সোমবার, ১৪ Jul ২০২৫, ০২:৩২ অপরাহ্ন

শিরোনাম :
কসবায় রাউৎহাট-হাজীপুর সংযুক্ত সড়ক বেহাল: দুর্ভোগে পাঁচ হাজার মানুষ কসবায় স্ত্রীকে উপর্যুপরি ছুরিকাঘাত করে স্বামীর আত্মহত্যা, স্ত্রীর অবস্থা আশংকাজনক কসবায় ফলদ বনজ ও ওষধি গাছের চারা বিতরণ একটি চাকরি বড্ড জরুরি কসবায় ৩৫ জন মৎস্য খামারি ও ২৩০০ কৃষক পেলেন কৃষি প্রণোদনা ৫ আগষ্ট ছাত্র-জনতা মানুষের অধিকার ফিরিয়ে দিযেছে- আতাউর রহমান সরকার বিশ্ববাঙালি সংসদের পর্যটন বিষয়ক আলোচনা ও সম্মাননা আয়োজন কক্সবাজারে ।। কসবায় ‘জুলাই যোদ্ধা’দের মাঝে স্বাস্থ্য কার্ড বিতরণ তরুণ প্রজন্ম ৫৪ বছরের শাসনামল আবার ফিরে আসুক সেটা চায়না -আতাউর কসবা উপজেলা সাংবাদিক ফোরাম (KUSF) এর ঈদ পুনর্মিলনী অনুষ্ঠিত
শিরোনাম: জন্মদিবসে স্মরণ করি ফাদার দ্যতিয়েনের বাঙালি সংস্কৃতি চর্চা

শিরোনাম: জন্মদিবসে স্মরণ করি ফাদার দ্যতিয়েনের বাঙালি সংস্কৃতি চর্চা

-পাভেল আমান

বাংলা ভাষা, সাহিত্য ও সংস্কৃতিকে যারা ভালোবেসে নিজেদের ধ্যান জ্ঞান মন প্রাণকে বাংলা ভাষার উৎকর্ষ সাধনে নিবেদিত করেছিলেন। তন্মধ্যে ভিনদেশী অবাঙালি ফাদার দ্যতিয়েন অন্যতম।ফাদার পল দ্যতিয়েন ছিলেন ফরাসীভাষী বেলজিয়ামের নাগরিক তিনি জন্মেছিলেন ১৯২৪ সালের ৩০ ডিসেম্বর। ১৯৫০ সালে ভারতে আসেন খ্রীষ্টান সন্যাসী হিসাবে। আসার পর পরই এ দেশটাকে অসম্ভব মন প্রাণে ভালোবেসে ফেলেন। মূলত বাংলা ভাষা, সাহিত্য-সংস্কৃতিটাই তাঁর ধ্যান জ্ঞানে পর্যবসিত হয় । কলকাতাই হয় তাঁর মূল বাসস্থান। সঙ্গে থাকে শান্তিনিকেতন। ১৯৭৬ সাল পর্যন্ত তিনি ভারতে থেকে ভারত এবং বাংলাভাষা সম্পর্কে গভীর জ্ঞান অর্জন করেণ। এবং বাংলা ভাষা প্রীতি ও গভীর থেকে গভীরতর হয়। ফাদার দ্যতিয়েন এক সাক্ষাৎকারে বলেছিলেন, ‘বাংলায় লেখক হবো ভাবিনি, ভালো করে ভাষাটা শিখতে চেয়েছিলাম। অন্যেরা, মানে বিদেশিরা, কোনও রকমে ভাষাটা বলতে শেখে, লিখতে পারে না। আমি খুব নিষ্ঠাভরে ভাষা শিখতে চেয়েছিলাম। বাংলা গদ্যের সুরের মূর্ছনা আমার কানে বাজে। খুব অল্প সময়েই তিনি উপল্লব্ধি করে ফেলেন এক সারসত্য- “বাঙালিরা শুধু মনে-প্রাণে নয়, উদরেও ভালবাসে।টানা প্রায় তিন দশক বাঙালিকে খুব কাছ থেকে দেখেছেন। রবীন্দ্রনাথ-জীবনানন্দ আত্মস্থ করেছেন ভালোবেসে। বাংলা ভাষার নিজস্ব সব আটপৌরে প্রয়োগকে সাজিয়ে নিয়েছেন লেখায়। তাই, তাঁর গদ্যে ঢুঁ মারলেই মিলবে ‘হাঁসের ডিমের মতন বড় বড় চোখ’-এর উল্লেখ ও আরও কত কী। তাঁর সব লেখাতেই নিজের উপলব্ধির কথা থাকলেও সমস্তটা আসলে সেই বাংলা ও বাঙালি নিয়েই চিন্তাভাবনার ফসল। আর শুধু তো সাহিত্য নয়, এখানকার সমাজ-অর্থনীতি-রাজনীতি এমনকি বাংলা সিনেমার খুঁটিনাটির দিকেও নজর দিতে ভোলেননি ফাদার দ্যতিয়েন। “কিছু বোম্বাই মার্কার নকল মাল আর গুটিকতক পৌরাণিক ও ঐতিহাসিক ছবি বাদ দিলে দেখা যাবে, তিনটি পটভূমি ফিরে ফিরে আসে বাংলা ছবিতে। ঠাসা, ঘিঞ্জি, অতি-অধ্যুষিত ফ্ল্যাট-বোঝাই কলকাতা, গ্রামের উঠোন ঘিরে গ্রামীণ পরিবার-জীবন আর এক-শতক দেড়-শতক আগের উচ্চ মধ্যবিত্ত সম্প্রদায়”। একটুখানি মনে রাখা ভালো, বাংলা সিনেমা নিয়ে তাঁর এই উপলব্ধি সেই সময়কার, যখন আমাদের সাদা-কালো সেলুলয়েডের যুগ ফুরোয়নি।

সেন্ট জেভিয়ার্স কলেজে পড়াতেন। উত্তর কলকাতার তেলিপাড়া লেন থেকে পাঞ্জাবি আর ঢোলা পায়জামা পরে ঘুরে বেড়াতেন সাইকেলে। ১৯৫১ সালে সেন্ট জেভিয়ার্সের রেক্টর ফাদার হেনরি বারকে অনুরোধ করেছিলেন তাঁকে কোনও গ্রামে পাঠাতে। যাতে ঝরঝরে মুখের বাংলা আয়ত্ত করতে পারেন। সুন্দরবনের নানা গ্রামে এরপর ঘুরে বেড়িয়েছেন দ্যতিয়েন। বাংলাভাষাকে শিকড় থেকে চিনেছেন। লিখতে শুরুও করেছেন। ১৯৫৯-এই প্রকাশ পাচ্ছে তাঁর ‘ডায়েরির ছেঁড়া পাতা’। কে বলবে এই লেখার লেখক একজন সাহেব। বিশিষ্ট বাঙালি বুদ্ধিজীবী ও গবেষক আবু সয়ীদ আইয়ুব এর মতে-“লেখক হিসেবে ফাদার পল দতিয়েন ছিলেন অবাঙালিদের মধ্যে সেরা”। বাংলা ভাষা, সাহিত্য সংস্কৃতি কে মনে প্রানে প্রতিপালন করে নিজস্ব চিন্তা ভাবনা, মেধা মনন কে ঢেলে দিয়েছি লেন।
বাংলা লেখা নয়, বাংলা পত্রিকা সম্পাদনাও করেছিলেন ভিনদেশি বাঙালি এই মানুষটি। হিন্দি শিখতে শিখতে মাঝপথে ছেড়ে দেন- পাছে বাংলা ভাষা থেকে দূরে চলে যেতে হয়, এই ভয়ে। অথচ ১৯৭৭-এর পর আবার প্রায় তিন দশক দ্যতিয়েন কাটিয়েছেন বিদেশে। আদতে জন্মভূমি হলেও, সে তখন তাঁর কাছে প্রবাসের সমান। এতদিন বাংলা থেকে দূরে থাকলে বাংলা ভাষা-সংস্কৃতির খুঁটিনাটি ভুলে যাবারই কথা, স্বাভাবিকও তা। বিশেষ করে, যখন জন্মসূত্রে বাঙালি নন দ্যতিয়েন।
১৯৫৯ সালে তাঁর প্রথম লেখা দেশ পত্রিকায় প্রকাশিত। তখনকার পাঠকসমাজ বিশ্বাসই করতে চায়নি যে এতো সুন্দর বাংলায় লেখা কোন বিদেশীর দ্বারা সম্ভব কি না। তারা ভেবেছিল এটা পত্রিকার সম্পাদকের কলমচালন। পরের পর লেখাগুলো পড়ে ওরা বুঝেছিল,এক সাহেব বাংলাভাষাটাকে বাঙালির চেয়ে বেশী জেনেছে। তিনি ছিলেন অসম্ভব শিক্ষিত মানুষ। দীর্ঘদিন কোলকাতার সেন্ট জেভিয়ার্স কলেজে শিক্ষকতা করেছেন। তিনি বিশ্বাস করতেন পৃথিবীর সুইটেস্ট ল্যাঙ্গুয়েজ বাংলা।

“ডায়েরীর ছেঁড়া পাতা” এই নামে তাঁর যে ছোট ছোট লেখাগুলো দেশ পত্রিকায় প্রকাশিত হতো,তা বাঙালির আটপৌরে জীবনের দূরন্ত কাহিনী। ১৯৬৩ সালে,পরে ১৯৬৯ থেকে ১৯৭১ সালে তাঁর লেখা ঐ পত্রিকায় বের হয়েছে নিয়মিত। দেশ পত্রিকা ছাড়াও অন্য অনেক পত্রিকায় তিনি লিখতেন। সে সব ইতিহাস হয়তো একদিন জানা যাবে।
১৯৭৭ সালে তিনি দেশে ফিরে যান। প্রাথমিক ভাবে শেষ হয়ে যায় এ দেশ এবং এ ভাষার প্রতি তাঁর অসম্ভব ভালোবাসা। কিন্তু সঙ্গে নিয়ে যান এক বৃহৎ স্মৃতি ও একবুক রবীন্দ্রনাথ। অসম্ভব রবীন্দ্র গান প্রীতি ছিল কি না।
দেশ পত্রিকায় তাঁর লেখা পাওয়া গেল আবার ২০০০ সালে। মূলত ওই সময় থেকেই আমি তাঁর লেখার পাঠক ও ভক্ত। কি অসাধারণ বাংলা যা অভিভূত হতেই হয়। মনেই থাকেনা তিনি এ ভাষার কেউ নয়। পর পর লেখাগুলো পড়ে মনে হয়েছে ঐ যাকে বলে আত্মার আত্মিয়। পুরোদস্তুর সন্যাসী মানুষ,ভারতে এলে ঐ কমিউনে থাকতেন।
আবার ২০১১ থেকে ২০১৩ পর্যন্ত দেশ পত্রিকায় লিখলেন, “আটপৌরে স্মৃতি”। গোগ্রাসে পড়েছি সে সব। মনকাড়া কথার কাহিনীমালার সমষ্টি। এক বিদেশীর বাংলাভাষা প্রীতি আমাদের অন্য জগতে নিয়ে যায়। ২০১৫ সালে বার্ধ্যক্য বয়সে এসেও তিনি প্রিয় স্থান শান্তিনিকেতন ঘুরে যান। এক ফরাসীভাষী বেলজিয়ামের নাগরিকের ভারতের এক ভাষার প্রতি এতো টান,এতো ভালোবাসা এলো কি করে? আমরা জানিনা কিন্ত উনি জানেন বিশ্বের শ্রেষ্ঠ শ্রূতিমধুর ভাষা কিন্তু বাংলা। এখন দেশ পত্রিকায় তাঁর লেখা বেরোচ্ছে, “সাদাসিধে খসড়া” শিরোণামে। এই তো ১৭ ই নভেম্বর ২০১৬ তে উনার লেখা পড়লুম।
যেসব বিদেশীরা ভারতে আসেন দেশটা দেখবার জন্য তিনি তাদের উদ্দেশ্যে বলেছেন যে,ভারতবর্ষকে বুঝতে গেলে দেশটার প্রকৃতি দেখার মানষিকতা বর্জন করতে হবে। কারণ, হিমালয় সংলগ্ন অঞ্চল ছাড়া ভারতের প্রকৃতি অন্য দেশের তুলনায় মুগ্ধকর নয়। ভারতের প্রান লুকিয়ে আছে দেশটার মানুষের মধ্যে। নানা রকম ভাষা ও কৃষ্টির মানুষ কিভাবে নিজেদের মধ্যে একত্রীভূত হয়েছেন তা বোঝাও জরুরী। তা দেখা ও জানার চোখ লাগে। তাঁর এই সংখ্যার লেখায় লিখেছেন,“পাশ্চাত্য দেশের বর্তমান কাল, স্বভাব
অনুযায়ী অতীতকে দুমড়িয়ে মুচড়িয়ে অগ্রসর হয়। ভারতে কিন্তু ঐ ধরণের কোন ছেদন-কর্তন-বক্রীকরণ নেই। অতীতকাল অতীত নয়,অতীতকাল বর্তমানের বিশেষ রূপ। ”
শ্রদ্ধা রইল,ভালোবাসা রইল,এক বিদেশী ভারত প্রেমিক তথা বাংলাভাষা প্রেমিকের প্রতি। আমরা তাঁর দৃষ্টির সামান্যতম অংশ পেয়ে যদি ভাষাটাকে ভালোবাসতে পারি তাই হোক জীবনের পাথেয়। পরিশেষে বাঙালি হিসেবে এই বাঙালি নিবেদিতপ্রাণ ফাদার দ্যতিয়েনের ৯০ তম জন্মদিনে তাঁকে জানাই অকুণ্ঠ শ্রদ্ধা ভক্তি, ভালোবাসা।
পাভেল আমান-শিক্ষক ও প্রাবন্ধিক-হরিহরপাড়া -মুর্শিদাবাদ

এই সংবাদটি শেয়ার করুনঃ

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *




raytahost-demo
© All rights reserved © 2019
ডিজাইন ও কারিগরি সহযোগিতায়: Jp Host BD