পর্ব_১
—————
সোনিয়া তাসনিম খান
এবার শীত জমানোর জন্য কোথায় যাওয়া যায় ভাবতেই মনে এল দক্ষিণ এশিয়ার অন্যতম অনিন্দ্য প্রাকৃতিক সৌন্দর্যর লীলাভূমি ভূটানের নাম। দক্ষিণ এশিয়ায় হিমালয়ের কোলে বেড়ে ওঠা হাস্যজ্জ্বল ক্ষুদ্রতম দেশ ভুটান। জনসংখ্যা ধরতে গেলে প্রায় ছ লক্ষ। পৃথিবীর একমাত্র জিরো কার্বন ডাই অক্সাইড মুক্ত দেশ। সর্বাপরি পৃথিবীর একমাত্র দেশ যেখানে সংবিধানে ৬০ শতাংশ বনভূমি সংরক্ষণের কথা উল্লেখিত। নানা বৈশিষ্ট্য আর বিচিত্রতায় ভরপুর এই দেশটি ঘুরতে যাওয়ার জন্য এক কথায় খুবই আকর্ষণীয়। বলা বাহুল্য, এর আগে ভারতের বেশ কিছু জায়গা ঘুরে নিয়েছি বিধায় এবার একটু ভিন্ন পথে এগুব বলে ভাবছিলাম। তাই ব্যাস! যেই ভাবা সেই কাজ। আমাদের যাত্রার সময়কাল ঝটপটে ধার্য হল তেইশ ডিসেম্বর ২০১৯। সাহসিকতা দেখাতে হল বড়। এই ডিসেম্বর মাসে ভূটান! বাপ রে! বাপ! যাই হোক, এবার পালা প্রস্তুতির! এয়ার টিকিট করা হল ড্রুক এয়ারের রিচার্ণ সহ। ফিরতি সময় সাতাশ ডিসেম্বর। মানে দাঁড়াল আমাদের মোট সফর সময়কাল চারদিনের। কোথাও যাবার আগে আমার অভ্যাস জায়গাটা সম্পর্কে একটু ঘাঁটাঘাঁটি করা, এর পোস্টমর্টেমটা ভাল করে সম্পন্ন করে নেওয়া। তাহলে ঘুরতে একটু সুবিধা হয়। ইউ টিউ বের আর্শীবাদে এখন তো কোন কিছুই আর অসম্ভব নয় একেবারেই। হাঁতের আঙুলের অনুসন্ধানী ছোঁয়াতে গন্তব্য স্থলের বিভিন্ন জায়গাগুলো যেন বাস্তবেই ম্যাজিক বক্সের মত সামনে উন্মোচিত হতে লাগল। আর এতেই আবিষ্কার করে নিলাম আমাদের এবারকার ভ্রমণ সিরিজের প্রথম চমক ভূটানের একমাত্র বিমানবন্দর।
“পারো ইন্টারন্যাশনাল এয়ারপোর্ট”।এটি পৃথিবীর খুবই বিপদজনক একটি এয়ারপোর্ট। যাতে বিমান টেক অফ আর ল্যান্ডিং করার জন্য বৈমানিকদের বেশ বেগ পেতে হয়। এই এয়ারপোর্টের চারদিকে পাহাড়ের বেষ্ঠনী থাকাতে এখানে প্লেন অবতরণের সময় বিমানকে নানাভাবে বাঁক নিতে হয়। এমনকি কোন একসময় পঁয়তাল্লিশ ডিগ্রী এ্যাঙ্গেলে ঘুরতে হয়। জানলাম, গোটা পৃথিবীর মাঝে তালিকাভুক্ত মাত্র আট জন বৈমানিক এই বিমানবন্দরে বিমান পরিচালনা করতে পারেন। আর এটির জন্য তাদের স্পেশাল একটা প্রশিক্ষণ সম্পন্ন করতে হয়। তো…তাহলে বুঝাই যাচ্ছে, যাত্রার শুরুটাই হচ্ছে বেশ রোমান্চে ভরা। ইশ! উত্তেজনায় তখনই অস্থির লাগতে শুরু করল। মনে মনে কাউন্ট ডাউন শুরু করলাম বেশ জোড়েসোরে।
সময়কাল তেইশ ডিসেম্বর, ২০১৯। বসে আছি হযরত শাহজালাল ইন্টারন্যাশনাল এয়ারপোর্ট ঢাকাতে। ইমিগ্রেশন শেষ। জানালার বাইরে দিয়ে কাতার এয়ারলাইন্সের ইয়া বড় উইংস সূর্যের আলোতে জ্বলে জ্বল করে উঠছে। কিছুক্ষণ পর অগ্রসর হলাম ড্রুক এয়ারলাইন্সের দিকে। যতই এগুচ্ছিলাম, বুকের মাঝে হৃদস্পন্দন ঢকঢক করছিল। উৎসুক চোখ চারদিক চষে বেড়াচ্ছিল তখনই সামনে রয়াল ড্রুক। আসন যখন গ্রহণ করি তখন দুপুর বারোটা গড়িয়ে সময় বেশ এগিয়ে গেছে। ফ্লাইট টাইম ছিল দুপুর একটা পঁয়তাল্লিশ। সীটে বসে সীট বেল্ট বেঁধে নিচ্ছিলাম। বিমানের স্টাফরা সেইফটি ইন্সট্রাকশান দিয়ে যাচ্ছিল বেশ সুন্দর করে। অবশেষে ঘড়ির কাঁটা ঘুরল। নির্ধারিত সময়ে প্লেন রানওয়ে দিয়ে ছোটা শুরু করল বেশ ক্ষিপ্র গতিতে এবং একসময় উড়াল পঙ্খী মেলল ডানা আকাশে। নীচের দৃশ্যপট বদলে উড়ে চললাম মেঘ সম্রাজ্যের প্রাচীর ফুঁড়ে দূরদেশের সন্ধানে। চারপাশে নরম সাদা মেঘ বালিকাদের ছুটোছুটি যেন মন প্রাণ ভরে দিচ্ছিল। আমার আসন ছিল বাম উইন্ডো সাইডে। প্রায় তিরিশ মিনিটের ওপর হলো উড়ে চলেছি এরই মাঝে হাল্কা স্ন্যাকস আর রসালো ফ্রুট জুসের আপ্যায়নে সিক্ত হয়েছি বড়। উপরে মনিটরে দেখাচ্ছিল ঢাকা টু পারো ডিরেকশানগাঁথা। গন্তব্যের প্রায় কাছাকাছি আমরা ধরতে গেলে, এর মাঝে চোখ পড়ে আচমকা জানালা গলে ধবধবে সাদা বরফচূড়াতে! এ কি শিল্প! না কি কাব্য! কি মর্ত্যলোক! না কি স্বর্গলোক! এও কি সম্ভব? আমার দুচোখ যেন চরম ভাবে তার দৃষ্টি সার্থক করে নিল! এ যে হিমালয়! এত হাজার হাজার ফিট ওপরে আলাউদ্দিনের সেই জাদুর কার্পেটের মাঝে বসে যেন, আমি চরম রূপকথার কল্পরাজ্যেই সশরীরে প্রবেশ করে রহস্য রসের জাদুর ছড়ির ঘূর্ণির জাদু দেখতে পাচ্ছিলাম। দুধেল সাদা হিমালয় পরিবেষ্ঠিত শ্বেত শুভ্র মেঘের দলের ভিড়ে! এ যেন সেই স্বপ্নীল ক্ষণ যেথায় বাস্তব আর কল্পনা মিলে মিশে একাকার হয়ে যায়।
ভাবনার রাজ্যে ছেদ পড়ল আচমকা! আশেপাশের সবার চিৎকার কানে আসতে লাগল। নিজেকেও মনে হল শূণ্যে লাফিয়ে বেড়াচ্ছি। কি হচ্ছে কি? ওহ! আর কিছু না বই!আমরা ড্রুক এয়ারের সাথে সেই ভয়ংকর ল্যান্ডিং করার মুহুর্তের স্বাক্ষী হতে যাচ্ছি! বাবা রে! বিমান তো মনে হচ্ছে সুতো কাটা ঘুড়ির মত টাল খেতে শুরু করেছে। যত রকম দোয়া দরুদ জানি তা পড়তে শুরু করলাম। পুরো বিমানের যাত্রী রা ভয়ে সরগোল বাঁধিয়ে দিয়েছে। লাউড স্পীকারে আমাদের সেফটি বেল্ট বেঁধে রাখার নির্দেশনা দেওয়া হল! কতক্ষণ হুটোপুটির পর বিমান আবার শান্ত সমান্তরাল পথে চলতে শুরু করে। হ্যাঁ! ভয়ের সময় শেষ! ভয় লাগলেও সত্যি বলতে কি, থ্রিলিং অনুভূতিও কম বোধ হচ্ছিল না। যাকে বলে ভয় আর থ্রিলারের জায়ান্ট কম্বোপ্যাক। এবারে জানালা দিয়ে নীচে ভূটান সম্রাজ্যের সবুজ কার্পেট মোড়ানো পাহাড় শৃঙ্গ চোখে পড়ছে। বিমানে বেজে চলেছে ভূটানের সফট ট্র্যাডিশনাল মিউজিক এবং অল্প সময়ের মাঝেই আমাদের ড্রুক তার পদচিহ্ণ এঁকে নিল পাহাড় মাতার কোলে আশ্রিত অপরূপ অনিন্দ্য সুন্দর দেশ ভূটানের একমাত্র আন্তর্জাতিক বিমানবন্দর পারো’র বুকে।
এখানে জানিয়ে রাখি এই বিমানবন্দরই পারো শহর থেকে ৬ কিমি দূরত্বে স্বচ্ছ কলতানে মুখরিত পারো নদীর তীরে অবস্থিত। এর আশেপাশের পাহাড়ের উচ্চতা প্রায় ৫,৫০০ মিটার। এই বিমানবন্দরটির সমস্ত কার্যক্রম দিনের বেলার পরিস্কার আবহাওয়াতে পরিচালিত হয় এবং এটি সূর্যোদয় থেকে সূর্যাস্ত পর্যন্ত এখানকার কাজকর্ম চলতে থাকে।
বিমান থেকে যখন নামি তখন আবহাওয়া বেশ খেশমেজাজে ছিল। ঝকঝকে হাস্ব্যজ্জ্বল আত্মবিশ্বাসী তরুণের মতই প্রত্যয়ী মনোভাব জানান দিচ্ছিল প্রকৃতি! সেই সাথে হাঁড়কাঁপানো বাতাসের শাষানিটাও যেন আমাদের শরীরে জড়িয়ে থাকা শীত বস্ত্রের মোটা আবরণকে লজ্জায় ফেলে দিতে শুরু করল। সে যাই হোক, আমরা সব যাত্রীরা ছবি তোলায় ব্যস্ত হয়ে পড়লাম। বলাবাহুল্য এত সুন্দর আদুরে ছিমছাম ছোট সাজানো গোছানো এয়ারপোর্টটা বেশ দৃষ্টিনান্দনিকতায় পরিপূর্ণ। সামনেই ওদের রাজা রাণী আর আদুরে রাজকুমারের বিশাল ছবি। দারুণ সুখী রাজপরিবারের একটুকরা হাসিমাখা অভ্যর্ৎনার ছবি আমাদের সব যাত্রীদের যেন সাদরে উষ্ণ আমন্ত্রণ জানিয়ে নিল। বলাবাহুল্য ভূটানে যেহেতু এ্যারাইভাল ভিসা, তাই আমরা আর দেরী না করে ভেতরের দিকে এগুলাম। ঢুকতেই চমক! দেশীয় সংস্কৃতির খন্ড চিত্র কে যে এত সুন্দর করে উপস্থাপনার ঢং এ পরিবেশন করা যায় তা যদি কেউ এদের থেকে শিখে নেয়। কি ইমিগ্রেশন কাউন্টার, কি এয়ারপোর্টের সিলিং তো কি লাগেজ বেল্ট কাউন্টার! সব জায়গা গুলো ওরা ওদের ট্রাডেশিনাল কনসেপ্টের আদলে রাঙিয়ে নিয়েছে। দক্ষিণ এশিয়ার অনুন্নত এই ছোট জাতিটি যে সংস্কৃতির মানে কতটুকু সমৃদ্ধ তার আঁচ এই বিমানবন্দর থেকে যে কেউই সহজে নিতে পারবে। লাইনে দাঁড়িয়ে ইমিগ্রেশন কমপ্লিট করে জনৈক হাসিমাখা মুখের ইমিগ্রেশন অফিসার যখন খাঁটি বাংলায় অভিবাদন জানিয়ে বললেন “ধন্যবাদ” মনটা তখন আসলেই যেন অন্য আমেজে বিগলিত হয়ে গেল। এরপর বেড়িয়ে ট্যুরিস্ট সিম নিয়ে আমাদের ট্রাভেল এজেন্টের সাথে যোগাযোগ করা হলে জানলাম আমাদের জন্য নির্ধারিত গাড়ি আসবার পথে! আমরা অগত্যা অপেক্ষা করতে থাকি। নিদারুণ হিমেল ঠান্ডা বাতাস।তার সূঁচালো শীতের সূঁচ ফুটিয়ে চলছিল দেহে। ব্যাগ থেকে হাত দস্তানা বের করে হাতে পড়ে নেই। দানবীয় আওয়াজ তুলে ড্রুকের আরেকটি ফ্লাইট পাহাড়ের কড়া বেষ্ঠনীর বাঁধা পাড় করল। আশেপাশের লোকজনের ভিড় পাতলা হতে শুরু করল। একটা সময় আমরা চারজন রয়ে গেলাম একা।
: এক্সকিউজ মি, ইউ গাইজ ফ্রম?
প্রশ্ন কর্তার দিকে তাকাই জনৈক একজন সাদা চামড়ার লোক, বয়স প্রায় চল্লিশ বিয়াল্লিশ হবে। চোখে গগলস, গায়ে পাতলা জ্যাকেট। হাসিমুখে উত্তরের প্রতীক্ষায় রয়েছে
: বাংলাদেশ
: ওহ!
: ইউ আর ফ্রম?
পাল্টা প্রশ্ন ছুঁড়ি
: ওয়েল! ফ্রম ইউ. কে। অ্যাম এ লিটারেচর লেকচারার,হিয়ার! ওয়েটিং টু রিসিভ মাই মম। কামিং হিয়ার টু সেলিব্রেট ক্রিস্টমাস!
: গ্রেইট! সো…ইউ লিভ ইন পারো?
: ও, ইয়া।জাস্ট ফোরটিন কিমি এ্যাওয়ে ফ্রম হিয়ার।
: কুল! হ্যাভ ইউ এভারবিন টু বাংলাদেশ, স্যার?
: ওহ! নট ইয়েট! (হাসি)
: প্লিজ কাম। ইটস অলসো বিউটিফুল!
: শিওর ।
: ইওর গুড নেইম?
: ফ্রাংকো…ইউ কল মি ফ্রাংক।(হাসি)
: ও. কে।
গাড়ি এসে গেছে। নম্বর পি. বি ২৩৭৭। গাড়ির দরজা ঠেলে হাসিমুখে একজন ভূটানি ড্রাইভারকে এগিয়ে আসতে দেখা গেল। মালপত্র গাড়িতে গুছিয়ে নিয়ে উঠে বসলাম। গাড়ি স্টার্ট নিয়ে নেয়। ফ্রাংক হাত নেড়ে বিদায় জানালে আমরাও প্রতিত্তুরে হাত নাড়াই।ফ্রাংকের উঁচু গলা শোনা যায়
: বাই ..! হ্যাভ ফান…!
গাড়ির গতির বিপরীতে আড়ালে ঢেকে যায় ফ্রাংক। বিকেল গড়িয়ে যাচ্ছিল। রোদের নরম তীর্যক আলো চোখে মুখে পড়ছিল আমাদের। ব্যাগ থেকে বাদাম নিয়ে মুখে ভরে নেই। আমাদের ড্রাইভার হাসিমুখে বলল
: মাইসেল্ফ ঋষি দরজি। ওয়েলকাম টু ভুটান।
লোকটার চোখেমুখে হাসি খেলে বেড়াচ্ছিল যেন। মনেই হল না ওনার সাথে এই প্রথম আলাপ! আসলেই ঠিক। ভূটানের সৌন্দর্য শুধু মাত্র প্রকৃতিতেই নয়, এতে বসবাস করা কর্মঠ অতিথিপরায়ণ লোকগুলো তাতে এক আলাদা মাত্রা যোগ করে দিয়েছে। গাড়ি চলেছে পারো থেকে ভূটানের রাজধানী থিম্পুর পথে। পাহাড়ের মাঝে আঁকাবাঁকা রহস্যময় পথ। পাহাড় কোলে সুনীল নীলে প্লাবিত পারো নদীর অপরূপ শোভা আমাদের চোখের পলককে ফেলতে বাঁধা দিচ্ছিল। হৃদয় মন জুড়ে কেবল ধ্বনিত হচ্ছিল “ সুন্দর, অনেক সুন্দর! চমৎকার।”
(চলবে)…
Leave a Reply