ছবি: সংগৃহীত
নিউজ ডেস্কঃ
ভাসানচরে আসা রোহিঙ্গাদের কর্মসংস্থানের ব্যবস্থা করছে সরকার। এজন্য তাদের প্রশিক্ষণও দেওয়া হবে। সরকারের সঙ্গে ২২টি এনজিও এবং বিভিন্ন সংস্থা কাজ শুরু করেছে নোয়াখালীর হাতিয়ার এ দ্বীপে। অর্থনৈতিক কর্মকান্ড পরিচালনার জন্য পালন করা হচ্ছে মহিষ, ভেড়া, হাঁস, কবুতর। আবাদ করা হচ্ছে বিভিন্ন ধরনের শাকসবজি। ধান চাষও হচ্ছে পরীক্ষামূলকভাবে।
এদিকে সরকারের এমন সব পদক্ষেপে এখানে আসা রোহিঙ্গারা স্বস্তির কথা জানিয়েছেন। অনেকেই আত্মীয়-স্বজনদেরও কক্সবাজার থেকে ভাসানচরে নিয়ে আসার কথা ভাবছেন। স্ত্রী ও দুই সন্তান নিয়ে ভাসনচরে এসেছেন মোহাম্মদ হোসেন। আর বালুখালী ক্যাম্প থেকে রেখে এসেছেন বাবা-মা ও ভাইয়ের পরিবার। তিনি বলেন, এখানে অনেক ভালো লাগছে। আমি এখানে ঘুরেফিরে আবার কক্সবাজার যাব। ওখানে গিয়ে নিয়ে তাদের নিয়ে আসব। আর তারা যদি না আসে, তাহলে আমি আবার এখানে ফিরে আসব।
কক্সবাজারের কুতুপালং ক্যাম্প থেকে ভাসানচরে আসেন মোহাম্মদ জোবায়ের। তিনি বলেন, এত ভালো পরিবেশের কথা আমরা ভাবতেই পারছি না। জীবনে আমরা এত ভালো বাসায় থাকতে পারিনি, থাকতে পারব এটাও আশা করিনি। কক্সবাজারের ক্যাম্পে থাকা মিয়ানমারের বাস্তুচ্যুত ১১ লাখ নাগরিকের মধ্যে এক লাখ জনকে আনতে প্রায় ৩১০০ কোটি টাকা ব্যয় করে ভাসানচরে আশ্রয়ণ প্রকল্প তৈরি করেছে বাংলাদেশ সরকার।
স্থানান্তরের প্রথম ধাপে গত বৃহস্পতি ও শুক্রবার কক্সবাজারের বিভিন্ন ক্যাম্প থেকে বাসে এবং জাহাজে করে দুই দিনের দীর্ঘ যাত্রা শেষে রোহিঙ্গার প্রথম দলটি দুপুরে নোয়াখালীর হাতিয়ার কাছের ১৩ হাজার একর আয়তনের দ্বীপ ভাসানচরে পৌঁছে। এরপরই তাদের বুঝিয়ে দেওয়া হয় সারি সারি লাল ছাউনির বাড়িগুলোতে; আর নতুন ঠিকানায় পৌঁছানো প্রায় সবারই চোখেমুখে দেখা গেল আনন্দের ছাপ। তাদের কেউ কেউ মোবাইল ফোনে নতুন ঠিকানার খবর জানাচ্ছিলেন কক্সবাজারের পুরনো ঠিকানায় রেখে আসা সঙ্গীদের, ভিডিও কলে দেখাচ্ছিলেনও। খোলা জায়গা পেয়ে শিশুরা মেতে ওঠে খেলায়। ভাসানচর দেখে রোহিঙ্গাদের অনেকে মোবাইল ফোনে নতুন ঠিকানার খবর জানাচ্ছিলেন কক্সবাজারের পুরনো ঠিকানায় রেখে আসা সঙ্গীদের।
জাতিসংঘসহ বিভিন্ন মানবাধিকার সংস্থা রোহিঙ্গাদের ভাসানচরে স্থানান্তরের বিরোধিতা করে আসছে; যদিও বাংলাদেশ সরকার বলছে, এ স্থানে রোহিঙ্গারা স্বাচ্ছন্দ্যের সঙ্গে নিরাপদে থাকতে পারবে। ভাসানচর প্রকল্প আর কক্সবাজারের ক্যাম্পের মধ্যে পার্থক্য বোঝাতে গিয়ে রোহিঙ্গা জোবায়ের বলেন, দুটির মধ্যে তুলনাই হয় না। ওইটা পলিথিনের বাসা, এখানে পাকা ঘর। অনেক ভালো লাগছে এখানে। স্ত্রী ও তিন সন্তান নিয়ে ভাসানচরে আসা জোবায়ের আর কখনো কক্সবাজারের ক্যাম্পে ফিরতে চান না বলেও জানান।
প্রিয়জনের লাশ আর পুড়তে থাকা ভিটেমাটি পেছনে ফেলে প্রাণ হাতে করে তিন বছর আগে মিয়ানমার থেকে বাংলাদেশে পালিয়ে আসে প্রায় সাত লাখ রোহিঙ্গা। তার আগে থেকেই বাংলাদেশে আশ্রয় নিয়েছিল আরও প্রায় পাঁচ লাখ রোহিঙ্গা। কক্সবাজারের আশ্রয়শিবিরে গাদাগাদি করে থাকার পাশাপাশি নিরাপত্তার অভাবও প্রকট হয়ে উঠেছিল। ক্যাম্পগুলোতে খুনের ঘটনাও ঘটছে প্রায়ই। এছাড়া মাদকসহ নানা অপরাধমূলক কর্মকান্ডের খবরও আসছে প্রতিনিয়ত। তাই ভাসানচরে পৌঁছেই নিজেকে অনেকটা নিরাপদ ভাবছেন বালুখালীর ক্যাম্প থেকে আসা আবদুর রহমান।
তিনি বলেন, ওখানে আমার ভয় লাগছিল। চলাফেরা করতে গেলে বিভিন্ন মানুষ আমার গায়ে হাত দিয়েছে। এখানে সেই সমস্যা নেই। আমি ভালোভাবে চলতে চাই। ওখানে প্রয়োজনে বাইরে যেতে গেলেই কেউ বলত চোর, কেউ বলত অমুক। এখন এখানে কেউ সেটা বলবে না।
এদিকে সরকারের অতিরিক্ত শরণার্থী, ত্রাণ ও প্রত্যাবাসন কমিশনার মোহাম্মদ শামসু-দ্দৌজা বলেন, আপাতত ২২টি এনজিওর মাধ্যমে এই রোহিঙ্গাদের খাবার, স্বাস্থ্যসেবা ও অন্যান্য প্রয়োজন মেটানো হবে। প্রথম সাত দিন তাদের রান্না করা খাবার খাওয়ানো হবে। এর মধ্যে প্রত্যেক পরিবারকে দেওয়া হবে এলপিজি সিলিন্ডার। তখন তারা নিজেরাই রান্না করে খেতে পারবে। এই এনজিওগুলো তাদের খাদ্য সরবরাহ করে যাবে।
রোহিঙ্গাদের জন্য প্রায় ৩ হাজার ১০০ কোটি টাকা ব্যয় করে ভাসানচরে আশ্রয়ণ প্রকল্প তৈরি করে বাংলাদেশ সরকার। দ্বীপের ১ হাজার ৭০২ একর জমির চারপাশে উঁচু বাঁধ নির্মাণ করা হয়েছে জোয়ার ও জলোচ্ছ্বাসের ঝুঁকি থেকে রক্ষার জন্য। এর ভেতরেই রোহিঙ্গাদের আবাসন ও অন্যান্য স্থাপনার জন্য ৪৩২ একর এবং ভবিষ্যতে প্রকল্পের সম্প্রসারণ ও বনায়নের কাজে ৯১৮ একর এলাকা রাখা হয়েছে।
রোহিঙ্গাদের থাকার প্রতিটি ক্লাস্টারের জন্য রয়েছে একটি করে চার তলা কম্পোজিট স্ট্রাকচারের শেল্টার স্টেশন। এই শেল্টার স্টেশন ঘণ্টায় ২৬০ কিলোমিটার গতিবেগের ঘূর্ণিঝড়েও টিকে থাকতে সক্ষম। প্রতিটি হাউসে বসবাসকারী নারী-পুরুষদের জন্য রয়েছে আলাদা গোসলখানা ও টয়লেটের ব্যবস্থা। প্রতিটি হাউসের ছাউনির ওপর রয়েছে সৌর বিদ্যুতের প্যানেল। ঘরে আছে পানি সরবরাহের ব্যবস্থা।
Leave a Reply