তরুণ ইউসুফ
“জোছনা রাতে ‘সমুদ্র বিলাস’ এর সামনে জল তরঙ্গে ভেসে, সাঁতার কেটে প্রায়ই জলকেলি করতেন হুমায়ূন় আহমেদ আর তাঁর প্রেমিকা ।” পান চিবানো মুখে মনসুর চাচা মিষ্টি মিষ্টি হাসেন আর বলেন। তাঁর বলার ভঙ্গি খুবই সরল । পুলক জড়ানো চোখমুখ । অনুমান করতে কষ্ট হলো না যে ,এই প্রেমিক-প্রমিকা সম্পর্কে চাচা অনেক কিছুই জানেন । তাঁর অভিব্যক্তি সেরকমই । সেসব মনে রেখে এখনো অপার আনন্দে ডুবে আছেন তিনি । বিষয়টি খুব মজা দিতো তাঁকে । মজা না পেয়ে উপায় কী ? এমন সৌখিন সৃজনশীল মানুষ এ দুনিয়ায় ক’জন আর মেলে । কথা সাহিত্যের রাজপুত্র বলা হয় তাঁকে । শুধু তাই নয় । যেমন বড় মনের মানুষ তেমন প্রাণখোলা ছিলেন ঐ লোকটি । রোমান্টিকতার শেষ নেই । জীবনকে উপভোগ করার প্রায় সমস্ত কলাই তিনি রপ্ত করেছিলেন । আকাশের মতো উদার আর সমুদ্রের মতো বিশাল একটা হৃদয় ছিলো তাঁর। এ দু’য়ের সঙ্গে সখ্যতাও ছিলো অকল্পনীয় । সাথে ‘চাঁদনী পহর রাত ‘ হলে তো কথাই নেই ।
সমুদ্র পাড়ের ক্ষুদ্র ব্যবসায়ী হারিস । কচি ডাব আর মচমচে চিপস্ বিক্রেতা হারিসের দোকানের সামনে দাঁড়িয়ে কথা হচ্ছিল চাচার সাথে । চাচা কেবল চাচা নন – মনসুর মাস্টার । শিক্ষিত লোক । সেন্টমার্টিন (পূর্ব নাম নারিকেল জিঞ্জিরা ) হাইস্কুলে শিক্ষকতা করেছেন এগার বছর । পৈতৃক নিবাস মহেশখালী । বারো বছর আগে এসেছেন এ দ্বীপে। তাঁর আসার ইতিহাসটিও এক জাতীয় ‘হিজরত’ । সে বর্ণনায় যাবো না আমরা। গেলে, এ গল্প উপন্যাস হয়ে যাবে । চাচা এখন অবসরে । কাঁচা-পাকা চুল-দাড়ি । মাথায় টুপি । নূরানী চেহারা । তারও চেয়ে বড় কথা, বেজায় রশিক লোক তিনি । ভাষাজ্ঞানও বেশ । সাহিত্যিক- সাহিত্যিক ভাব ।৬ কিলোমিটার দীর্ঘ, ০.৫ কিলোমিটার প্রস্থ এই দ্বীপে বসবাসরত প্রায় দশ হাজার লোকই তাঁকে চেনে । আমরা ওনাকে ‘স্যার’ ডাকলেই ভালো হতো । তা-ই যুক্তিযুক্ত । কিন্তু আমাদের পরিচয় পর্বটি ছিলো ভিন্ন রকমের । তাই এ মুহূর্তে তিনি আমাদের বন্ধু।
থাক সে কথা । পাশে ফুসকাওয়ালার বেঞ্চে বসেছিলো সমুদ্র পাড়ের ক্যামেরাম্যান রায়হান । শ্যাম বর্ণের নবীন বয়সী রায়হানের খালি গা । গলায় ক্যামেরা ঝুলানো । রায়হানদের ক্যামেরাগুলো যেমন আটপৌরে, ওরাও ঠিক তেমনই । কিন্তু সবকিছু ইজি, ফটফটা । আটপৌরে হলেও লেন্সগুলো খুব পাওয়ারফুল । তারও চেয়ে মুন্সিয়ানা ওদের চোখে এবং হাতে । পত্যুৎপন্ন আই কিউ । যখন-তখন, যেমন-তেমন ভঙ্গিমায় সুন্দর ছবি তোলে । পর্যটকদের নানা পোজ শিখিয়ে দেয় । এমনকি আপটুডেট মেয়েদেরও । সেজন্যে মাঝে মাঝে ধমকও খায় । তো রায়হান বেঞ্চ থেকে উঠে এসে দাঁত কেলিয়ে এক গাল হাসি উপহার দিয়ে বলে ফেললো, স্যার থিরিকোয়াটার প্যান্ট পরে সাঁতার কাটতো । ম্যাডাম পরতো টি-শার্ট –খুব সুন্দর লাগতো ! আমরা অনেক ছবি তুলতাম স্যার আর ম্যাডামের । টাকাও দিতো অনেক । যা চাইতাম তাই । ম্যাডাম দুই-একবার বলতো – এ-ই, কম নে ! আমরা হাসতাম- কম নিতাম না । তাতেও মনে সুখ লাগতো !
রায়হানের কথা শেষ হয় না । আবারও বলে, ম্যাডাম স্টাইল কইরা কথা বলতো । মিষ্টি কন্ঠ । খুব ভাল্লাগতো আমাদের । তাকাইলে শরম লাগতো । ভয়ও লাগতো ইটটু – ইটটু । একবার সে-ই মজার একটা পোজ দিতে বলছিলাম । আর ধমক । বলে, ‘আমারে শিখান লাগতো না !’ তারপরে আর আওগাইয়া ছবি তুলতে যাই নাই । বললে তুলতাম, না বললে না ।
সৈকতের পাড় দিয়ে দিনভর বাই-সাইকেল ভাড়া দেয়া, খদ্দের না থাকলে নিজেরাই এদিক সেদিক চালিয়ে পর্যটকদের দৃষ্টি আকর্ষণ করা মনা, ছুরমান, সোনা মিয়াদের নিত্য দিনের ডিউটি । ওদের আরেকটি কাজ ছিলো, স্যার আর ম্যাডামের সেন্ডেল, গেঞ্জি, শার্ট পাহাড়া দেয়া । বিনিময়ে কাঁকড়া ভাজা, কোরাল ফ্রাই, বাদাম-চানাচুর না খেলে তিনি ক্ষেপে যেতেন । দল ধরে এগিয়ে এসে সানন্দে এসব তথ্য দিলো ওরা । বিশাল একটা খবর দিতে পারার আনন্দে প্রায় বিভোর মনা-সোনারা । কার আগে কে বলতে পারে এমন একটা ভাব । গল্পগুলো শুনে আমরাও কৌতুহলী হয়ে উঠলাম ।
জোছনা-রাতকে সামনে রেখে হেমন্তের মাঝামাঝি কক্সবাজার থেকে কর্ণফুলী জাহাজে এক দুপুরে আমরা পৌঁছেছিলাম সেন্টমার্টিন । প্রায় আড়াই’শ বছর আগে আরব বণিকরা আবিষ্কার করেছিলো এ দ্বীপ । তারাই এর নাম রেখেছিলো ‘জিঞ্জিরা’ । দ্বীপে প্রচুর নারিকেল বাগান থাকায় পরে দক্ষিণ বাংলার মানুষেরা নাম রাখে ‘নারিকেল জিঞ্জিরা’ । এরপর ইংরেজ সাধু ‘মার্টিন’ এর নামে নামকরণ করা হয় সেন্টমার্টিন । তারও পরে চট্টগ্রামের তৎকালীন জেলা প্রশাসক ‘মার্টিন’এর নামে এ দ্বীপের নাম রাখা হয় । দুটো নাম মিলে যাওয়ায় ব্যাপারটা হয়ে দাঁড়ায় বেশ মজার । যাহোক, আমরা রেস্ট হাউজে রেস্ট নিলাম না। ফ্রেস হয়েই পায়ে হেঁটে ‘সমুদ্র বিলাস’ দেখতে রওনা হলাম ।
দ্বীপের পশ্চিম প্রান্তে কিংবদন্তীর কথা সাহিত্যিক হুমায়ূন আহমেদ গড়ে তুলেছিলেন ‘সমুদ্র বিলাস’ নামে তাঁর এই সখের বাংলোটি । আমাদের রেস্ট হাউজ থেকে পাঁচ মিনিটের পথ । শিগগিরই পৌঁছে গেলাম । দেখলাম, শুনলাম, ছবি তুললাম । প্রত্যাশা ছিলো যেমন তেমনটি পেলাম না । ইতোপূর্বে নানা রূপ কিচ্ছা-কাহিনী শুনে কল্পনাবিলাসী হয়ে উঠেছিলাম আমরা । বর্তমান বাস্তবতার সাথে তা মেলানো গেলো না । ‘সমুদ্র বিলাস’ এর সেই সৌন্দর্য জৌলুস বা চারিত্র্য কোনটিই এখন আর নেই । খুব সাধারণ মানের একটি আবাসিক হোটেলে রূপ নিয়েছে হুমায়ূন আহমেদের সাধের সেই বাংলোটি । এখন পর্যটকদের প্রবেশাধিকারও রহিত করা হয়েছে । মনোহরা দর্শনীয় স্পট হলে টিকেট কেটেই আমরা ঢুকে পড়তাম অভ্যন্তরে । শুধোশুধি নিয়মের বেড়াজাল ডিঙিয়ে সময় ক্ষেপন জরুরী মনে হ’লো না ।
তবু উৎসুক মন নিয়ে সমুদ্রস্নানে নেমে পড়লাম । এ পর্বে যা যা ঘটেছে তা তা বলা যাবে না । কক্সবাজার সৈকতে মহুয়া সী-বাইকে উঠে সানগ্লাস বিসর্জন দিয়েছে সাগরের জলে । আর এখানে এসে ওর খালামনি হারিয়েছে এক টুকরো রঙিন বসন । এ পর্যন্ত বলা যায় । স্নানশেষে ড্রেসচেঞ্জ করে কফির কাপে ঝড় তুললাম আবারও ‘সমুদ্র বিলাস’ ও হুমায়ূন প্রসঙ্গ নিয়ে । এরপর সমুখের সৈকতে পায়চারি করতে থাকলাম দলবেঁধে । বাদাম,চিপস্ চিবুতে চিবুতে আলাপচারিতায় মেতে উঠলাম । এদিক সেদিক দেশের বিভিন্ন অঞ্চল থেকে আসা পর্যটকদের আনাগোনা। তবে বীচের মূল পজিশনটা ছিলো আমাদের দখলে। আজ আমাদের রাত জাগার প্রস্তুতি । কিছুটা ভয়-ভয়ও লাগছে । তবু নানাভাবে মনটাকে তৈরি করার চেষ্টা চলছে ।
পি ডি বি’র রেস্ট হাউজে উঠেছি আমরা । সেখানে ‘ তাতু বড়ুয়া ‘ আমাদের কেয়ার টেকার । কিশোরোত্তীর্ণ বয়সী সুদর্শন ছেলেটি এসেছে চকোরিয়া থেকে । নতুন পোস্টিং । নাদুসনুদুস স্বাস্থ্য । অত্যন্ত বিনয়ী । হুমায়ূন আহমেদের ঘেটুপুত্রের সাথে কিছুটা তুলনা করা যায় ওকে । আমাদের সিদ্ধান্তের কথা তাতুকে জানিয়ে দিলাম । জানিয়ে রাখলাম দু’জন বি জি বি জোয়ানকেও । দু’জনই টাঙ্গাইলের ছেলে । একই কম্পাউন্ডে বি জি বি’র অস্থায়ী ক্যাম্প । সে সুবাদে গেটেই তাদের সাথে সাক্ষাৎ । মাত্র দু-তিন মিনিটের পরিচয় । তবু আস্থা ও আন্তরিকতা দু’টোই মিলেছে এদের আচরণে। তাই সেলফোনে যোগাযোগটা সেরে নিলাম। এরিমধ্যে দেখা হয়ে গেলো মনসুর চাচার সাথে । ততক্ষণে সূর্য তার রশ্মি হারিয়ে জমাট রক্তের মতো টকটকে লালিম আভায় রূপ নিয়েছে । ওপারে জলের কিনারে ডুবু-ডুবু ক্লান্ত সুরুজ । শুরু হয়ে গেলো জোছনার গল্প ।
সন্ধ্যা ঘনিয়ে আসার আগেই পুব আকাশে চাঁদ হাসলো । আলো ছড়াতে লাগলো জোয়ারের জলে । ফণায়িত ঢেউয়ের জলকণাগুলো মুক্তোর দানার মতো আছড়ে পড়ছিলো বালুময় তীরে । অপূর্ব দৃশ্য । তখন আমি আর মৌসুমী যেন হুমায়ূন আর শাওন ! মৌসুমী মানে ওমর সানির মৌসুমী না । আমার ঘরের নায়িকা । ওপাশে কবি শাওন পান্থ আর সুবর্ণা বীচবেঞ্চে আধশোয়া যুগল ছায়া । সুবর্ণাও ফরিদীর সুবর্ণা নন । শাওন পান্থের ইয়ে । তবে আমাদের সিকোয়েন্সটি ছিলো অনেকটা সেরকমই । সেও এক রোমাঞ্চকর মুহূর্ত । সিনেম্যাটিক বললে ভুল হয় না । আজই প্রথম সমুদ্র পাড়ে জোছনা বিলাসে সময় কাটাবার সুযোগ আমাদের । এমনটি তো হতেই পারে !
অনেকক্ষণ ধরে বাচ্চাগুলো সী-বীচের এপাশ থেকে ওপাশে দৌড়ে বেড়াচ্ছে হরদম । মাঝে মাঝে হাঁপিয়ে উঠছে । তবু হুল্লোড় থামছে না। সাথে ওদের ছোট মামা সৌরভের পেরেশানির শেষ নেই । তা হোক, আপাতত সেটাই ভালো মনে হচ্ছে । কারণটা বুঝে নেয়া যাচ্ছে নিশ্চয়ই ।
‘সমুদ্র বিলাস’ এর সামনে আর কোন হোটেল, বাড়ি বা বাংলো নেই । বারান্দায় দাঁড়ালেই সীমাহীন সমুদ্র, ঢেউ আর প্রবাল পাথর । পাথরের পর পাথর । তারপরও পাথর । দিগন্তজোড়া আকাশ, বাতাস, পানি আর পানির মিতালী। অভাবনীয় এক অনুভূতি আবিষ্ট করছে আমাদের ।
মৌসুমী তো রীতিমতো নাচের মুদ্রা সহযোগে গাইতে শুরু করলো — মম চিত্তে, নিতি নৃত্যে / কে যে নাচে /তা-তা থৈ থৈ / তা-তা থৈ থৈ / তা-তা থৈ ••••••••
আমি মুগ্ধচিত্তে শুনছি, দেখছি আর ভাবছি — প্রকৃতিতে বসন্ত এলে, যে গান জানেনা সেও গুণগুণ করে । আর মৌসুমী তো শিল্পী । নাচ-গান দুটোতেই বেশ দখল। । সে কি আর এমন পরিবেশে নীরব থাকতে পারে ? তবে সবার আগে গান গাইবার কথা সুবর্ণার । কারণ,গান গাওয়া ওর নেশাও, পেশাও । এ সময়ের এক সাড়া জাগানো কন্ঠশিল্পী ও । যেমন আবেদনময়ী তেমন মন ছুঁয়ে যাওয়া কন্ঠ । ভাবতে ভাবতেই সুরের ইন্দ্রজাল ছড়িয়ে গেয়ে উঠলো সুবর্ণা — ঐ ঝিনুক ফোটা সাগর বেলায় আমার ইচ্ছে করে / আমি মন ভেজাবো ঢেউয়ের মেলায় / তোমার হাতটি ধরে ••••••••
ব্যাপারটা কাকতালীয় মনে হলেও হতে পারে । যা ঘটলো তা সত্যি । ।
রাত যতো গভীর হচ্ছে, ততো আলো ছড়াচ্ছে চাঁদ । সাথে আকাশভরা তারা । এখন আর চাঁদের আলো চুঁইয়ে চুঁইয়ে পড়ছে না । একেবারে জোছনাময় আকাশ থেকে জগতের বিধানকর্তা ঢেলে দিচ্ছেন মর্তব্যাপী । আমাদের চোখে-মুখে, জলে-পাথরে, কেয়া বনের পাতায় পাতায় জোছনার লুটোপুটি । এ মুহূর্তে আমারও গাইতে ইচ্ছে করছে । গাইবার চেষ্টাও করলাম – “চাঁদের হাসি বাঁধ ভেঙেছে / উছলে পড়ে আলো ।” দু’পাশে হাসির রোল পড়ে গেলেও আমি ছিলাম নির্বিকার ।
আমাদের বাচ্চাগুলো অর্থাৎ শৈলী, অহনা, মহুয়া,মূর্ছনা ওদের ছোট মামাকে নিয়ে মিশন শেষ করে কেয়াবন পাশ থেকে
ইতোমধ্যে আমাদের সাথে যোগ দিয়েছে ।
উৎপাতও শুরু করেছে রেস্ট হাউজে যেতে । বিশেষ করে কুটিবাবু মূর্ছনা । অগত্যা আমরাও আপাতত জোছনাময় তারাভরা রাত আর সমুদ্র বিলাস পর্বের ইতিরেখা টানলাম ।
তাই বলে গল্পটি এখানেই শেষ নয়। আর একটি ছোট্ট পর্ব আছে, সেটি বলে শেষ করবো । তার আগে ছেঁড়া দ্বীপের টুকরো গল্পটা এক টানে শেষ করে দেই । পরের দিনের ঘটনা । দুপুর বারোটা । সেন্টমার্টিন জাহাজ ঘাট থেকে মাত্র ত্রিশ মিনিটে আমাদের সী-বোট পৌঁছে গেলো ছেঁড়া দ্বীপে । এবার আসল প্রবাল দ্বীপের সন্ধ্যান মিললো । সবাইকে রেখে সবার আগে আমি সেই মৌসুমী পাথরে দাঁড়িয়ে ক্যামেরাম্যানের দৃষ্টি আকর্ষণ করলাম । । ‘ অন্তরে অন্তরে ‘সিনেমার শুটিংয়ে নায়িকা মৌসুমী এখানে দাঁড়িয়ে দু’হাত নাড়িয়ে এঁকে- বেঁকে গান করেছিলো নায়ক সালমান শাহ’র সাথে । লাফালাফিও করেছিলো টুকটাক । সেই থেকে এর নাম ‘মৌসুমী পাথর’ । কী ভাগ্য মৌসুমীর ! এক গানেই সমুদ্র জয়, দুই মিনিটেই ইতিহাস । আমিও ফুরফুরে মেজাজেই ছিলাম । কিন্তু পরক্ষণেই মনে হলো, আমি তো নায়িকা না । তাই আমার মৌসুমীকে ডেকে বললাম, তুমি না এলে ব্যাপারটা কেমন খাপছাড়া লাগে । এসো, আমরাও একটা ইতিহাস গড়ি ! মৌসুমী হাসির সাথে বিরক্তি মিশিয়ে বললো, লাগুক – আমি সিনেমা করতে পারবো না ! তোমার শখ হলে আরও কিছুক্ষণ দাঁড়িয়ে থাকো ! দ্যাখো, মৌসুমীর পায়ের ছাপ লেগে আছে কিনা !” আমি হাসবো না কাঁদবো, বুঝে উঠতে পারছিলাম না। অতএব বলে রাখার প্রয়োজন নেই যে, আমি সেদিনও সালমান শাহ হতে পারিনি !
কেয়া বনের আসল সৌন্দর্যটা ছেঁড়া দ্বীপের দারুচিনি বনের ভেতর । রূপসী বাংলার কবি এই দারুচিনি দ্বীপের কথাই লিখেছিলেন তাঁর ‘ বনলা সেন ‘ কবিতায় । জল-পাথর খেলা শেষ করে আমরা হুড়মুড়িয়ে ঢুকে পড়লাম সেই সবুজ ঘাসের দেশে । বনের মাঝখানের ফাঁকা জায়গায় শুয়ে, বসে, দাঁড়িয়ে, হেঁটে ঘ্যাটাঘ্যাট শ’খানেক ফটো ক্লিক করে, ঝটিকা বেগে ওপাশের সৈকত, বেলাভূমি আর সমুদ্রের শেষ সীমার দিকে কয়েক দফা চোখ ছেড়ে দিয়ে যুদ্ধ ফেরত সৈনিকদের মতো আবার দলবেঁধে বোটের দিকে পা বাড়ালাম ।
সাড়ে তিনটায় ফিরতি জাহাজ । হাতে সময় কম । পেছনে তাকাবার সময় নেই । না তাকিয়েও পারা গেলো না । মামা-ভাগ্নিরা কুচি পাথর কুড়িয়ে এরিমধ্যে তিনটি কোকাকোলার খালি বোতল ভরে ফেলেছে । ঝিনুক কুড়িয়ে রাখছে সেই মৌসুমী ক্যাপে । আবার মৌসুমীর নাম এসে গেলো । আসুক – যা থাকে ভাগ্যে ! অবশ্য অনেকে এ ক্যাপকে ‘ভিক্টোরিয়া ক্যাপ’ও বলে । রাণী ভিক্টোরিয়ার ক্যাপগুলোও এই মডেলের । সাদা ক্যাপে লাল গোলাপের ছাপ । দু’পাশে হলুদ-বেগুনী ফুলেল ডালপালা । এমন একটা ক্যাপ নায়িকা মৌসুমী মাঝে মাঝে পরে । কেউ কেউ এর নাম রেখেছে ‘সেলিব্রিটি হ্যাট’ ! তো মৌসুমী প্রসঙ্গ আসাতে আবার বুকটা ধক্ করে উঠলো । কিছু না বুঝে দিলাম ঝাঁপ । মনে হলো, ভুল করিনি । টলটলে স্বচ্ছ পানি । অনেক দূর পর্যন্ত বালি-পাথরসহ দরিয়ার তলদেশ দেখা যায় । কয়েক মিনিট সাঁতার কাটলাম । গোটা পাঁচ-ছয় ডুব দিলাম । বেশ মজা । আরও মজা হতো সবাই মিলে ঝাঁপাঝাঁপি করতে পারলে । সে সময় হলো না । ওরা পেছনে পড়াতে সময়টা একাই কাজে লাগালাম ।
। যদিও আমার নায়িকা তখন আমার সাথেই । হাতে হাত রেখে, পাথর ডিঙিয়ে অনেক কষ্টে বোটের কাছে এসে পৌঁছেছি আমরা । নামতে চেয়েও নামলো না মৌসুমী । আবারও একটা গানের কলি মনে পড়ে গেলো — “আসি-আসি বলে জোছনা ফাঁকি দিয়েছে ।”সাথে মনে পড়ে গেলো বালক বেলার আরেকটি খন্ড স্মৃতি । তখন আমরা গাঁয়ে বাস করি । আমাদের এক বড় বোন ছিলো – নাম জোসনা । জোৎস্না’র অপভ্রংশ । এ নামেই ( জোসনা ) ডাকতো গাঁয়ের লোক । অপূর্ব সুন্দরী ছিলো বোনটি । চঞ্চলা হরিণীর মতো ছিলো তাঁর চলাফেরা । আশপাশের দু’চার গাঁয়ে তাঁর রূপের প্রশংসা যেমন ছিলো, রূপের পাগলও কম ছিলো না । কারো কারো ভেবে নেয়া অস্বাভাবিক নয় যে, আমিও ছিলাম সে দলেরই একজন । কিন্তু মনে রাখতে হবে, তাঁর কথা লিখতে আমি চন্দ্রবিন্দু ব্যবহার করেছি ।
এবার আমরা বোটে । জাহাজ ঘাটে ফিরলাম দুপুর আড়াইটায় । সবকিছু আগে থেকেই গোছগাছ করা । চল্লিশ মিনিটে রেস্ট হাউজ ছেড়ে কর্ণফুলী জাহাজে সেই কেবিনে আশ্রয় নেয়া সম্ভব হলো । দুদিকে ঢেউ তুলে দরিয়া নগর কক্সবাজারের দিকে এগিয়ে চললো কর্ণফুলী । গুটি কয়েক বুড়োবুড়ি,রোগী আর অলস গোছের লোক বাদে কেউ কেবিনে নেই । আমরাও না । ডেকে বা কেবিনে শুয়ে-বসে সময় কাটালে সমুদ্র ভ্রমণের কোন মানে হয় না । এখানে রিক্সার টুনটুনি নেই, অটো, ভ্যান, প্রাইভেট, বাস-ট্রাকের বিকট ভেঁপু নেই, হরকিসেমের মানুষের নানান ছুরৎ , রংবাজী নেই । গাছপালা, ঘরবাড়িবিহীন অন্য রকম এক অপূর্ব, নিখাদ প্রকৃতি দর্শনের সুযোগ কারো জীবনেই সচরাচর আসে না । অখন্ড আকাশ, আসমুদ্র পানি আর পানি, দুরন্ত সীগাল, অফুরান নির্মল হাওয়া ! ওপাশে ‘তরুছায়া মসীমাখা ‘- মিয়ানমারের ধূ ধূ সীমান্ত রেখা । মাঝখানে অতন্দ্র প্রহরীর মতো ধীর গতিতে ভাসমান আমাদের কোস্ট গার্ড আর নৌবাহিনীর টহল জাহাজ – এসব দেখতে দেখতে আমরা পাড়ি জমিয়েছিলাম সেন্টমার্টিন । ফিরে যাচ্ছি মনের দর্পণে ঠাঁই করে নেয়ার মতো আরও একটু ভিন্ন রূপের ভিন্ন মাত্রা যুক্ত করে ।
তখন পড়ন্ত বিকেল । পশ্চিম আকাশে ঢলে পড়েছে সূর্য । জাহাজের পেছনের ছাদে খোলা জায়গায় মানুষের খন্ড খন্ড জটলা । সবাই গল্প-গুজবে মত্ত । লবিতে, রেলিংয়ে, কর্ণারে, সিঁড়িতে যাত্রীদের আনাগোনা, ঘোরাফেরা, ওঠানামা । ছোটরা হৈচৈ মুখর । জাহাজের সি ও মেজর মনির ভাইয়ের সাথে পরিচিত হয়ে আমরাও এক পাশে মজেছিলাম খোশগল্পে । মাঝে মাঝে চা -কফি-চানাচুর আমাদের এনে দিয়েছিলো আড্ডার মেজাজ । আমরা তিন তলার ছাদে । দোতলায় একই অবস্থানে সরব আড্ডা জমিয়েছে কলেজ-ভার্সিটি পড়ুয়া কতিপয় যুবক । বিচিত্র কন্ঠের কোরাস সঙ্গীত গেয়ে, নেচে মাতিয়ে রেখেছিলো ভ্রমণপিপাসু মানুষগুলোকে । সারেং ভাইয়ের কেবিনের দুপাশের কর্ণারে দুই জোড়া কপোত-কপোতী চোখাচোখি, বলাবলি, হাসাহাসি করে এক রকম টাইটানিক পরিবেশের জন্ম দিয়েছে । ওদের চুলগুলো উড়ছিলো নান্দনিক দৃশ্যের অবতারণা ক’রে । সমুদ্র বিলাসী বাতাসে ছুটোছুটি করছিলো ওদের পোশাকেরও বিচ্ছিন্ন অংশ ।
এক ফাঁকে মধ্য আকাশের পূর্বাংশে চোখ রাখতেই দেখি, পরিপূর্ণ একটি চাঁদও আমার দিকে তাকিয়ে আছে । এক রাশ নীলের মাঝখানে ফুটফুটে চাঁদ । এ এক অপার বিস্ময় । দিনের আলো না ফুরোতেই চাঁদের আলোর মাতামাতি । ইতোপূর্বে কখনো এমনটি দেখিনি । মনটা কেমন উদাস হয়ে গেলো । আমি আড্ডা ছেড়ে একাকী হয়ে গেলাম । একটু একটু মনে পড়ে – দূর অতীতে এক বিকেলে ছাদ থেকে আবছা এক ফালি চাঁদ দেখেছিলাম । সে ছবি চোখে পড়ে-পড়ে না । আজ যা দেখছি তা শরৎ কালের নির্মল আকাশেও কখনো দিবালোকে শোভা পেতে দেখিনি । এ মুহূর্তে আমার মনের মুগ্ধতার শেষ নেই । এ দৃশ্যের বর্ণনা কোথায় কার কাছে কিভাবে ব্যক্ত করবো, ভেবে পাচ্ছি না । কেবল ভাবছি, বিধাতা কী অপরূপে সাজিয়ছেন এ বিশ্ব-জগত । সৌন্দর্যের শেষ নেই । রহস্যেরও অন্ত নেই । তখন কেবল প্রাণখুলে গাইতে ইচ্ছে করছে – “খেলিছো এ বিশ্ব লয়ে বিরাট শিশু আনমনে ” । উদাস বাউল সেজে সুর মেলাতে মন চাইছে লালন সাঁইয়ের সেই মরমী গানে – আল্লা’ কে বোঝে তোমার অপার লীলে ~~~
তরুণ ইউসুফ
কবি, ছড়াকার ও গল্প লেখক
বিভাগীয় প্রধান-বাংলা
মে. জে. মাহমুদুল হাসান আদর্শ মহাবিদ্যালয়, টাঙ্গাইল ।
Leave a Reply