বুধবার, ১১ ডিসেম্বর ২০২৪, ০৬:১৪ পূর্বাহ্ন

শিরোনাম :
কসবায় সবুজ সংঘের শিক্ষাবৃত্তি ও মানবিক সহায়তা প্রদান বাংলাদেশের জনগণ কারও দাদাগিরি একদম পছন্দ করে না: গোলাম পরওয়ার ভারতের গণমাধ্যমগুলো যে ভূমিকা নিয়েছে তা দুদেশের মধ্যে স্বাভাবিক সম্পর্ক প্রতিষ্ঠায় সহায়ক নয় -পররাষ্ট্র উপদেষ্টা কসবা প্রেসক্লাব কার্যালয়ের জানালার গ্রীল ভেঙে দিয়েছে দুবৃত্তরা, প্রকৃত রহস্য উদঘাটনের দাবি সাংবাদিকদের ইমাম প্রি-ক্যাডেট স্কুলের ১৪০ শিক্ষার্থীর পবিত্র কুরআন সবক গ্রহণ কসবায় জুলাই-আগস্টে ছাত্র-জনতার গণঅভ্যুত্থানে আহত ও শহিদদের স্মরণে স্মরণসভা খালেদা জিয়াকে আনতে পেরে আমরা গর্বিত-ড. ইউনূস আজ আল্লামা গোলাম সারোয়ার সাঈদী (র) এর ৫ম ওফাত দিবস কসবায় ১০ হাজার ৬শ ৫০জন প্রান্তিক কৃষকের মাঝে বীজ ও সার বিতরণ শিশু মুনতাহার মরদেহ মিলল পুকুরে
সম্প্রীতির বাংলাদেশ আখাউড়ায় মুসলমানদের সহযোগিতায় উদ্ধার হলো শ্মশাণ

সম্প্রীতির বাংলাদেশ আখাউড়ায় মুসলমানদের সহযোগিতায় উদ্ধার হলো শ্মশাণ

নিডস নিউজ ডেক্সঃ

এক সময়ের হিন্দু অধ্যুষিত ব্রাহ্মণবাড়িয়ার আখাউড়া উপজেলার ধরখার ইউনিয়নের রুটি গ্রামে সর্বসাকুল্যে ২০ টি হিন্দু পরিবারে জনা পঞ্চাশেক মানুষের বসবাস। সেখানকার শ্মশাণে সৎকারে বাধা ও জায়গা দখল বিষয়ে খোঁজ নিতে প্রশাসনের লোকজন আসছেন শুনে জড়ো হয়েছেন পাঁচ শতাধিক মানুষ।
মুসলিম সম্প্রদায়ের ওই মানুষদের একই কথা জায়গাটি শ্মশাণ হিসেবেই ব্যবহৃত হতো ও কাগজপত্রেও তা সার্বিক বিবেচনায় প্রশাসনের পক্ষ থেকে সেখানে লাল নিশান টানিয়ে জায়গাটিকে শ্মশাণ হিসেবে ব্যবহারের কথা বলা হয়। এ সময় মুসলমানদের বানিয়ে আনা শ্মশাণের দু’টি সাইনবোর্ডও টানিয়ে দেয়া হয়।
শ্মশাণটির পরিমাণ ৮২ শতাংশ। উদ্ধারের পর এখানে নিয়মিত পূজা অর্চণা ও এ বছর দুর্গাপূজা করার পরিকল্পনা নেয়া হচ্ছে। স্থানীয়ভাবে একটি কমিটি করার জন্য উদ্যোগ নেয়া হয়েছে। এসব কাজেও স্থানীয় মুসলমানরা সহযোগিতা করছেন।
শ্মশাণ উদ্ধারে শুরুর ভ‚মিকা মুসলমানদেরই। আগস্টের তৃতীয় সপ্তাহে রুটি গ্রামের বেশ কয়েকজন মুসলমান ব্যক্তি শ্মশাণ দখল বিষয়ে আখাউড়া পৌরসভার মেয়র ও উপজেলা যুবলীগের আহবায়ক তাকজিল খলিফা কাজলকে অবহিত করেন। পরবর্তীতে মুসলমান সম্প্র্রদায়ের লোকজন স্থানীয় কয়েকজন হিন্দুকে নিয়ে মেয়রের কাছে আসেন ও এ বিষয়ে অবগত করেন। বিষয়টি নিয়ে সংবাদ করার জন্য এ প্রতিবেদককেও আহবান জানানো হয় ওই আলোচনাকালে। পরে প্রতিবেদক ২৮ আগস্ট সরেজমিনে গিয়ে শ্মশাণে সৎকার করতে গেলে প্রতিবেশিদের বাধার বিষয়টি স্থানীয়দের কাছ থেকে নিশ্চিত হন।
এদিকে বিষয়টি নিয়ে আলোচনা শুরু হলে প্রশাসনিকভাবে উদ্ধারের উদ্যোগ নেয়া হয়। কাগজপত্র ঘেঁটে জায়গাটি শ্মশাণের নিশ্চিত হওয়ার পর রবিবার দুপুরে অভিযান চালায় উপজেলা প্রশাসন। সংশ্লিষ্টদেরকে সঙ্গে নিয়ে উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা (ইউএনও) নূর-এ-আলম সেখানে গিয়ে প্রথমে স্থানীয়দের সঙ্গে কথা বলেন। পরে তিনি জায়গার মালিক দাবিকারিদেরকে কাগজ দেখাতে বললে ব্যর্থ হয়। এক পর্যায়ে প্রশাসনের পক্ষ থেকে সেখানে লাল নিশান টানিয়ে দেয়া হয়। পরে স্থানীয় মুসলমান সম্প্রদায়ের লোকজন শ্মশাণের নামে দু’টি সাইনবোর্ড টানিয়ে দেন।
উদ্ধারের পর স্থানীয় বাসিন্দা শুকলাল দেবনাথ জানান, আমরা খুবই খুশি। স্থানীয় মুসলমানরা যেভাবে এগিয়ে এসেছে সেটা বলার মতো না। শুধু রুটি গ্রাম না পাশের ধরখার, রাণীখার, নুরপুর গ্রামের লোকজনও ছুটে এসে শ্মশাণের জায়গা দখলমুক্ত করার জন্য প্রশাসনের প্রতি আহবান জানান। উপজেলা নির্বাহী অফিসার এলাকার লোকজনের সঙ্গে কথা বলে ও কাগজপত্র সম্পর্কে নিশ্চিত হয়ে আমাদেরকে ওই জায়গায় সৎকার করার জন্য নির্দেশনা দেন। এতে কেউ বাধা দিলে জানানোর জন্যও আহবান জানান। এ সময় আখাউড়া থানার অফিসার ইনচার্জ (ওসি) মো. রসুল আহমেদ নিজামীসহ স্থানীয় গণ্যমান্য ব্যক্তিবর্গ উপস্থিত ছিলেন।
সরেজমিন
সম্প্রতি ওই গ্রামে গিয়ে জানা যায়, শহীদ পরিবারের সন্তানহীন নাডু গুপ্ত ও জনু রানী গুপ্ত দম্পত্তি গ্রামের ছেলে মেয়েদের কথা চিন্তা করে বিশাল মাঠ দান করে গেছেন। ওই মাঠটি গ্রামটির জন্য বড় পাওনা। অথচ ওই গ্রামেই সৎকার করা সম্ভব হয় নি মাস দেড়েক আগে প্রয়াত হওয়া জনু রানীর।
মো. রহমত উল্লাহ নামে গ্রামের এক ব্যক্তি জানালেন, নৌকায় করে প্রায় ছয়-সাত কিলোমিটার দূরের আরেক গ্রামে নিয়ে জনু রানীকে দাহ করতে হয়। নিজ গ্রামে শ্মশাণ থাকলেও প্রভাবশালী গোষ্ঠীর বাধার মুখে সেখানে কাউকে সৎকার করা যায় না।
সংশ্লিষ্টদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, ওই শ্মশাণের ভ‚মি নিয়ে প্রভাবশালী সরকার গোষ্ঠীর সঙ্গে এক মামলায় ২০১৬ সালে রায় আসে শ্মশাণের পক্ষে। এরপর থেকেই মূলত ওই গোষ্ঠীর লোকজন শ্মশানটিতে সৎকার করতে বাধা দিয়ে আসছেন। অবশ্য গ্রামবাসীর চাপের মুখে শ্মশাণের পাশে সড়কের ধারে কয়েকজনকে সৎকার (সমাধিস্থ) করতে দেয়া হয়।
জেলা সদর থেকে প্রায় ২২ কিলোমিটার দূরের গ্রাম রুটি। এক সময় পুরোপুরি হিন্দু অধ্যুষিত ওই গ্রামটিতে এখন ২০ পরিবারের মতো বসবাস। এর মধ্যে বেশিরভাগই দেবনাথ সম্প্রদায়ের, যাদের রীতি অনুযায়ি মাটি দেয়া হয়। বাকি গুপ্ত, শীল ইত্যাদি পরিবারের লোকজনকে দাহ করা হয়।
রুটি বাজারে প্রবেশের আগে সেতু পার হয়ে বাম দিকে কয়েকশ’ গজ যেতেই চোখে পড়ে বিশাল আকৃতির বটগাছ। অনেকের মতে, এই বটগাছটিই শ্মশানের সবচেয়ে বড় সাক্ষী। সেখানে জড়ো হওয়া মুসলমান ও হিন্দু সম্প্রদায়ের লোকজন দেখিয়ে দিলেন বটগাছের চারপাশ ঘিরে ৮২ শতাংশ জমি শ্মশাণের। কিন্তু প্রয়াত আমীর হোসেন সরকারের পরিবার ও গোষ্ঠীর লোকজন এখানে সৎকার করতে দেন না। জায়গাটিতে এখন পানি উঠে আছে। একপাশে ছোট্ট একটি ঘর করে রাখা হয়েছে। সরকার পরিবারের লোকজন বিএনপি রাজনীতির সঙ্গে জড়িত।
স্থানীয়দের সঙ্গে কথা বলে ও কাগজপত্র ঘেঁটে দেখা গেছে, জায়গাটি নিয়ে ২০০২ সাল থেকে মামলা চলমান। আমীর হোসেন সরকার মালিকানা দাবি করে ও মনি দেবনাথ জায়গাটি সরকারি দাবি করে মামলা লড়েন। ২০১৬ সালের ব্রাহ্মণবাড়িয়া আদালতের এক রায় শ্মশাণের পক্ষে আসে। এরপর আমীর হোসেনের পক্ষে আপীল করা হলেও হেরে যান। বর্তমানে আমীর হোসেন ও মনি দেবনাথ দু’জনই প্রয়াত। আমীর হোসেনের মালিকানা দাবির সূত্র ধরে এখন তাঁর ছেলে ও স্বজনরা সৎকারে বাঁধা দেন।
২০০১ সালের সরকারি এক নথিতে দেখা যায়, রুটি গ্রামের ২৩২৫/৪৮২৮, ২৩২৪/৪৮৬৪, ১৩৩৩/৫৭৮৮ দাগে মোট ৮২ শতাংশ জায়গার মালিক বাংলাদেশ সরকারের পক্ষে জেলা প্রশাসক। ওই দাগের ৫৯ শতাংশ জায়গা সমাধির জন্য ব্যবহার্য্য ও ২৩ শতাংশ জায়গা শবদেহ ধৌত করার জন্য ব্যবহার্য্য বলে ওই নথিতে লেখা আছে।
গ্রাম পুলিশ দিলীপ দেবনাথ জানালেন, প্রায় আড়াই বছর আগে তাঁর মা মারা গেলে এখানে মাটি দিতে এসে বাধার সম্মুখীন হন। সরকারের পরিবারের লোকজনের দেখানো জায়গা মতে একটি ব্রিজের পাশে সরকারি জায়গার তাঁর মাকে মাটি দিতে হয়।
গ্রামের চন্দন দেবনাথ, শুকলাল দেবনাথসহ আরো কয়েকজন জানান, শ্মশাণে লাশ নিয়ে গেলেই সরকার গোষ্ঠীর লোকজন লাঠিসোটা নিয়ে তেড়ে আসে। ভয়ভীতি দেখায়। বছর খানেক আগে স্পষ্ট করে জানিয়ে দিয়েছে যে এখানে যেন কারো লাশ আনা না হয়।
এসব কথায় বাদ সাধেন আমীর হোসেন সরকারের ছেলে ফরহাদ সরকার। বলেন, ‘সৎকার করতে আমরা কাউকে বাধা দেই না। জায়গাটি সব সময় পানিতে তলিয়ে থাকে বলে অনেক সময় আমরা নিজেদের জায়গাতেই সমাধির ব্যবস্থা করে দেই। এছাড়া ছেলে মেয়েরা ওই জায়গায় খেলাধুলা করে বলে সেখানে না দিয়ে অন্যত্র দিতে বলি।’
ছুটে এসে আমীর হোসেনের আরেক ছেলে মো. ফরিদ মিয়া সরকার বলেন, ‘এটা আমার বাবার কেনা সম্পত্তি। তবে কার কাছ থেকে কিভাবে কিনেছে সেটা জানি না। ছোটবেলা থেকেই দেখছি বাবা মামলা-মোকাদ্দমা লড়ছে। এখন আমরা লড়ছি। সব কাগজপত্র কোর্টে জমা দেয়া আছে। যে কারণে আমরা কাগজপত্র সম্পর্কে কিছু বলতে পারবো না।’
পাশের নুরপুর গ্রামের মো. শাহ আলম নামে এক ব্যক্তি বলেন, ‘আমরা তো অনেক আগে থেকেই এটা চিতাশাল (শ্মশাণ) হিসেবে চিনি। ভয়ে সন্ধ্যার দিকে এর আশেপাশে থাকতাম না। এখন এটা দখল হতে চলেছে।’ এখানে সৎকারে বাধা দেয়া হয় বলে তিনি জেনেছেন বলে জানান।
উদ্ধারের পর যে যা বললেন
শ্মশাণটি উদ্ধারে শুরু থেকেই এগিয়ে আসাদের একজন ওই গ্রামেরই মো. সারোয়ার আলম রাসেল। কালের কণ্ঠকে তিনি বলেন, ‘এখানকার হিন্দু সমাজের একমাত্র শ্মশাণ এটা। কিন্তু সরকার গোষ্ঠীর লোকজনের বাঁধার মুখে এখানে সৎকার করতে পারতো না। মাঝে মাঝে আমরা এগিয়ে গিয়েও সমাধান করতে পারি না। শেষ পর্যন্ত আমরা মেয়রের শরনাপন্ন হই। রবিবার দুপুরে ইউএনও এসে শ্মশাণের জায়গায় লাল নিশান দিয়ে গেছেন। সৎকারে যেন বাধা না দেয়া হয় সেটি ‘প্রতিপক্ষকে’ বলে গেছেন। এখন আমরা সবাই মিলে এখানে পূজা-অর্চণাসহ অন্যান্য ধর্মীয় অনুষ্ঠান কিভাবে করা যায় সে বিষয়ে হিন্দুদেরকে সহযোগিতা করবো।’
ধরখার ইউনিয়ন পরিষদ সদস্য মো. আমিনুল ইসলাম বলেন, ‘আমরা ছোটবেলা থেকেই জানি এটা শ্মশাণের জায়গা। শেষ পর্যন্ত জায়গাটি উদ্ধার হওয়ায় খুবই ভালো হলো। আমরা সবাই হিন্দুদের সহযোগিতা করবো যেন যে কোনো ধরণের অনুষ্ঠান আয়োজন করতে পারেন।’
আখাউড়া পৌরসভার মেয়র ও উপজেলা যুবলীগের আহবায়ক মো. তাকজিল খলিফা কাজল বলেন, ‘শ্মশাণটির উদ্ধার তৎপরতা সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতির একটা অনন্য উদাহরণ। আমাদের এলাকা আইনমন্ত্রীর সংসদীয় এলাকা। এখানে কেউ সম্প্রীতি বিনষ্ট করে রক্ষা পাবে না। উদ্ধারের বিষয়টি জানার পর মন্ত্রী মহোয়দয় খুবই খুশি হয়েছেন। মহৎকাজে সহযোগিতাকারিদের প্রতি তিনি কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করেছেন।’
এক প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, ‘সেখানকার মুসলমান ও হিন্দু সম্প্রদায়ের লোকজন এসে আমাকে বিষয়টি জানানোর পর স্থানীয় সংসদ সদস্য ও আইনমন্ত্রী আনিসুল হককে অবহিত করি। তিনি বলেছেন, অন্যায়ের বিরুদ্ধে কোনো আপস নয়। সেই মোতাবেক প্রশাসনের সঙ্গে বিষয়টি নিয়ে আলোচনা করা হয়।’
ইউএনও নূর-এ-আলম বলেন, ‘কাগজপত্র অনুযায়ি জায়গাটি শ্মশাণের। আমরা যাওয়ার পর চার-পাঁচশ মানুষ উপস্থিত হয়েও একই কথা বলেছেন। এ অবস্থায় এখানে সৎকার করতে যেন বাধা না দেয়া হয় সেটি বলে দেয়া হয়েছে। যারা মালিকানা দাবি করেছে তারা কোনো কাগজপত্র দেখাতে পারে নি।’
আইনমন্ত্রী আনিসুল হক এম.পি সোমবার বলেছেন, ‘বিষয়টি জানার পর আমরা সঙ্গে সঙ্গে ব্যবস্থা নিয়েছি। আমরা সব সময়ই সম্প্রীতিতে বিশ্বাসি। জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান ধর্মনিরপেক্ষতার কথা বলেছেন। কিন্তু মাঝখানে খুনি জিয়া আর বেগম জিয়া সেই সম্প্রীতি নষ্ট করেছেন। এখন শেখ হাসিনার নেতৃত্বাধীন সরকার আছে বলেই এমন কাজগুলো সম্ভব হচ্ছে।’

এই সংবাদটি শেয়ার করুনঃ

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *




raytahost-demo
© All rights reserved © 2019
ডিজাইন ও কারিগরি সহযোগিতায়: Jp Host BD