– দীপক সাহা (পশ্চিমঙ্গ)
“ওরা বলে- এসপ্ল্যানেড। আমরা বলি- চৌরঙ্গী। সেই চৌরঙ্গীরই কার্জন পার্ক। সারা দিন ঘুরে ঘুরে ক্লান্ত শরীরটা যখন আর নড়তে চাইছিল না, তখনই ওইখানেই আশ্রয় মিলল। ইতিহাসের মহামান্য কার্জন সাহেব বাংলাদেশের অনেক অভিশাপ কুড়িয়েছিলেন। সুজলা-সুফলা এই দেশটাকে কেটে দুভাগ করার বুদ্ধি যেদিন তাঁর মাথায় এসেছিল, আমাদের দুর্ভাগ্যের ইতিহাস নাকি সেই দিন থেকেই শুরু হয়েছিল।“ এভাবেই শুরু হয়েছে শংকরের জনপ্রিয় উপন্যাস ‘চৌরঙ্গী’।
দে’জ পাবলিশিং থেকে প্রকাশিত ‘একা একা একাশি’ বইটির জন্য এ বছর (২০২০)সাহিত্য অকাদেমি পুরস্কার জনপ্রিয় সাহিত্যিক শংকর। সাম্প্রতিক বাংলা সাহিত্যের অন্যতম পাঠকপ্রিয় লেখকের এই পুরস্কারপ্রাপ্তি ৮৭ বছর বয়সে!!! এ বই শংকরের আত্মজীবনী। শংকরের এই প্রাপ্তিতে আনন্দিত দুই বাংলার সাহিত্য মহল।
সাহিত্য একাডেমি পুরস্কার ভারতের একটি সাহিত্য সম্মাননা। ভারতে জাতীয় সারস্বত প্রতিষ্ঠান সাহিত্য একাডেমি কর্তৃক ১৯৫৪ সাল থেকে ভারতের রাষ্ট্রভাষাগুলিতে রচিত অসামান্য সাহিত্যকীর্তিগুলির স্বীকৃতিস্বরূপ এই পুরস্কার প্রদত্ত হয়ে আসছে।
পুরো নাম তাঁর মণিশংকর মুখোপাধ্যায়। কিন্তু চৌরঙ্গী, আশা-আকাঙ্ক্ষা ও কথামন্থনসহ বহু জনপ্রিয় উপন্যাসের স্রষ্টা পশ্চিমবঙ্গের এই লেখক পাঠকমহলে কেবল শংকর নামেই পরিচিত। ১৯৩৩ সালের ৭ ডিসেম্বর অবিভক্ত বাংলার যশোরের বনগাঁয় জন্মগ্রহণ করেন তিনি। তাঁর পিতা গোবরডাঙা ইছাপুর নিবাসী হরিপদ মুখোপাধ্যায় বনগাঁ মুন্সেফ কোর্টে ওকালতি করবার জন্য বনগাঁয় অস্থায়ী বাসা বেঁধেছিলেন। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ শুরুর আগেই যখন শংকরের এগারো-বারো বছর বয়স,তখন তিনি সপরিবারে পাকাপাকি গঙ্গার ওপারে হাওড়া চলে যান। সেখানেই শংকরের বেড়ে ওঠা, পড়াশোনা ও সাহিত্য সাধনার শুরু। মা বাবার আটটি সন্তানের মধ্যে তিনি ছিলেন অন্যতম। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময় শহরজুড়ে শুরু হয়েছিল জাপানি বোমার ভয়ে ‘ইভ্যাকুয়েশন’। পরিবারের অন্যরা বনগাঁয় ফিরে গেলেও বাবার সঙ্গে তিনি থেকে যান হাওড়ায়। ভর্তি হন বিবেকানন্দ ইনস্টিটিউশনে। ১৯৪৭ সালে পিতৃবিয়োগ। প্রথম জীবন মসৃণ ছিল না। উচ্চতর পড়াশোনার সুরেন্দ্রনাথ কলেজে ভর্তি হলেও অর্থাভাবের কারণে কলেজের মাইনে দিতে পারতেন না। একদিন কলেজের এক সাহিত্যসভায় রম্যরচনা লিখে কলেজের ভাইস প্রিন্সিপালের সুনজরে পড়েন। তিনি মণিশংকরের লেখায় খুশি হয়ে ছাত্রের মাইনে মুকুব করে দেন। তিনি তাঁকে আইএ (IA) পরীক্ষায় বসারও সুযোগ করে দেন। কম বয়সে বাবার মৃত্যুর পর জীবনের শুরুতে কখনো ফেরিওয়ালা, টাইপরাইটার ক্লিনার, কখনো প্রাইভেট টিউশনি, কখনো শিক্ষকতা অথবা জুট ব্রোকারের কনিষ্ঠ কেরানিগিরি করেছেন। তাঁর জীবনে মা অভয়াদেবীর ভূমিকা ছিল অপরিসীম। অনেক কষ্টে মা তাঁকে মানুষ করেছিলেন। সাহিত্যের প্রাথমিক পাঠ মায়ের কাছেই।
হরিপদবাবু নামী নাট্যকার ছিলেন। কলকাতার মনমোহন থিয়েটারে তাঁর নাটক দীর্ঘকাল অভিনীত হয়েছে। ‘রাণী দুর্গাবতী’, ‘দধীচি’, ‘রামপ্রসাদ’ প্রমুখ তাঁর জনপ্রিয় সৃষ্টি। রক্তে সাহিত্য ছিলই, শংকর সেই শক্তিকে পূর্ণ রূপ দিয়েছেন। বিচিত্র জীবন অভিজ্ঞতা লেখায় উঠে এসেছে বারবার। রাস্তার জীবন থেকে লড়তে লড়তে শীর্ষে পৌঁছেও একই রকম সহজ সরল এবং সরস।
প্রথম জীবনে শংকর কলকাতা হাই কোর্টের শেষ ইংরেজ ব্যারিস্টার জন বারওয়েলের মহুরি ছিলেন। বারওয়েলের অফিসে একটি লাইব্রেরি ছিল।সেখানে নানান ধরনের বই থাকত। বিশ্ব সাহিত্যের সাথে শংকরের এখানে পরিচয় ঘটে। এই বিদেশী মানুষটি শংকরের জীবনে এতটাই প্রভাব ফেলেছিল, যে, তাঁর মৃত্যুর পর শুরু হল শংকরের প্রথম উপন্যাস রচনা, রারওয়েলের স্মৃতিতে। সেই স্মৃতিকথাই ফুটে উঠেছে ‘কত অজানারে’ উপন্যাসে। এই উপন্যাসটির নামকরণ করেছিলেন প্রেমেন্দ্র মিত্র। ১৯৫৯ সালে সাপ্তাহিক দেশ পত্রিকায় তাঁর এই ধারাবাহিক উপন্যাসটি বেরোয়। তারপর শংকরের কলম থেকে বেরিয়েছে একটার পর একটা অত্যন্ত জনপ্রিয় উপন্যাস, যাদের মধ্যে সবার আগে বলতে হবে চৌরঙ্গীর কথা। কল্পিত শাজাহান হোটেলের কাহিনী , যাতে ফুটে উঠেছিল তৎকালীন কলকাতার উচ্চবিত্ত জীবনের প্রতিচ্ছবি। ১৯৬১ সালে প্রকাশিত চৌরঙ্গীর একশো পঁচিশটা সংস্করণ হয়ে গেছে ইতিমধ্যেই। কিন্তু এখনও উপন্যাসটি কলেজ স্ট্রিটে বেস্ট সেলার। পাঠক মহলে সাহিত্যিক শংকরের জনপ্রিয়তা আকাশছোঁয়া।
‘বোধোদয়’ উপন্যাস প্রকাশের পর শংকরকে উৎসাহবাণী পাঠান শরদিন্দু বন্দ্যোপাধ্যায়, বলেছিলেন ‘ব্রাইট বোল্ড বেপরোয়া’। ভাবনা বা প্রকাশভঙ্গিতে তাঁর এই উপন্যাস নিজের অন্য লেখালেখি থেকে অন্য রকম হওয়ায় তিনি তা পড়তে দিয়েছিলেন মুম্বইনিবাসী শরদিন্দুকে। শরদিন্দু সেই লেখা পড়ে বলেছিলেন, ‘তোমার এই লেখায় জননী জন্মভূমিকেই আমি সারাক্ষণ উপলব্ধি করলাম।’ পাঠকমহলের ‘নিন্দা ও প্রশংসার ডালি নিয়ে আমি নিজেও এক সময় ‘বোধোদয়’কে ভালবাসতে শুরু করেছি’, বলেন মণিশংকর মুখোপাধ্যায়।
শংকরের উপন্যাস নিয়ে সিনেমা বা নাটক কম হয়নি। শংকরের প্রথম বই ‘কত অজানারে’ নিয়ে ছবি করতে শুরু করেছিলেন ঋত্বিক ঘটক, যদিও তা সম্পূর্ণ হয়নি। তাঁর ‘চৌরঙ্গী’ উপন্যাসটিও সিনেমা হয়েছে ১০৬৮ সালে। পরিচালক পিনাকী ভূষণ মুখোপাধ্যায়। মুখ্য চরিত্র স্যাটা বোসের ভূমিকায় অভিনয় করেছেন উত্তম কুমার। বাসু চট্টোপাধ্যায় সহ আরও কতজন তাঁর কাহিনি নিয়ে সিনেমা বানিয়েছেন। পেশাদারি মঞ্চে সফল হয়েছে তাঁর কাহিনির নাট্যরূপ। আর তাঁর অধিকাংশ বই শতাধিক সংস্করণ পার করেছে। গ্রন্থ বিপণনে নতুন নতুন ভাবনাতেও মেতেছেন। পরবর্তী কালে কিংবদন্তি পরিচালক তপন সিংহ-ও শংকরের কাহিনী অবলম্বনে ‘এক যে ছিল দেশ’ ছবি করেছেন।
তাঁর লেখার ভক্ত ছিলেন সত্যজিৎ রায়ও। শংকরের সীমাবদ্ধ এবং জন অরণ্য উপন্যাস নিয়ে সিনেমা করেছিলেন সত্যজিৎ। সেই প্রসঙ্গে শংকরের স্বীকারোক্তি, ‘সত্যজিৎই আমাকে সকলের কাছে পৌঁছে দিয়েছে, ছড়িয়ে দিয়েছে।’এ বছরেই সত্যজিৎ রায়ের শতবার্ষিকী উৎসব। আর সে বছরেই সাহিত্য একাডেমি পুরস্কারে পুরস্কৃত হলেন শংকর।
‘চৌরঙ্গী’ বাংলা সাহিত্যে ক্লাসিকের মর্যাদা পেয়ে গেছে। বিভিন্ন ভাষায় অনূদিত। কিছুকাল আগে লন্ডন থেকে ইংরেজি ভাষায় অনূদিত হয়ে সারা বিশ্বে আলোচিত। এ ছাড়া শংকরের সম্রাট ও সুন্দরী, স্থানীয় সংবাদ, বিত্ত বাসনা, নিবেদিতা রিসার্চ ল্যাবরেটারি, জানা দেশ অজানা কথা, মানচিত্র, ঘরের মধ্যে ঘর, তিন ভুবনের কথা, চরণ ছুঁয়ে যাই, যোগ বিয়োগ গুণ ভাগ—সবই বেস্ট সেলার। শংকরের পাঠকের সংখ্যা সীমাহীন। এবং তারা এলিট ক্লাসের লোক নয়। নেহাতই আমজনতা। শংকর একবার নিজেই বলেছিলেন, “একটা বাসে বসার জায়গা থাকে ৩৭+১ জনের। এদের মধ্যে ৩৩জনই আমার পাঠক বা পাঠিকা।“ কথাটা শুধু সত্যি নয়, একশো ভাগ সত্যি। গত দুই দশকে শংকর অবশ্য উপন্যাসের পাশাপাশি স্বামী বিবেকানন্দ চর্চায় রত। তাঁর আগ্রহের বিষয়বস্তু স্বামী বিবেকানন্দের জীবনী। স্বামীজির জীবনের অনেক না জানা তথ্য প্রকাশিত হয়েছে শংকরের লেখায় – আমি বিবেকানন্দ বলছি, অচেনা অজানা বিবেকানন্দ, অবিশ্বাস্য বিবেকানন্দ। এক সময়ে কলকাতার শেরিফ শংকরের লেখা বই আজও বেস্ট সেলার।
‘একা একা একাশি’ বইটি প্রকাশিত হয় শংকরের ৮১তম জন্মদিনে। এখন শংকর ৮৭ । অনেকের মত ‘চৌরঙ্গী’ এবং ‘কত অজানারে’ প্রকাশ হওয়ার পরেই তাঁর সাহিত্য অকাদেমি পাওয়া উচিত ছিল। তার মানে ৬০ বছর আগে পাওয়া উচিত ছিল। ৬০ বছর লেগে গেল পুরস্কারটা দিতে! এ বার শুদ্ধিকরণ হল। বর্তমানে যাঁরা জুরি মেম্বার, তাঁরা সত্যিকারের শাপমোচন করলেন। শংকরের সাহিত্য অ্যাকাডেমি পুরস্কার এক অর্থে তাঁর সংগ্রামী জীবনের স্বীকৃতি। হয়তো তাঁর উপন্যাসের নায়ক বা নায়িকার মতো। তবে একটু দেরিতে এল এই যা।
Leave a Reply