দীপক সাহা ( নদিয়া জেলা, পশ্চিমবঙ্গ)
সভ্য শিক্ষিত সমাজের পরিশীলিত ধারণার অন্যতম হলো – নারী -পুরুষের বিভেদহীন সমাজ। কিন্তু বাস্তবিক ক্ষেত্রে তার আপেক্ষিক প্রভাব থাকলেও মানসিক ক্ষেত্রে বিভাজনের সমাপ্তি ঠিক কবে তা বলা মুশকিল, তা সে সমাজ যতই প্রগতিশীল বা আধুনিক হোক না কেন। কিন্তু এই বিভাজন নিরসনের প্রয়াস যে শুধু আধুনিক যুগের চিন্তন তা বলা চলে না। আর এ ব্যাপারে যিনি প্রথম পদক্ষেপ নেন কালক্ষেপ না করে তাঁকেই বিশ্বের প্রথম মহিলা কবি হিসেবে পরিগণিত করা হয়। অন্তত ইতিহাস তো তাই বলে। যে কলমের মাধ্যমে বহু যুগ ধরে সমাজের নানা দিক দেখিয়ে এসেছি আমরা, সেই কলম কিন্তু প্রথম তুলে নিয়েছিলেন এক নারী। লিখেছিলেন নিজের লেখা। তিনি, এনহেদুয়ান্না। বিশ্বের প্রথম মহিলা কবি ।
আজ বলবো তাঁর কথা।
১৯২৭ সাল। সুমেরিয়ান শহর উরে খননকাজে মগ্ন ব্রিটিশ পুরাতত্ত্ববিদ স্যার লিওনার্ড উলি। হঠাৎ খননকাজ চলাকালীন ‘এনহেদুয়ান্না ক্যালসাইট ডিস্ক ‘টি তিনি আবিষ্কার করেন। এরপর মন্দিরের কমপ্লেক্সটিও খনন করে দেখেন সেখানে পরপর সমাধি, পুরোহিতদের। নতুন ইতিহাস। লিওনার্ড উলি সুন্দরভাবে এনহেদুয়ান্না সম্পর্কে লিখেছেন। তাঁর লেখা থেকে পাওয়া যায় —এনহেদুয়ান্না এরিডু, সিপ্পার এবং এসনুন্না সহ আক্কাদের মন্দিরে ৪২টি স্তব রচনা করেছিলেন। সবকটিই নান্না এবং ইনান্না-কে উদ্দেশ্য করে লেখা। সুমেরিয়ান প্রদেশের উর এবং নিপপুর থেকে পাওয়া তথ্য পুনর্গঠন করে একটি সংগ্রহ করা হয়েছে , যা ‘দ্য সুমেরিয়ান টেম্পল হিমনস’ নামে পরিচিত। মন্দিরের পাথরের গায়ে খোদাই ছিল বেশ কিছু কবিতা। যেগুলোর নিচে এনহেদুয়ান্নার স্বাক্ষরও ছিল। সেই প্রথম বিশ্ব পেল তার প্রাচীনতম মহিলা কবি।
চন্দ্রদেবী সুয়েনের মন্দিরে ধ্যানমগ্ন এক যুবতী, পদ্মাসনে উপবিষ্ট। দুই হাতের করতল সংযুক্ত, ঈষৎ উত্তোলিত। বুকের দুপাশে নগ্ন স্তনের ওপর দুগাছি কালো চুল। সুডৌল বাহুযুগল, উন্মুক্ত পিঠ এবং ঊরুসন্ধির সঙ্গমস্থলে স্ফীত নিতম্ব, যা শ্বেতপাথরের ওপর ছড়ানো একতাল মসৃণ মাংসপিণ্ডের মতো পড়ে আছে। ধু ধু প্রান্তরে মৌন সন্ন্যাসীর মতো দাঁড়িয়ে আছে কয়েকটি ন্যাড়া বৃক্ষ। গোধূলিলগ্ন। সূর্যাস্তের এক চিলতে লাল আভা এসে পড়েছে দেবী সুয়েনের কপালে শোভিত মুকুটের ওপর। প্রার্থনামগ্ন আক্কাদিয়ান যুবতীর নগ্ন অবয়ব থেকে এক অলৌকিক আলোর উজ্জ্বল আভা বিকীর্ণ হচ্ছে। পেছনে সম্রাট সারগনের নেতৃত্বে আক্কাদ সাম্রাজ্যের গণ্যমান্য লোকজন। চন্দ্র দেবীর কাছে আজ ওদের একটিই প্রার্থনা—তিনি যেন এই সাম্রাজ্যকে অসুর লুগাল এনের হাত থেকে রক্ষা করেন।
ওপরে বর্ণিত দৃশ্যটি আজ থেকে ৪ হাজার ২৭৪ বছর আগের, অর্থাৎ যিশুর জন্মের ২২৫৮ বছর আগের। এই প্রার্থনাসভার নেতৃত্ব দিয়েছিলেন যে নারী, তাঁর নাম এনহেদুয়ান্না। তখন তিনি ২৭ বছরের পূর্ণ যুবতী। এনহেদুয়ান্না শব্দের অর্থ অন্তরীক্ষ দেবী। তিনি বিখ্যাত সুমেরীয় সভ্যতার প্রাচীন আক্কাদ দেশের সম্রাট সারগন ও তাঁর স্ত্রী রানি তাশলুলতুমের মেয়ে। অন্য এক মতে, এনহেদুয়ান্না সম্রাট সারগনের (যাঁকে পৃথিবীর সম্রাট বলে অভিবাদন জানানো হতো) মেয়ে নন, তবে রক্তের সম্পর্কিত আত্মীয়া।
শুধু রাজকন্যাই নন, সেই সময় প্রধান পুরোহিত ছিলেন তিনি। মূলত সুমেরীয়’র চাঁদের দেবী নান্না এবং যুদ্ধের দেবী ইনান্নার উপাসক ছিলেন তিনি। তাঁর নামের সঙ্গেও যুক্ত রয়েছেন এই দুই দেবী। মনে রাখতে হবে, সেই সময় এনহেদুয়ান্নার আগে কোনো নারী প্রধান পুরোহিত হননি। শুধু রাজপরিবারে জন্ম নেওয়ার জন্যই নয়, নিজের যোগ্যতা দিয়েই এই পদ পেয়েছিলেন তিনি। সারগনেরও সম্পূর্ণ ভরসা ছিল তাঁর ওপর। এনহেদুয়ান্না ছিলেন অসম্ভব মেধাবী মানুষ; এক নারী, যিনি প্রার্থনাসংগীত ও কবিতা লিখতে পারতেন বলে তৎকালীন সমাজ তাঁকে দেবী হিসেবে পূজা করত। তাঁর পিতা সম্রাট সারগন কন্যা এনহেদুয়ান্নাকে রাজ্যের প্রধান পুরোহিতের সম্মানে ভূষিত করেন।
সুমেরু ভাষার ইনানাই আক্কাদিয়ান ভাষার ইস্তার, পরবর্তীকালে গ্রিকরা যাঁকে আফ্রোদিতি বলে শনাক্ত করে এবং রোমানরা তাঁকে ডাকে ভেনাস বলে, তিনি ছিলেন প্রেমের দেবী। দেবী ইনানার স্তুতি স্তাবকে সমৃদ্ধ এনহেদুয়ান্নার কবিতাগুলোই প্রার্থনাসভা-সংগীতের ভিত্তি নির্মাণ করে। সেই দিক থেকে তিনি ধর্মাবতারের কাজ করেছেন। তাঁর ওপর রাজা সারগনের ছিল পূর্ণ আস্থা। এনহেদুয়ান্নার মাধ্যমেই তিনি সুমেরু দেব-দেবীদের স্থলে আক্কাদিয়ান দেব-দেবীদের আধিপত্য প্রতিষ্ঠার কাজটি করেছিলেন, রাজ্য নিষ্কণ্টক রাখার জন্য এর প্রয়োজন হয়েছিল। এনহেদুয়ান্নার কাব্যপ্রতিভা তৎকালীন মেসিপটেমিয়ার নারীদের শিক্ষা গ্রহণে এগিয়ে আসতে অনুপ্রাণিত করে এবং রাজবংশের নারীদের কবিতা লিখতে উৎসাহিত করে। একসময় এটা প্রায় অবধারিতই হয়ে ওঠে যে রাজকন্যা ও রাজবধূরা অবশ্যই কবিতা লিখতে জানবেন। যদিও তাঁর সমসাময়িককালে আর তেমন উল্লেখযোগ্য কোনো নারী কবির সন্ধান পাওয়া যায়নি। এতে এটাও প্রতীয়মান হয় যে পার্শি বি শেলির কথাই ঠিক, কবিতা একটি ঐশ্বরিক বা স্বর্গীয় ব্যাপার। তিনি অবশ্য স্বর্গীয় বলতে বুঝিয়েছেন মানুষের স্বর্গীয় অনুভূতির কথা।
২২৫০ খ্রিস্টপূর্বাব্দে মাত্র ৩৫ বছর বয়সে পৃথিবী থেকে বিদায় নেন পৃথিবীর প্রথম কবি এই মহীয়সী নারী। তিনি কোনো পুরুষ সঙ্গী গ্রহণ করেছিলেন কি না বা কোনো সন্তান জন্ম দিয়েছিলেন কি না—এ সম্পর্কে কোনো তথ্য জানা না গেলেও এটা অনুমিত যে রাজ্যের প্রধান পুরোহিত হওয়ার কারণে হয়তো সংসারের মতো জাগতিক মায়ার বাঁধনে তিনি জড়াননি।
বিশ্ব ইতিহাসে কেবল প্রথম দিকের জ্ঞাত মহিলা কবিই নন, ইতিহাসের সাথে পরিচিত প্রথম দিকের মহিলাদের একজন, এনহেদুয়ান্না নারীবাদেও যথেষ্ট মনোযোগ পেয়েছেন। আজ থেকে কয়েক হাজার বছর আগে একজন নারীর কাছ থেকেই প্রথম লেখনী পেয়েছিল বিশ্ব। পৃথিবীর প্রথম কবি এনহেদুয়ান্না প্রার্থনা শ্লোক বা দেব-দেবীর স্তুতিবাক্য রচনা করে একটি নতুন দিগন্ত উন্মোচন করেছেন মানব সভ্যতার জন্য। ২০১৫ সালে তাঁকে সম্মান জানিয়ে বুধ গ্রহের একটি গহ্বরের নাম রাখা হয় ‘এনহেদুয়ান্না’। সম্মান দিচ্ছি আমরাও। বিশ্বের প্রথম মহিলা কবিকে। যতদিন পৃথিবী থাকবে ততদিন এনহেদুয়ান্না চিরভাস্বর হয়ে থাকবেন সাহিত্যকর্মী এবং কবিতাপ্রেমীদের মানসপটে।
ছবিঋণ – আন্তর্জাল
Leave a Reply