সোমবার, ০৪ নভেম্বর ২০২৪, ০২:৪২ অপরাহ্ন

শুক্লপক্ষ

কাজী সোহেল

‘খান স্যার, আরাম কইরা খান। আমি গরিব মানুষ। নিজের লাইগ্যা কিন্যা খাইতে সাহস পাই না। আপনাগো উসিলায় আমিও খাইলাম।’
সাব ইন্সপেক্টরের দিকে তাকিয়ে হড়বড় করে কথাগুলো বললো বহুদিনের টিকিট ব্লাকার আলম। সে সেদিন টিকিট বিক্রি করছিলো ‘অভিসারে’। তখন ‘বেদের মেয়ে জোসনা’র বত্রিশতম সপ্তাহ চলছে। পঞ্চাশ টাকার ডিসি একশো টাকা করে বিক্রি করছিলো দেদার। হঠাৎ তার দোস্ত ফজলুর সাথের পিচ্চিটা দৌড়ে এসে বললো, ‘ওস্তাদ, ফজলু ওস্তাদে কইসে আপনেরে ইস্টুডিয়াম যাইতে’। কি করতে হবে বুঝতে বাকি থাকে না আলমের। পলকে কেনা দামে ছ’টার শোয়ের হাতের শেষ সাতটা টিকিট বিক্রি করে দেয় ব্লাকার মতিনের কাছে। বলে শরীর খারাপ। ঘুরে পিচ্চিটারে নিয়া রিকশা নেয় ঢাকা স্টেডিয়ামের পূর্ব গেট। পনেরো মিনিটেই পৌঁছায় চব্বিশতলার নিচে। পিচ্চি দৌড়ায় ফজলুর খোঁজে। সে ধীরে নামে। দু’ পায়ের জন্মগত ত্রুটির জন্য তার চলার গতি ধীর হলেও বুদ্ধি চলে দূর্বার। বয়স ত্রিশ/বত্রিশ। উচ্চতা পাঁচ ফুট আট। ছিপছিপে, অবিবাহিত আলমের রঙটা শ্যাম হলেও নাক-চোখ ধারালো।
চারপাশের হৈচৈ, স্টেডিয়ামের ঢোকার গেটগুলো ও কাউন্টারে ভিড়, দেখে অবস্থা বুঝে নেয় সে। তেরশ’ টাকায় কেনা কালো ক্যাসিও ঘড়িতে সময় দেখে খেলা শুরুর সময়টার হিসেব মিলিয়ে নেয়। আরো প্রায় আধ ঘন্টা বাকি খেলা শুরুর।

বেশ কিছুক্ষণ এদিক সেদিক ঘুরেও টিকিট জোগাড়ের ব্যবস্থা করতে পারলো না সে। এক সময়ের সাগরেদও ক’টা টিকিট দিতে অস্বীকার করলো। ‘ওস্তাদ আমাত্তে পূর্ব গ্যালারির এ দুইডা টিকিডই আছে, কিরা কইতাছি।’
আলমেরর অভিজ্ঞ চোখ বোঝে যে ওর কাছে টিকেট আছে, দেবে না। হঠাৎ দূরে দেখলো আউটার স্টেডিয়ামের বারান্দায় পা ছড়িয়ে বসে পান খাচ্ছে জয়নালের মা। এগিয়ে যায় আলম।
‘কি খালা বইয়া রইছো যে!’
‘কিয়ারুম টিকিড নাই। গেছিলাম কাউন্তারের লাইনে। ব্যাডা গো গুতায় বারায়া আইছি। মইয়ালোক দ্যাকলে ব্যাডা গো শইল্লে শুয়োরের তেল অয়। জোয়ান বুড়া বুজে না, শইল্লে গুতাগুতি করে।’
‘এত্তো কতা কইয়ো না খালা, আমি জানি তোমার কাছে টিকিড আছে। তুমি নাইলে খেলা থুইয়া এহানো পান খাইতে বইতা না’
‘তোর হইলো হকুনের চোখ।’ কথায় প্রশ্রয় টের পায় আলম।
– নে দুইডা পচিম গেলারি।’
‘না খালা দশটা দাও হারা দিনে এই বাইর হইলাম। শইল বালা না।’
পাঁচটা গ্যালারির সাথে পাঁচটা ভিআইপিও দেয় জয়নালের মা। সে আসলে ব্ল্যাকারদের ব্লাকার। বাইরে থেকে বোঝার উপায় নেই দেখে।

প্রতি টিকিটে পঞ্চাশ করে গুনে নিয়েছে জয়নালের মা। সমস্যা নেই আলমের। তার অভিজ্ঞ চোখ কাস্টমার চেনে। সে জানে কিভাবে বড় দাও মারতে হয়। পকেটে ভিআইপি টিকিটগুলো নিয়ে চব্বিশতলা পেরিয়ে এসে একটা সস্তা সিগারেট ধরায়। তখুনি গাড়ি থেকে নামে দু’জন তরুণী ও একজন উদ্বিগ্ন তরুণ। দেখেই বোঝা যায় টেনশন করছে সে টিকিট পাওয়া নিয়ে। এগিয়ে না গিয়ে দাঁড়িয়ে থাকে আলম। দু’এক জন গ্যালারি টিকেট নিয়ে এগিয়ে গেলে পেছন থেকে ধমক দেয় সে, ‘সর-সর স্যারে গো বিয়াইপি লাগবো৷’
‘হবে আপনার কাছে?’
কথা শুনেই বুঝে যায় আলম। বড় মাছ পড়েছে জালে৷ তিনটা টিকেট পনেরো শ’ চেয়ে নতুন সিগারেট ধরায় সে৷ আগেরটা কাস্টমার দেখে ফেলে দিয়েছিলো৷ ছেলেটা মেয়ে দুটোকে নিয়ে চলে যেতে গিয়েও কি ভেবে ফিরে এলো৷ যেই না সে টাকা বের করতে নিয়েছে কোত্থেকে যমদূতের মতো এক পুলিশ পেছন থেকে এসে কলারে চেপে ধরে তার পাতলা শরীরটাকে প্রায় শুইয়ে ফেললো। পেছন থেকে একজন এর মধ্যেই পুলিশি বেতের বাড়ি কয়েক ঘা বসিয়ে দিলো।
‘মা গো, বাবা গো, স্যার গো, স্যার গো’ করে আর্তনাদ করতে থাকে আলম। ইশারায় কন্সস্টেবলকে থামতে বলে তরুণ পুলিশ অফিসার।
‘স্যার আর জীবনে করুম না। না খাইয়া মরলেও এদিকে আমু না স্যার।’ কন্সস্টেবল তাকে প্রায় টেনে হিচড়ে গাড়ির কাছে নিয়ে এলো। আরও কিছু চড় থাপড়ের পরে মিনিট পনেরো বিরতি নিলো পুলিশ। এই সুযোগে আলম বলল,
স্যার আপনার পায়ে ধরি স্যার। ক্ষিদায় মরতাছি। কিছু খায়া লই। আপনারাও খান। পরে মাইরা লাইলেও কিছু কমুনা। বলে পা জড়িয়ে ধরলো।
‘ওঠ্’
মন কিছুটা গলেছে অফিসারের৷ ‘ওঠ্’ এর উচ্চারণেই বুঝে গেছে আলম৷ মুহুর্তেই গলার স্বর বদলে নেয় সে।
‘স্যার চলেন বড় মিষ্টির দোয়ানডাত যাই৷’ মিনিট দুয়েকেই ওরা পৌঁছে গেল সেখানে।
দোকানটায় জমজমাট ভিড়৷ ভীষণ ব্যস্ত ওয়েটাররা৷ বেশ ভাব নিয়ে সে। একজন ওয়েটার ডেকে আলম বললো, ‘স্যারে গো ফুল প্লেট দই, চমচম, রসমালাই আর নিমকি দেন। আমারে সিঙ্গেল দইমিষ্টি দেন৷’
তিনজনেই এবার মনোযোগী হলো দইমিষ্টিতে। আলম এর খাওয়া আগে শেষ হলে সে বার দুয়েক নিচু স্বরে ডাকলো ওয়েটারদের এলো না কেউ। লোকজনের শব্দে সেই শব্দ মিলিয়ে গেলো, হাত দেখানোই সার।
‘আমি লইয়াআয়ি বেনসন। আপনেরা খান।’ অফিসার চমচম মুখে ইশারায় সম্মতি দিলে সে দোকান থেকে বেরিয়েই দ্রুত ভাবলো। তারপক্ষে দৌড়ে পালানো অসম্ভব। হেঁটে চারটা দোকান পরে এক ফার্নিচার দোকানে ঢুকলো। মালিক তার এলাকার। সে পেছনের গোডাউনের চৌকির নিচে ঢুকে মরার মতো পড়ে রইলো।
মিনিট দশেক পর খাওয়া শেষ হলে অফিসার বের হয় কন্সস্টেবলকে নিয়ে। বেরিয়ে আশেপাশে কাউকে পায় না। অফিসার রাগে কটমট করতে করতে বিল দেয় তিনজনের। দোষটা তার তাই কাউকে কিছু বলার নাই। সে দ্রুত সরে যায় ওখান থেকে।
দুই ঘন্টা পর আলম বের হয় গোডাউন হতে। মশার কামড় পাগল করে ফেলছিলো ওকে। দ্রুত একটা বেবিট্যাক্সি নেয় আলম, ব্রাদার্স ক্লাব। ভেতরে হাউজির হইচই, ভিড়। একটা কোনায় এক বুড়া চাচা বুটভুনা বেচে, দারুণ স্বাদের, বেশ ঝালও। পাঁচ টাকার কিনে খেয়ে নেয় সে। তারপর হাউজির টিকিট কিনে পকেট তার প্রায় ফাঁকা।
হাউজির টিকেটটার দিকে তাকিয়ে থাকে আলম। তাতে ছয় সারি অংক। একেকটায় পনেরটা করে সংখ্যা বসানো। সিগারেট হাতে নিয়ে ঘোষণা অনুযায়ী নাম্বার কাটতে থাকে সে। তিন সারি শেষ, অর্ধেকও মেলে না তার। চলে যাবে কিনা ভাবছে সে। কারন ওই অফিসার যদি এদিকে আসে! আজ পেলে মেরেই ফেলবে। ভাবছে আর আনমনে ছয় নাম্বার মিলে গেলে ঘোষণায় মনেযোগী হয় আলম। এবার সাপ্তাহিক বাম্পারের লাইন। একি টানা মিলছেই! ঘামতে থাকে আলম, বারো তেরো, চৌদ্দ, পনেরো মিলে গেছে!! উত্তেজনায় কাঁপতে কাপতে ‘ইয়েস’ বলে হাত ওঠায়। মঞ্চ থেকে ঘোষণা আসে ‘ফলস।’
‘মানে!! ‘
মুহূর্তে শীতল হয় সে। কারন উত্তেজনায় সে খেয়াল করেনি। পনেরোতম সংখ্যা ঘোষণাই হয়নি তখনো। হতাশায় কুঁকড়ে যায় সে।
‘রাখে আল্লাহ্‌ মারে কে! বললো ঘোষক। হেসে তার টিকেটের নাম্বারটাই ঘোষণা করলো। আলম পেলো সপ্তাহের বাম্পার পঞ্চাশ হাজার টাকা!! নিজের কানকেই বিশ্বাস হচ্ছে না। মিনিট তিনেকের মধ্যে ধাতস্থ হয় সে। রাত হয়েছে বেশ। টাকা নিয়ে একা বের হওয়া ঠিক হবে না। ক্লাব থেকে ফোন করে অভিসারের সিকিউরিটি গার্ড লিটনকে। এমনিতে সে আপনি করে বলে। এখন তার কন্ঠই বদলে যাওয়া। টাকা নিমিষে বদলে দেয় মানুষকে। ‘লিটন একটা ট্যাক্সি লইয়া আইয়ো, দশমিনিটে, কক্সবাজার। আমি কেলাবের সামনে। খুশি কইরা দিমু।’
‘ঘাগু লিটন বুঝে যায়। বললো, ‘শিউলি শোতে আছে। কমু কিছু হেরে।’
‘কও।’
শিউলি। দেখতে বেশ ভালোই। বুদ্ধির ঝিলিক আছে চেহারায়। আলমের সাথে খানিক খাতিরও আছে। কিন্তু তার চরিত্র নিয়া অভিযোগও আছে বেশ। তবু আলমের বিকল্প চিন্তার সুযোগ নেই এই মুহুর্তে।

সতের মিনিটে সাদা একটা টেক্সি এলো। ভেতরে লিটন ও শিউলি। এর মধ্যেই টাকা নানান জায়গায় রেখেছে আলম। উপরের পকেট থেকে একটা পাঁচশোর নোট দিলো আলম গাড়িতে উঠতে-উঠতে লিটনকে। চোখ বড় হয়ে গেলো শিউলির। সাদা গাড়িটা বড়ো রাস্তায় পুরো স্পিড তুললে ধাতস্থ হয় আলম।

গাড়ির পেছনের বাতি নেভানো। তেরো চৌদ্দদিনের চাঁদ আকাশে। খোলা কাচ, চুল উড়ছে শিউলির। ওর পরনে হালকা নীল একটা শাড়ি। জোছনা মেখে তা সাদা হয়ে গেছে।
‘ শিউলি তুই জানস আমি ভালো না। তুইও। সারাবছর খালি তো কষ্টই করি। আয় কয়ডা দিন সাহেব গো মতো থাকমু, ঘুরমু, খামু। শিউলি আরো ঘনিষ্ট হয়ে আসে আলমের। তাদের ঠোঁটেরা একসাথে জোছনায় মাখামাখি হতে থাকে।
পুরো একটা সপ্তাহ থ্রি-স্টার হোটেলে, সাগরপাড়ে প্রজাপতির মতো উড়ে উড়ে বেড়ালো ওরা।

কয়েক সপ্তাহ পরের রবিবার। রাস্তার ওপাড়ে হাটখোলা রোডে স্টুডিওর সামনে একটা লোকের সাথে কথা বলছে শিউলি। আড়চোখে দেখে আলম। নতুন ছবি আসছে অভিসারে। চলে না। শোনা যাচ্ছে ‘বেদের মেয়ে জোসনা’ই আবারও আনবে। তিনটার শোর কয়েকটা টিকিট হাতে একটা কোনায় দাঁড়িয়ে আনমনে ভাবছিল গত মাসের আনন্দময় সময়ের কথা আর বিড়বিড় করছিলো আলম,’ শালার টেয়া, যেমনে আয়ে হেমনে যায়। বাড়ির লাইগ্গা যে বাইশশ’ টেয়ার মার্কিডিং করলাম হেইডাই কামে লাগলো।’
খালি কাউন্টার। অভিসারে সাড়ে তিনটার দিকে একজোড়া কপোত -কপোতী হন্তদন্ত হয়ে এলো রিকশায় করে। তাদের দিকে চকচকে চোখে এগিয়ে গেলো আলম।

এই সংবাদটি শেয়ার করুনঃ

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *




raytahost-demo
© All rights reserved © 2019
ডিজাইন ও কারিগরি সহযোগিতায়: Jp Host BD