পাভেল আমান
বর্তমান কালে আসমুদ্রহিমাচল সাম্প্রদায়িক শক্তির আগ্রাসন চরমতম আকার ধারণ করেছে। বিগত ২০১৯ সালের লোকসভা নির্বাচনে হিন্দুত্ববাদী রাজনৈতিক দল বিজেপি-র নিরঙ্কুশ সংখ্যাগরিষ্ঠতা অর্জন এবং অঙ্গরাজ্য পশ্চিমবঙ্গে প্রাপ্ত ভোটের হিসেবে প্রধান রাজনৈতিক বিরোধী শক্তি হয়ে মাথাচাড়া দিয়ে
আগ্রাসী রূপে একটা জায়গায় নিয়ে গিয়েছে সম্প্রীতির পিঠস্থান পশ্চিমবঙ্গে। মাত্র ১ বছরের কিছু বেশি সময়ের মধ্যে জম্মু ও কাশ্মীরের বিশেষ সাংবিধানিক অধিকার অনুচ্ছেদ ৩৭০ ও অনুচ্ছেদ ৩৫(ক) অবলুপ্তি, এনপিআর-এনআরসি-সিএএ, রাজধানী দিল্লীর বীভৎস দাঙ্গা, বিবিধ সাম্প্রদায়িক রসদে ঠাসা জাতীয় শিক্ষানীতি, রাষ্ট্রীয় সন্ত্রাস, নয়া শ্রম বিধি, কৃষি বিল, দেশের বিপুল পরিমাণ সম্পদ পুঁজিপতি শ্রেণীর হাতে নির্বিচারে তুলে দেওয়া হচ্ছে। রিমি আসছে সাধারণ মানুষের মধ্যেই নিরাপত্তাহীনতা, রুটি রুজির সংস্থান হীনতার বিবিধ অভিঘাত। বিপর্যয় স্বরূপ নেমে আসছে ক্রমান্বয়ে একাধিক জনস্বার্থবিরোধী পরিকল্পনা চিন্তাভাবনা। চরম আগ্রাসী মনোভাবে সাম্প্রদায়িক, গ্রুপ হিন্দুত্ববাদী সংগঠন সংঘ-পরিবার আজ দুর্বার গতিতে বহুত্বের মিলন ক্ষেত্র, বৈচিত্রের ঐক্য নানা ভাষা নানা মতের ভারতভূমিকে একটি অকল্পনীয়, অসহিষ্ণু রাষ্ট্রে পরিণত করার দিকে নিরন্তরভাবে এগিয়ে চলেছে। যেখানে অবিরাম রাষ্ট্রশক্তি সাম্প্রদায়িক শক্তিকে প্রণোদনা উৎসাহ যুগিয়ে চলেছে তাদের কাঙ্খিত প্রস্তাবনাকে পরিপূর্ণ করার জন্য। কিন্তু, শুধুমাত্র শ্রমজীবী বিরোধী কয়েকটি সিদ্ধান্ত বা সাম্প্রদায়িক হানাহান দেখে বর্তমান সময়ের ভয়াবহতাকে বুঝলে বা বিচার করলে অবশ্যম্ভাবী ভুল হবে। ভূতপূর্ব তা বহুবার সংঘটিত হয়েছে। এবারের পার্থক্য এটাই- সাম্প্রদায়িক ও উগ্র হিন্দুত্ববাদী রাজনৈতিক দল যে তারা সংসদের উভয় কক্ষে সার্বিক আধিপত্যে কর্তৃত্বের দিকে এগিয়ে যাচ্ছে তাই নয়, ভারত রাষ্ট্রের ফেডারেল কাঠামো, আইন ব্যবস্থা, প্রশাসন, বিচার ব্যবস্থা, গণমাধ্যম সব ক্ষেত্রেই এক চূড়ান্ত দমনমূলক প্রতিবিপ্লবী মোড়বদলের মুখোমুখিতে অবতীর্ণ হয়েছে।
এই অসহনীয় পরিস্থিতিতে আমাদের সম্প্রীতির রাজ্য পশ্চিমবঙ্গও এক কঠিন সঙ্কটের অভিমুখের চৌকাঠে পা দিয়ে আছে। আজ উগ্র সাম্প্রদায়িক শক্তি এই নির্ঝঞ্ঝাট শান্তিপূর্ণ রাজ্যকেও দখল করতে কোমর বেঁধে লেগে পড়েছে। শুরু হয়ে গেছে একের পর এক প্রচার মিটিং মিছিল। বাঙালি আবেগকে উস্কে দিয়ে চলছে রাজনৈতিক জমি দখলের মনস্তাত্ত্বিক লড়াই।স্বাধীনতার পর থেকে আজ অবধি বিভিন্ন দলীয় শাসন এরাজ্যের মানুষ প্রত্যক্ষ করেছি। বিভিন্ন পর্বে সেই দলীয় শাসনের একাধিক জনস্বার্থ বিরোধী ভূমিকার প্রতি মাত্রাতিরিক্ত বীতশ্রদ্ধ ও বিরাগভাজন হয়ে জনসাধারণ অন্য কাউকে বেছে নিয়েছেন গণতান্ত্রিক অধিকার প্রদানের মাধ্যমে। বর্তমান শাসকের ক্ষেত্রেও একাধিক জনবিরোধী ভূমিকা মানুষকে শুধু মোহাবিচ্যুত করেনি, কেন্দ্রের ক্ষমতাসীন রাজনৈতিক দল বিজেপি-র এরাজ্যে ক্ষমতায় আসার পথকে সুগমও প্রশস্ত করে চলেছে। পূর্বতন শাসক দলগুলির নিষ্ক্রিয়তা তাকে আরো ত্বরান্বিত করেছে। যার ঢেউ বিগত লোকসভায় স্পষ্ট প্রতীয়মান।
২০১৪-সালের পর থেকে একাধিক পরিকল্পিত সাম্প্রদায়িক দাঙ্গা ঘটানো, হিন্দুত্ববাদী সঙ্ঘ পরিবারের বিভিন্ন শাখার সামাজিক বিস্তারকে কাজে লাগিয়ে সমস্ত রকম সামাজিক বিভেদের নৃশংস বৈষম্যকে জাগিয়ে তোলা,উস্কে দেওয়া, তার সাথে সাথে আইটি সেল এর মাধ্যমে ভুয়ো, ভিত্তিহীন, মনগড়া, মিথ্যা খবর ও অভূতপূর্ব পরিমাণ টাকা ছড়িয়ে দিয়ে রাজনীতির ময়দানে ঘোড়া কেনাবেচা – এই সব কিছুর মাধ্যমে বিজেপির পক্ষে ফ্যাসিস্টরা একটা ভুয়ো ও মিথ্যে “বাতাবরণ” তৈরি করে চলেছে। রাজ্য শাসকদলের অগণতান্ত্রিক আচরণ, রাজনৈতিক হিংসা ও দুর্নীতির ঘটনাগুলো তাদের এই কাজকে সুগম করে দিয়েছে।
২০১৯ এর নির্বাচনের ফলাফলে এভাবে প্রধান বিরোধী দলের জায়গা দখল করে রক্তের স্বাদ পাওয়া সাম্প্রদায়িক শক্তি আরএসএস এখন এরাজ্যের মসনদে বিজেপি-কে বসানোর জন্য চরমভাবে মরিয়া হয়ে উঠেছে। ধর্মীয় বিভাজন, জাতপাতের রাজনীতি, ফ্যাসিস্ত উপাদানে ভরা শিক্ষানীতি, এনপিআর-এনআরসি লাগু, সিএএ দিয়ে একাধারে সাম্প্রদায়িক বৈষম্য এবং পশ্চিমবঙ্গে স্থায়ীভাবে বসবাস করেন এমন উদ্বাস্তুদের উৎখাতের ষড়যন্ত্র, মিথ্যে দেশপ্রেম, উগ্র জাতীয়তাবাদ ইত্যাদিকে ভোট বৈতরণী পার হতে রাজনৈতিক এজেন্ডা ও হাতিয়ার করে এরা সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতির পীঠস্থান তথা ধর্মনিরপেক্ষ সংস্কৃতির আঁতুড়ঘর সর্বোপরি রবীন্দ্র-নজরুল জন্মস্থান পশ্চিম বাংলার সমস্ত ধরনের গণতান্ত্রিক, চিন্তাশীল, উদার মনোভাবাপন্ন,প্রগতিশীল, প্রতিবাদী ও সাংস্কৃতিক ঐতিহ্যকে ধ্বংস করতে উঠে পড়ে লেগেছে। এই রাজনৈতিক দর্শন বিশ্বাস করে যে ভারতকে একটা ফ্যাসিবাদী রাষ্ট্রে পরিণত করতে গেলে বাংলার এই সনাতন, সহনশীল সম্প্রীতির চিরায়ত ঐতিহ্যকে সমূলে উৎপাটন করা সমূহ জরুরি। সেই অভিষ্ঠ লক্ষ্যপূরণে এরাজ্যের রাজনৈতিক ক্ষমতা দখল করা এদের কাছে আশু কর্তব্য হিসেবে পরিগণিত হচ্ছে। যার রূপরেখা বাস্তবায়নে তারা সর্বতোভাবে ঝাঁপিয়ে পড়েছে। ফ্যাসিস্ত শক্তিটি তাই আজ সর্বশক্তি দিয়ে পশ্চিমবঙ্গ দখলের জন্য বিবিধ পরিকল্পনায় ব্যস্ত।
এই দুর্বার পরিস্থিতিতে বাংলার বুকে এই ফ্যাসিস্ত শক্তির আগ্রাসনকে প্রতিহত করার লক্ষ্যে বাংলার সমস্ত গণতান্ত্রিক-ধর্মনিরপেক্ষ-প্রগতিশীল-প্রতিবাদী জনগণের এক ঐক্যবদ্ধ গণ-প্রতিরোধ গড়ে তোলা আবশ্যিক হয়ে উঠেছে। জরুরি হয়ে উঠেছে বিজেপি-আরএসএস-কে রাজনৈতিক ও সামাজিক ক্ষেত্র থেকে উৎখাতের ডাক দেওয়া। বাংলার সাম্প্রদায়িক-বিরোধী বিবেককে জাগ্রত করতে আজ আমাদের পথে নামার প্রয়োজন। এই উগ্র জাতীয়তাবাদী সাম্প্রদায়িকতার মোড়কে দক্ষিণপন্থী রাজনৈতিক শক্তির প্রকৃত চেহারাটা এরাজ্যের সাধারণ মানুষের সামনে স্পষ্টভাবে তুলে ধরতে হবে। সেই লক্ষ্যে আসন্ন পশ্চিমবঙ্গ বিধানসভা নির্বাচনের পরিপ্রেক্ষিতে এদেরকে সর্বশক্তি দিয়ে প্রতিরোধ করা এই গণ-উদ্যোগের আশু করণীয় হওয়া উচিত। এরাজ্যের অগণিত শুভবুদ্ধিসম্পন্ন বিবেকবান মানুষ দের একত্রিত হতে হবে এই রাজনৈতিক অপশক্তিকে রুখে দেওয়ার জন্য। বাংলা সংস্কৃতি, বাঙালির আবেগ, বাঙালি চেতনাকে বাঁচিয়ে রাখতে গেলে এই দক্ষিণপন্থী উগ্র জাতীয়তাবাদী বিভেদ সৃষ্টিকারী গণতন্ত্রের প্রতিবন্ধক সাম্প্রদায়িক মতাদর্শি রাজনৈতিক দল কে, দলমত নির্বিশেষে জাতি-ধর্ম-বর্ণ ঐক্যবদ্ধভাবে ভোটের ময়দানে লড়াইয়ের মধ্য দিয়ে পরাস্ত করতে হবে। আমাদের জাতি ধর্ম বর্ণ নির্বিশেষে বাঙালি সংস্কৃতি ,কৃষ্টি, চেতনা, ভাবাদর্শ আবেগে উদ্বেলিত ,সঞ্চারিত, অনুপ্রাণিত হয়ে আমাদের ধর্মনিরপেক্ষ, সম্পত্তির পিঠস্থান, পশ্চিমবঙ্গকে তার সনাতন ঐতিহ্য রক্ষার্থে এগিয়ে আসতে হবে। যেকোনোভাবে উগ্র সাম্প্রদায়িক শক্তির মোকাবিলা করে তাদের বিভীষিকা, ভয়ঙ্কর, শ্রেণি বিদ্বেষের অমানবিক নীতিকে প্রতিহত করতে হবে।
– হরিহরপাড়া- মুর্শিদাবাদ
Leave a Reply