বিদিশা মুখার্জী
কলকাতা
আচ্ছা, একটা সত্যি কথা এইবেলা আমার কাছে কবুল করবেন, আমিও তাহলে নিজের কটা কথা বলে একটু হাল্কা হই।বলছি কি,নিজের বয়েস যে বেড়ে গেছে মুখে বললেও মানতে পারেন কি?আমি কিন্তু প্রায়ই ভুলে যাই, আর তার ফলস্বরূপ প্রথম জ্ঞান হওয়া ইস্তক যে যেসব আচরণ করে আসছি তা এখনও করে ফেলি।ছোটো থেকেই আমার এক বড় দোষ হলো কারুকে চোখের সামনে পা পিছলে পড়ে যেতে দেখলে হাসি চাপতে পারি না।কেউ আমার সামনে পড়ে গেলে তাকে হাত ধরে তোলার কথা প্রায় ভুলেই যায়,ভিলেন হাসি চাপতে আমাকে যে কত পন্থা অবলম্বন করতে হয় কি বলব আপনাদের।এই নিয়ে কম জলঘোলা হয়নি, বাবার কানমোলা থেকে বোনের আঁচড় পযর্ন্ত ,এমনকি বন্ধুরা রাগ করে কথাও বন্ধ করে দিয়েছে।কিন্তু আমি নাচাড় ,”স্বভাব যায় না মলে”,এ তো সবাই জানে।তাই এখন আর কেউ শোধরাবার চেষ্টা করেনা,পাগলের প্রলাপ ভেবে বেপাত্তা করে।কিন্তু কোনো সময় এটা মাত্রাতিরিক্ত হয়ে যায় সেটা আমিও জানি।সেই গল্পখানা আজ বলব,হলোকি জানেন আমার বৌভাতের দিন রাতে শাশুড়ি ঠাকরুনের পা পিছলে পড়ে যাওয়া।বিয়ে শুরু হওয়া থেকে বেশ মিষ্টি হেসে নববধূ সুলভ আচরণ করেই চলছিলাম,তিনদিন এরকম আচরণ জারি ছিল, তবে শেষ রক্ষা হলো না।যাই হোক ,ব্যাপারটা খুলে না বললে বিন্দু বিসর্গ বুঝবেন না,হলো কি জানেন যেদিন থেকে বিয়ের কথা ফাইনাল হলো মা আমার কানের কাছে রাজ্যের ভালো কথা রানিং কমেন্ট্রি চালাচ্ছিলেন।নতুন বউদের স্বভাব কেমন হওয়া উচিত তাই নিয়ে।বলছিলেন(কি করে যে আশা করছিলেন জানি না, গর্ভধারিণী মাহয়েও মেয়ের আজন্মের স্বভাব কে উপেক্ষা করে) নতুন বউদের লাজুক হাসতে হয়,অল্প কথা বলতে হয় ইত্যাদি প্রভৃতি……… আরে,হঠাৎ বউ হয়েছি বলে আমূল পাল্টি খেতে হবে,কস্মিনকালেও লাজুক হাসিনি রাবন বেঁচে থাকলে আমার হাসির শব্দে তার পিলে চমকে উঠত ,বেটা হাসি ভুলে যেত,বেটাকে রামের হাতে মরতে হতো না আমার অট্টহাসিতে ই নিকেশ হয়ে যেত।কিন্তু সেসুযোগ পেলাম কই।এখনও একাজটি করতে পারি রাবন কি দেশে কম পড়িয়াছে?শুধু সময়সুযোগ পাওয়ার অপেক্ষা।আরে,অত অধৈর্য্য হচ্ছেন কেন?সবসময় কি স্মুদ স্পুন ফিড করানো যায়,একটু চলকে পড়তেই পারে, তাই আমার কথাও একটু ট্র্যাক ছাড়ছে জানি।ছাড়ুন,পথে চলে এসেছি।ঘটনাটি এরকম,মায়ের কথাগুলো শোনার চেষ্টায় করেছিলাম তখন।যতই হোক শিকড় উপড়ে উঠে আর এক জায়গায় গিয়ে শিকড় ছড়ানো অভিজ্ঞ রাই মেনে চলায় সমীচীন মনে হলো।কারণ নতুন জায়গায় আমার অট্টহাসিতে কেউ হার্ট ফেল করুক এটা ঠিক কাম্য নয়।যদিও ঠারেঠোরে হবু বরের কাছে কথাখানি পেড়েও রেখেছিলাম যে আমার ভয়ানক হাসির বাতিক আছে কিন্তু তখন তিনি রঙ্গিন স্বপ্নে ভাসছিলেন,হবু বউ এর সবই সঠিক বলছিলেন।আমি ও তাই আর বেশি ঘাঁটায়নি।জীবনে প্রথম বার মায়ের কথা র বাধ্য হলাম, নাহলে অতি বড় শত্রু ও আমাকে বাধ্য মেয়ে বলে নিন্দে করতে পারবে না।এমনকী ভগবান যিনি এই কুকর্মটি করেছেন, মানে আমার মধ্যে প্রতিবাদী গুণটি আপলোড করেছেন তিনিও অপকর্ম টি অস্বীকার করতে পারবেন না।ভালোই ভালোই বিবাহ আর শ্বশুরালয় গমন কার্যটি ঘটল,ছন্দপতন ঘটেনি কোনো।বরযাত্রী দের মধ্যে একটা আলোচনা য় এটাও শুনলাম’খুব মিস্টি হাসির বউ’।মনের মধ্যে নানা কষ্টের কথা টেনেএনে অট্টহাসি টিকে নিরস্ত করলাম।বিধাতাঠাকুরটি মহা শয়তান, সে বেটাও আমার সাথে মিষ্টি হাসি হাসি হেসে রেখেছিল,সেটা তখন ঘুণাক্ষরেও টের পাইনি।শ্বশুর বাড়ি পৌঁছনো ও বউভাত -এর রাত্রে অতিথি দের আদর আব্দার সেই পেটেন্ট হাসি দিয়েই সামলালাম।অনুষ্টান প্রায় শেষের মুখে হঠাৎ হৈহৈ রৈরৈ।কোনোরকমে বেনারসী আর মাথার মুকুট সামলে হাজির হলাম অকুস্থলে,গিয়েই দেখি শাশুড়িমাতা প্রপাত ধরণীতলে,আর যাও কোথা,সবভুলে সেই বিকট হাসি ভর করল,যারা শাশুড়ি কে তুলতে যাচ্ছিলেন ভ্যাবাচ্যাকা খেয়ে আমাকে দেখতে লাগলেন।আমি তখন লাজলজ্জাভয় বিসর্জন দিয়ে হেসেই চলেছি,যতবার শাশুড়ির পড়ে যাওয়ার পরের বিব্রত মুখখানি দেখি ততবারই গায়ে সাতশো আরশোলার চড়ে বেড়ানো অনুভব করি,আর দমকে দমকে হেসে উঠি।পিছনে দাঁড়ানো বাবা মা এর অবস্থা ধরণী দ্বিধা হউ এই বেয়াদব মেয়ে নিয়ে আমরা সেঁধিয়ে যায় ।বোন ছোট হলেও বুঝতে পারছিল কাজটা বেঠিক, শুধু আমার কোন পরিবর্তন নাই।বাবা মা সবাই কে সমানে বলে যাচ্ছেন,’কিছু মনে করবেন না’।হঠাৎ শাশুড়ি ও আমার সঙ্গে সমান তালে তাল দিয়ে হেসে উঠলেন।সবাই তো হতবাক।আস্তে আস্তে হাসিখানি সবার মধ্যে ছড়িয়ে গেল।যাই হোক,সেদিন থেকে শাশুড়ি-বউ এর মনের যেবন্ধন তৈরী হলো, সংসারে যত খুটখাট ই লাগুক না কেন শেষ হয় ঐ অট্টহাসি দিয়েই, এমন একখানা প্রাণের দোস্ত আমি জিন্দেগী তে পাইনি এটা অনস্বীকার্য, তাই অট্টহাসি ছাড়িওনি।
Leave a Reply