন্য অশনি -সংকেত বয়ে এনেছে ।অবুঝ মন
টা তাই বুঝি ছট্ ফট্ করছিল ।
গত সপ্তাহে দীপ্ত বন্ধুদের
বান্দরবান ঘুরতে যাবে বলে বাড়ি
থেকে বের হয় ।ঈদের ছুটির পর
ভার্সিটি এখনো খোলেনি।ভাবলাম যাক কদিন ঘুরে আসুক নিয়তির কি নির্মম পরিহাস !জঙ্গী
দলে নাম লিখিয়ে আমাকে এভাবে ফাঁকি দিয়ে আমার বুকের
মানিকটা চলে গেল ?এর চেয়ে যদি সত্যি সত্যি বান্দরবানে গিয়ে
কোন দুর্ঘটনায় ওর মৃত্যু হতো তাহলেও বোধহয় মনটাকে বুঝ
দিতে পারতাম ।এতো যন্ত্রনা
পেতাম না ।ভাবতাম আল্লাহর
জিনিষ আল্লাহ নিয়ে গেছে ।এ
ভাবে গোটা পরিবারটাকে কলংকের বোঝা মাথায় বইতে
হতো না ।সন্ত্রাসী হামলায় পুলিশের গুলিতে তিনজঙ্গী নিহত
দীপ্ত শাহারিয়ার তাদের মধ্যে এক
জন ।নিউজের এই কথাগুলো বারবার কানে বাজতে থাকে ।
ইতিহাসের পাতায় আমার দীপ্ত
কেমন জায়গা করে নিয়েছে ।কলংকের কালিতে লেখা থাকবে
ওর নাম ।মানুষ ওকে বেওয়ারিশ
কুকুরের সাথে তুলনা করবে ।এই
যন্ত্রনার ভার কতদিন বইতে পারবো জানি না ।
ধীরে ধীরে সন্ধ্যা চোখ মেলে ।
পূর্নিমার চাঁদটা আকাশের পর্দা
সরিয়ে লাস্যময়ী রুপটাকে তুলে
ধরে ।টিভির পর্দায় ওর লুটিয়ে
পড়া দেহটা দেখে মনে হচ্ছে,
জ্যোৎস্নার আঁচল থেকে একটুকরো আলোর কনা যেন
মাটিতে পড়ে গেছে অসতর্কতায় ।
বেগম আখতারের সেই কালজয়ী
গজলের লাইন কটা মনে পড়লো
“জোছনা দিয়েছে আড়ি
আসেনা আমার বাড়ি
গলি দিয়ে চলে যায় “
মোবাইলটা বারবার বেজে উঠে ।
পাশের ঘর থেকে দুলাভাই এসে
ফোনটা উঠায়
-হ্যালো , থানা থেকে বলছি ।
আপনাদের ছেলের লাশটা
হস্তান্তরের জন্য থানাতে কাউকে
আসতে হবে ।
আমি আর জয়িতা কেউই রাজি
হলাম না ,লাশ আনতে ।বিবেকের কাছে প্রশ্ন করে হেরে গেছি । বিবেক সায় দেয়নি ।
রক্তাক্ত আঁচড়ে ক্ষতবিক্ষত সময়ের আঙিনা ।জ্যোৎস্নাও যেন
আজ মুখ ঢেকে আছে লজ্জার
নেকাবে ।
Leave a Reply