#পর্ব_৩
—————
সোনিয়া তাসনিম খান
থিম্পু শহরের আলোকজ্জ্বল ঝকঝকে রোদেলা সকালে আমাদের চার চাকার পঙ্খিরাজ এগিয়ে চলেছে বুদ্ধা ডর্ডেনমার দিকে। সকালের আলোতে কর্মব্যস্ত থিম্পু অন্যরকম ব্যস্ততার ভাললাগার আবেশের সাথে জেগে উঠেছে। ছোট্ট ছিমছাম রাজধানীর আঁকাবাঁকা চলার পথে লেগেছে ছুটে চলার দুরন্তপনা! আকাশ আজকেও বেশ পরিস্কার, কোন রকম কুঁয়াশার ধোঁয়াশাও নজরে পড়ল না, তবে ঠান্ডা সেই পর্যায়ের! যাকে বলে হাড়ে ঠকঠকানি শুরু হয়ে যাবার মত! এত ঠান্ডা! বাবা! কি করে যে লোকজন এখানে বসবাস করে আল্লাহই জানে!
দর্জি এর মাঝে গাড়ি কে তুলে এনেছে পাহাড়ি রাস্তার ঢালে।সে এক নয়নাভিরাম, নজর কাড়া, বিমুগ্ধতায় ভরা প্রকৃতির রূপ! একপাশে সবুজ শ্যামলতার কোমনীয়তা ভরা কঠিণ পাহাড়ের যৌবনোদ্দীপ্ত তারুণ্যের কাঠিণ্য তার সাথে বিশাল আকাশের অন্তহীন নীলিমার মিলেমিশে একাকার হয়ে যাবার আকর্ষণ! পাহাড়ের প্রতি বাঁকে বাঁকে রয়েছে যেন প্রকৃতির লুকায়িত সৌন্দর্যর দুষ্ট মিষ্টি লুকোচুরির খেলা। আরেক দিকে দৃষ্টি ফেললে ব্যস্ত থিম্পুর ছোট খাট একটা পোট্রেইট নজরে পড়ছে! গাড়ি যতই উপরে উঠছে থিম্পু কে ততই নগরায়নের নকশার মতই একটা ছোট মডেল বলে মনে হচ্ছে! এই বুদ্ধা পয়েন্ট শহরতলী থেকে ৬ কি. মি দূরত্বে অবস্থিত।
বুদ্ধা ডর্ডেনমা:
দর্জি নিপুণ হস্তে পাহাড়ি রাস্তার ঢাল অতিক্রম করে অবশেষে গন্তব্য স্থলে পৌঁছুল।নামতেই চক্ষুচড়ক গাছ। প্রধাণ ফটক অতিক্রম করে অতিকায় বুদ্ধের শান্ত, সৌম্য, স্নিগ্ধ চেহারার দেখা পাচ্ছিলাম এতখানি দূরত্বে থেকেও। আশেপাশে আরও অনেক ট্যুরিস্ট ভেকাইল নজরে এল। ইন্ডিয়ান, অ্যাংলো ইন্ডিয়ান, বাঙালি, ভিনদেশি সে নানা জাতির যেন এক ছোটখাট সমাগম ঘটেছে বুদ্ধ মূর্তির চরণ দ্বার প্রান্তে! মনটা কেমন যেন অন্য আবেশে ভরে গেল একদম! সুবিশাল গৌতম বুদ্ধের এই প্রতিকৃতিটি ১৭৭ ফুট ( প্রায় ১৭ তলার সমান)। বুদ্ধ পয়েন্টের ঠিক। সামনের বিস্মৃত যে অংশ তা জুড়ে রয়েছে একই ধরনের মোট সতরেটি মূর্তি! এসব গুলোই তৈরী করা হয়েছে ব্রোন্জ ধাতুর ধাতব ঢালাই ছাঁচে। মজার ব্যাপার! থিম্পু শহরের সব প্রান্ত থেকেই বুদ্ধা ডর্ডেনমার মূর্তিটি দৃষ্টিগোচর হয়। এটি শাক্যমুনি বুদ্ধের সবচাইতে বড় উপবিষ্ট মূর্তি! ( শাক্যমুনি বুদ্ধের অন্যতম নাম)। চতুর্থ রাজা জিগমে সিঙ্গে ওয়াংচুকের ৬০তম জন্মবার্ষিকী উপলক্ষ্যে ভূটানের রাজধানী থিম্পুর কুয়েসেল কোদরং পাহাড়ে এই বিশালাকার বৌদ্ধ মূর্তি প্রতিষ্ঠা করা হয়।জানি না সবার কাছে কেমন লাগবে তবে আমার কেন যেন মনে হল আমি কল্পলোকের কোন এক কল্পপাতালে ভেসে বেড়াচ্ছি। ভেবে দেখুন, সুনীল আকাশের একরাশ নীল আদিগন্ত সবুজ পর্বতশৃঙ্গ আর মাঝে সোনালী আলোচ্ছটায় বিচ্ছুরিত এই বুদ্ধ পয়েন্ট। তাতে নানা ভঙ্গিতে স্বর্ণালু বুদ্ধ প্রতিকৃতিগুলি রূপকথার ঐ নকশাগাঁথা দুমলাটের মাঝের রহস্যভরা পাতা গুলির চাইতেও যেন দ্বিগুণ রহস্য আর চমকের বাস্তব রূপের ডালি নিয়ে সবার সন্মুখে এক জাদুপুরীর জাদুর চাদর উন্মোচন করে ধরছিল। চারপাশে সব ক্যামেরা যুগল ক্লান্তিহীন ভাবে এর সৌন্দর্য কয়েদ করে চলছিল।
মতিহাং টাকিন প্রিজারভ:
কতক্ষণ পরে আমরা আবার আমাদের যাত্রা শুরু করি। এবার লক্ষ্য মতিহাং টাকিন প্রিজারভ এ। এটি থিম্পুর মতিহাং জেলাতে অবস্থিত।সেখানে যখন পৌঁছুল বেলা প্রায় এগারোটা গড়িয়েছে। টিকিট। নিলাম আমাদের অ্যাডাল্ট দুজনের বারশো ন্যু। বাচ্চাদের এন্ট্রি ফ্রি। ভুটান টাকিন সংরক্ষণ এলাকা হিসেবে পরিচিত। টাকিন এখানকার জাতীয় পশু।এই জায়গাটি ধরতে গেলে একটা ছোটখাট চিড়িয়াখানার মত, অবশ্য নামেমাত্র! তেমন কোনকিছু এখানে নজরে পড়ল না, কেবল দু একটা হরিণ আর টাকিন ছাড়া। কিছু লোকাল মানুষ জনকে দেখলাম গাছের কাঠ কেটে প্রসেসিং এর জন্য প্রস্তুত করতে।
প্রসঙ্গত উল্লেখ্য যে ভুটানের অর্থনীতির একটা ভাল অংশ এই গাছের কাঠ থেকে আসে। গাছের কাঠ, জলবিদ্যুৎ এরা প্রতিবেশি দেশ ভারতে রপ্তানী করে থাকে।এখানে আর বেশি সময় নষ্ট করি না চলে যাই সাংগয়াং ভিউ পয়েন্ট অভিমুখে।
সাংগয়াং/সিটি ভিউ পয়েন্ট:
সাংগয়াং ভিউ পয়েন্ট বা সিটি ভিউ পয়েন্ট যাই বলি না কেন, এর বিশেষত্ব হল এখানে দাঁড়িয়ে পুরো থিম্পু শহরকে পাখির চোখে দেখে নেয়া যাকে বলে, তেমন করে দেখে নেওয়া যায়। এটি সমতল থেকে ২৬৮৫ মিটার উঁচুতে অবস্থিত। চারপাশে অসংখ্য বর্ণিল প্রেয়ার ফ্ল্যাগ দেখতে পাই। এখানেও পর্যটকদের জটলা! এক ভদ্রলোককে অনুরোধ করে আমরা টোনাটুনি গুটি কয়েক স্ন্যাপ নিয়ে নেই পটাপট! আবার দৌড় শুরু। এবার ন্যাশনাল হেরিটেজ মিউজিয়াম!
ফোক হেরিটেজ মিউজিয়াম:
গাড়ি আমাদের হেলতে দুলতে এসে থামল একটি ছিমছাম সুন্দর ফটকের সামনে। পাশেই একটি অংশ জুড়ে কিছু ভূটানিজদের প্রতিকৃতি শোভা পাচ্ছে।দরজা দিয়ে এগুতেই সামনে ছোটখাট বিস্তীর্ণ মাঠ তাতে ছোট ছোট ভাবী ক্ষুদে তারকারা সম্ভবত কোন ধর্মীয় শপথ নিচ্ছিল, একটা আদুরে ভিডিও ক্লিপ মোবাইলের মেমোরিতে স্টক করি। হাতের বাঁয়ে ওদের হেরিটেজ জিনিষপত্রের শো রুম। ডানে ক্যাফেটেরিয়া আর ওপরের ছোট পাহাড় কোলে ওদের ফোক হেরিটেজ মিউজিয়াম। শোরুমে একটু ঢু মারলাম, কোন স্যুভেনিয়র কিনার আশায়, কিন্তু আকাশ ছোঁয়া দাম দস্তুর দেখে সভয়ে পিছিয়ে আসি। এরপর টিকিট। নিয়ে সোজা মিউজিয়ামের গহ্বরে প্রবেশ করি।এখানে ট্র্যাডিশনাল ভূটানিজ লাইফস্টাইল বা জীবেনযাত্রার একটা খন্ডচিত্র দেখতে পেলাম যেন। ওদের গ্রামীণ তৈজসপত্র, কৃষি উপকরণ, তাঁত শিল্পকর্ম ওদের নানা আচার প্রথা তথা আদি শিক্ষাব্যবস্থা সম্পর্কে একটা সম্যক ধারণা নিয়ে নেই। আমার কাছে মনে হয়েছে এটা বাচ্চাদের জন্য খুবই শিক্ষণীয় একটা স্থান। আমার বড় মেয়েটি ওর পাঠ্য বইয়ের ইতিহাস বইয়ের সাথের অবজেক্টগুলো দেখলাম খুব সুন্দর করে মিলিয়ে বলছিল। এখানে বলে রাখি এই জাদুঘরটি উদ্বোধন করা হয়েছিল রাণী মাতা অশি দর্জি ওয়াংমো ওয়াংচুকের সময়কালে, এটা উপস্থাপিত হয় ২০০১ সালে।
এরপর ছুটি ফের রিভারভ্যালী হোটেলের দিকে। তড়িঘড়ি করে লান্চ সারি এরপর যোহর নামাজ আদায় করে ফের ছুটি ইমিগ্রেশন অফিসের দিকে। বলে নেই আগামীকাল পুনাখা যাত্রা তার জন্য পারমিট আদায় করতে হবে। আমরা একটু দেরী করে ফেলেছিলাম। এই পারমিশনটা সকাল দশটার মাঝে নিতে পারলে ভাল হয়, লান্চ আওয়ার পার করে ফেলাতে পাসপোর্ট আর ফরম সাবমিট করে জনৈক শ্রীমতি আমাদের পাস পার্মিট কালেক্ট করার সময় দিলেন আগামীকাল সকাল ১১:০০। মনটাই খারাপ হয়ে গেল, পুনাখা যেতে আসতেই তো প্রায় তিন তিন ছ ঘন্টার মত সময় লেগে যাবে। বেলা এগারোটায় রওয়ানা দিলে তবে? আমাদের ড্রাইভার দর্জি অভয়ের হাসি হেসে বলে
: নো ওউরি! আই’ল ম্যানেজ! রিল্যাক্স! লেটস গো টু চেরি মনস্ট্রি।
দর্জির হাসিতে অভয় পাই। ফ্রেন্ডলি ভুটানিজ। আসলেই এ্যামেজিং!
চেরি মনেস্ট্রি:
গাড়ি ছুটল, ছুটে চলল থামল চেরি মনেস্ট্রিতে। চারপাশে শান্ত, সুশীল সুনশান শান্তিপূর্ণ নিরবতা। একে চেরি দর্জেন মনেস্ট্রি ও বলে। এটা বুদ্ধ মন্দির এটা থিম্পুর উত্তরাংশের উপত্যকার স্নিগ্ধ মমতার কোলে মমতার আঁচলে আশ্রিত। রাজধানী থেকে এর দূরত্ব প্রায় ১৫ কি.মি (৯.৩ মিটার)। এই মনেস্ট্রির ঠিক। সামনের সবুজ ঘাসের গালিচাবৃত প্রান্তরে দেখা পেলাম এদের জাতীয় বৃক্ষ সুবিশাল উদার বৃক্ষ হিমালায়ান সাইপ্রেস (Himalayan Cypress)। এই বৃক্ষটি ওদের ধর্মীয় মূল্যবোধের সাথে জানলাম ওতোপ্রোতভাবে সম্পৃক্ত।এটাকে বেশিরভাগ সময় ওদের ধর্মীয় কোন প্রতিকৃতি এবং ধর্মীয় উপাসনালয়গুলোর কাছাকাছি দেখতে পাওয়া যায়। মনেস্ট্রিতে প্রবেশ করে সামনেই পাই মস্ত বড় প্রেয়ার বেল। চট করে বেল ঘুরানোর ভঙ্গিমা সহ হয়ে গেল ক্লিক! ভেতরের প্রশস্ত আঙিনা অতিক্রম করে উডেন ব্রীজের সৌন্দর্য উপভোগ করলাম কতক্ষণ। গেরুয়া পোশাকধারী বৌদ্ধ ভিক্ষুকেরা হাসি মুখে মাথা নোয়ালে আমরাও অভিভাদন জানাতে পিছু পা হলাম না। বিকেলের পড়ন্ত রোদ গায়ে মেখে হাঁটছিলাম তো পেলাম এবার মেতোর দেখা। মেতোটা আবার কে? তাই ভাবছেন তো? উনি এক আদুরে বরফশুভ্র তুলতুলে ভেড়া! আদরের ডাক দিয়ে ওনার মালিক ওনাকে ডেকে যাচ্ছে। আমার বাচ্চা দুটো মেতোর পেছন পেছন কতক্ষণ হুটোপুটি করে চলল। মেতোর গায়ে আদর বুলিয়ে আবার বসি ফোরহুইলারে। এবার চল রয়েল বোটানিক্যাল গার্ডেন!
রয়েল বোটানিক্যাল গার্ডেন:
এর অবস্থান থিম্পু পারো রোডের সেবিথাং এ। এটা ছোটখাট সবুজ শ্যামল একটা প্রান্তর যেখানে নানা পাথুরে প্রতিকৃতি, স্বচ্ছ পানির লেক, আমার মনে হল যেন রূপকথার সেই ব্যাঙ রাজপুত্রর বল কুড়ানো সরোবরের ধার! নানা রকম জলের বর্ণিল ফোয়ারা, আন্চলিক সব লতা, গুল্ম, ফুল, অর্কিডে সজ্জিত এক ক্ষুদে “এলিস ইন দ্য ওয়ন্ডারল্যান্ড” এর সত্যিকারের রূপ! এখানকার বেশিরভাগ গাছপালার আরোহন করা হয়েছে ভূটানের দক্ষিণ ভাগ থেকে। বিস্তীর্ণ উপত্যকার ধূধূ প্রান্তর আর স্বর্ণোজ্জ্বল বুদ্ধ ডর্ডেনমার উত্তরাংশ থেকেও এর নয়নাভিরাম রূপ অবলোকন করা যায়।
ইত্যবসরে বাতাস বেশ জোড়েসোরে কাটতে আরাম্ভ করে দিয়েছিল। সন্ধ্যার আঁধারের সদ্য প্রস্ফুটিত আবেদনময়ী কিশোরীর কালো ওড়নার আড়ালে উঁকিঝুঁকি মারছে থিম্পুর সৌষ্ঠব কৌমার্য! গায়ে জ্যাকেট জড়িয়ে নেই শক্ত ভাবে। এবার…হ্যাঁ! এইবার যাব ক্লক টাওয়ারে।
ক্লক টাওয়ার স্কয়ার:
ক্লক টাওয়ার মূলত চতুর্মুখী ঘড়ির এক লম্বা টাওয়ার। এর চারপাশে অনেক ক্র্যাফট শপ যাতে নানা রকম শোপিস সুসজ্জিত। এদের লোভনীয় মনোহরী রূপ বেশ আকুতি ঢেলে পরিণয় আকুতি জানান দিলেও দামের দোর্দণ্ড প্রতাপ অনলে আমাদের কেনার ইচ্ছা আগুনে ঝাঁপিয়ে পড়া পতঙ্গের মতই আত্মাহুতি দিয়ে দেয়। অযথাই এদিক ওদিক করে শেষমেষ থিজা রেস্টুরেন্টের লোভনীয় মাশরুম ভেঁজ উইথ চীজ পিৎজা র অপূর্ব পাগলকারা স্বাদের পিসের কোণায় কামড় বসাতে লাগলাম।৪০০ ন্যু তে বেশ ভালই আট পিসের জায়ান্ট পিৎজা আর সাথে ১০০ ন্যু এর হেজেলনাট ধোঁয়া তোলা স্পেশাল চা। শেষে ৫০০ ন্যু য়ে মোট ভ্যাট গুণলাম কড়ায় গন্ডায় এক্কেবারে ১০০ ন্যু!(ভয় পাইছি)!
এরপর রাজসিক সন্ধ্যার ঝলমলে আলোতে সজ্জিত থিম্পুর রাস্তা ধরে যাই হোটেলের দিকে। পথে দেখে নিলাম আচারি গ্রাউন্ডে অব্যর্থ নিশানাধারীদের বাঁধভাঙা উচ্ছ্বাস, চিলড্রেনপার্কে দেব শিশুদের কোলাহল, খেলার গর্জনে প্রকম্পিত থিম্পু স্টেডিয়াম। হোটেলের দরজা খুলে কাঁপতে কাঁপতে রুম কী নিয়ে রুমে প্রবেশ করি কোনমতে। রুম হিটারের জোড় গলা তো ঠান্ডার কাছে পরাস্ত! ডিনার টাইম সেট করা ছিল আটটায়। ঠকঠক করে ডাইনিং হলে যেয়ে গরম ভাত, কুড়মুড়ে পাপড়,মাছ ভাজি, সবজির মাখনা, গ্রীণ স্যালাড সাথে রসে ডুবানো লালমোহন! সেইরকম স্বাদ! এরপর রুমের কম্বলের ওমে নিজেদের তাঁতালাম! অবশেষে সুখনিদ্রা আর এক ধাপ এগিয়ে গেলাম স্বপ্ন রাজ্য পুনাখার উদ্দেশ্যে।
(চলবে)…
Leave a Reply