 
								
                            
                       -হাসনাইন সাজ্জাদী।।
পূৃণ্ড্রদেশ বা পূণ্ড্রবর্ধন প্রাচীন বাংলার উত্তর ও পশ্চিমাংশে অবস্থিত এক সমৃদ্ধ জনপদ ছিল। যার মাটি ও মানুষ ছিল মেধা ও মননে অগ্রগামী। খাটি মানুষের সেই জনপদের আধুনিক নাম উত্তর বঙ্গ। উত্তর বঙ্গ জনপদের  আধুনিক বাংলায় জন্ম নেন এক খাটি মানুষ। তাঁর নাম ফজলুল হক। চলচ্চিত্রে তিনি মনি চৌধুরী নামে খ্যাত ছিলেন। শিল্প সংস্কৃতির অঙ্গনে এই নাম এখন আমরা  সম্মানের সঙ্গে উচ্চারণ করি। তিনি যখন সিনেমা পত্রিকা প্রকাশ এবং চলচ্চিত্র নির্মাণ করেন তখনকার দিনে চলচ্চিত্র পত্রিকার সম্পাদক হওয়া এবং চলচ্চিত্র নির্মাতা হিসেবেন পরিচয় দেওয়াটা গল্পের মতোই শোনাতো। বৃক্ষ থেকেই যেমন ফল হয় তেমনি পুণ্ড্রবর্ধন থেকে মনি চৌধুরী বা ফজলুল হক ঐতিহাসিক উত্তরাধিকারের নাম। এই অংশ এক সময় গৌড় বঙ্গ ছিল। গৌড়বঙ্গের উত্তর-পশ্চিমাংশে অবস্থিত এই গুরুত্বপূর্ণ জনপদের এক সময়ের নাম ছিল পুণ্ড্রদেশ যার রাজধানী ছিল মহাস্থানগড়। বর্তমান বগুড়া জেলায় পড়েছে মহাস্থান গড়। এত কথা বলার উদ্দেশ্য হলো একজন মহামহিমকে চিনিয়ে দেওয়া। তিনি আর অন্য কেউ নন, সেই জনপদে জন্ম নেওয়া এই প্রতিভাধর সত্তার নাম আগেই বলেছি ফজলুল হক। শিল্পসাহিত্য ও সংস্কৃতির আলোর রেখায় তিনি বঙ্গজয়ী বীর। মৌর্য, গুপ্ত, পালসহ বিভিন্ন শাসনামলে এই অঞ্চল রাজনৈতিক ও সাংস্কৃতিকভাবে সমৃদ্ধ ছিল। তার ঐতিহ্য পথে তিনি সমৃদ্ধ করেন গোটা বঙ্গ সংস্কৃতিকে।
তিনি সিনেমা পত্রিকা সম্পাদনা করেছিলেন এ উত্তর বঙ্গ থেকে। ঢাকার আগেই উত্তর বঙ্গ সাংস্কৃতিক বলয় হয়ে উঠেছে। কলকাতার পরেই উত্তর বঙ্গ। যার আওতায় ছিল ভারতের দার্জিলিং, আলীপুর দুয়ার, দক্ষিণ দিনাজপুর, কুচবিহার ও জলপাইগুড়ি। যার মাটি ও মানুষের প্রতিভূ হয়ে উঠেছিলেন তিনি। তাঁর সম্পাদিত সিনেমা বিষয়ক পত্রিকার মান ও বিষয়বস্তু আজকের দিনের প্রযুক্তিগত আঙ্গিকের দূর অতীতের গোড়ার দিকটাতে কত শক্তিশালী ছিল যা গবেষকদের রীতিমত বিস্মিত করে। তাই তাঁকে ( ফজলুল হক) বৃহত্তর বঙ্গে একজন পথিকৃত চলচ্চিত্র সাংবাদিক ও সম্পাদক হিসেবে নমস্য ধরা হয়। তিনি শিশু চলচ্চিত্রের নির্মাতা ও পথপ্রদর্শক ছিলেন।
তাঁর নির্মিত প্রেসিডেন্ট  (president) চলচ্চিত্রটি বৃহত্তর বঙ্গের প্রথম শিশু চলচ্চিত্র হিসেবে চিহ্নিত। চলচ্চিত্রটি বঙ্গের বিভিন্ন অঞ্চলে শুট হয়েছিল, যাতে দেশ সম্পর্কে শিশুদের সচেতনতা বৃদ্ধি প্রাধান্য পেয়েছিল ।
তাঁর অবদানের প্রতি সম্মান হিসেবে ফজলুল হক স্মৃতি পদক ( Fazlul Haque Memorial Award) প্রতিষ্ঠিত হয়; এটির দ্বারা প্রতি বছর চিত্রজগত এবং চলচ্চিত্র সাংবাদিকতায় অবদান রাখা ব্যক্তিদের সম্মানিত করা হয়। এ ছাড়াও সরকারের উদ্যােগে স্মারক অডিটোরিয়াম তৈরি হয়েছে। বাংলাদেশ চলচ্চিত্র উন্নয়ন কর্পোরেশনের (BFDC)) প্রধান অডিটোরিয়ামগুলোর একটিকে তাঁর নামে নামকরণ করা হয়েছে এই মনীষীর নামে ।
পারিবারিক জীবন ও উত্তরাধিকার:
তাঁর সহধর্মিণী আমাদের প্রিয় খালাম্মা ছিলেন। প্রখ্যাত ঔপন্যাসিক তিনি। তাঁর নাম রাবেয়া খাতুন। তাঁকে সাহিত্য মহলে পরিচয় করিয়ে দিতে হয় না। বাংলাদেশের অন্যতম বিশিষ্ট সাহিত্যিকের অন্যতম প্রধান ছিলেন তিনি।। ৫০টিরও বেশি উপন্যাস এবং ৪০০-এর অধিক ছোটগল্পের রচয়িতা তিনি। তিনি নাটকও লিখেছেন। তাঁর নামে বাংলা একাডেমি থেকে কথাসাহিত্যে স্মারক সাহিত্য সম্মাননা প্রদান করা হয় ।
সন্তান:
তাঁর পুত্র কন্যাদের কে না চিনে? বাংলাদেশের শিল্পসাহিত্য ও সাংবাদিকতায় সুপরিচিত মুখ তাঁরা। তাঁর পুত্র ফরিদুর রেজা সাগর চ্যানেল আইয়ের ব্যবস্থাপনা পরিচালক ও মিডিয়া ব্যাক্তিত্ব। শিশু সাহিত্যে তিনি বাংলা একাডেমি ও একুশে পুরস্কার প্রাপ্ত। তিনি বাবার নির্মিত শিশু- চলচ্চিত্র প্রেসিডেন্ট ( President)–এ ছোট বেলায় মূল ভূমিকায় অভিনয় করেন। আজ তিনি বাংলাদেশের একজন গর্বিত ও প্রভাবশালী চলচ্চিত্র প্রযোজক, গল্পকার ও ছোটো কাকু চরিত্রের জনক। তিনি এ পর্যন্ত অনেক উল্লেখযোগ্য চলচ্চিত্র প্রযোজনা করেছেন। বানিয়েছেন ছোটে পর্দা ও বড়ো পর্দার পরিচালক, অভিনেতা ও অভিনেত্রীদেরকে। প্রয়াত কিংবদন্তি ফজলুল হকের রক্তের উত্তরাধীকার বলে কথা। ফজলুল হক জন্ম নেন ২৬ মে ১৯২২ আর প্রয়াত হন-২৬ অক্টোবর ২০০৩। একজন বাঙালি চলচ্চিত্র পরিচালক, প্রযোজক ও সাংবাদিক হিসেবে তিনি ছিলেন পথিকৃৎ।
ফজলুল হকের জন্ম বগুড়ায়। ব্রিটিশ ভারতের বগুড়া হাল আমলে বাংলাদেশ অংশে পড়েছে । ৭৩ বছর বয়সে তিনি কলকাতায় পরলোকগমন করেন। পেশায় সাংবাদিক, চলচ্চিত্র পরিচালক, প্রযোজক। তাঁর কর্মজীবন ১৯৫০-২০০৩ প্রায় ৫৩ বছর।
দাম্পত্য সঙ্গী কথাসাহিত্যিক রাবেয়া খাতুন ছাড়াও সন্তান ১.কেকা ফেরদৌসী ২.ফরিদুর রেজা সাগর,৩ ফরহাদুর রেজা প্রবাল,৪. ফারহানা মাহমুদ কাকলী। ফজলুল হকের পিতা-মাতা যথাক্রমে এফ মাহমুদ ( পিতা) ও এফ জাহান (মাতা)।
সারসংক্ষেপ:
ফজলুল হক ছিলেন চলচ্চিত্র সাংবাদিকতা ও শিশু চলচ্চিত্র–এর একজন পথিকৃত, যিনি সিনেমা (Cinema) ম্যাগাজিনের মাধ্যমে চলচ্চিত্র সাংবাদিকতার একটি ভিত্তি স্থাপন করেছিলেন এবং তাঁর নির্মিত প্রেসিডেন্ট(President) একটি প্রগতিশীল শিশু চলচ্চিত্র। তিনি  প্রেসিডেন্ট চলচ্চিত্র নির্মাণের মাধ্যমে চলচ্চিত্র শিল্পে একটি গুরুত্বপূর্ণ দাগ রেখেছেন। তাঁর পরিবারেও তাঁর সংস্কৃতি ও শিল্প-প্রবণতা উত্তর প্রজন্মে বহন করছে। আগেই বলেছি- তাঁর স্ত্রী ছিলেন প্রয়াত ঔপন্যাসিক রাবেয়া খাতুন এবং পুত্র ফরিদুর রেজা সাগর। সাগর যিনি নিজে আজকের দিনে প্রভাবশালী হিসেবে কাজ করছেন। 
তাঁর সম্পাদিত “সাপ্তাহিক সিনেমা” পত্রিকা তখনকার দিনে ছিল সৃজনশীলতায় বৈশিষ্ট্য। পত্রিকাটি বিনোদন ও চলচ্চিত্র বিষয়ক ম্যাগাজিন ছিল। বর্তমান সময়ে এটি বাংলাদেশের সাপ্তাহিক বিনোদন বা সিনেমা বিষয়ক পত্রিকার ইতিহাসে সবচেয়ে আধুনিক ও গুরুত্বপূর্ণ প্রকাশনা হিসেবে বিবেচিত হচ্ছে। তাঁর সাংবাদিকতায় ফটোগ্রাফ, প্রিন্ট লেআউট, কম্পোজিশন, আর্টওয়ার্ক—সকল বিষয়ের গভীর জ্ঞান ছিল এবং তিনি নিজেই প্রথম ছাপা কপি হাতে নিতেন।
আলো ছড়িয়ে আড়ালে চলে যাওয়া এই মহান ব্যক্তি আজ বাঙালি সংস্কৃতির নির্মাতাদের একজন। তার বিদেহী আত্মার প্রতি শ্রদ্ধা অবিরাম।
লেখক: কবিতাবিজ্ঞান ও অর্থনৈতিক বিজ্ঞানবাদের উপস্থাপক। বিজ্ঞান কবিতার প্রবর্তক ও চলচ্চিত্র গবেষক।
Leave a Reply